
প্রিন্ট: ৩১ মার্চ ২০২৫, ০৭:৩৭ পিএম
সড়ক, নৌ ও রেলপথে ঈদযাত্রা, লম্বা ছুটিতে ঘরমুখো মানুষের স্বস্তি

যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২৯ মার্চ ২০২৫, ১২:৩১ এএম

ফাইল ছবি
এ যেন এক অন্যরকম অনুভূতি। সড়ক-মহাসড়কে গাড়ির চাপ ছিল। কোথাও কোথাও থেমে থেমে ধীরগতিতে চলেছে গাড়ি। তবে অসহনীয় যানজট ছিল না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকার ভোগান্তিতে পড়েননি ঘরমুখো যাত্রীরা। কমলাপুর রেলস্টেশনে যাত্রীচাপ ছিল চোখে পড়ার মতো। তবে ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয় ছিল না। প্রায় সব ট্রেনই নির্ধারিত সময়ে ছেড়ে গেছে। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের ভিড় ছিল ঢাকা নদীবন্দরে (সদরঘাট)। তবে যাত্রী ভরে গেলেই ছেড়ে গেছে লঞ্চ।
ঈদযাত্রায় এমন দৃশ্য দেখে অনেকটাই বিস্মিত যাত্রীরা। বিগত বছরগুলোর মতো এবারের ঈদযাত্রায় ভোগান্তি না থাকায় খুশি তারা। তবে কয়েকটি বাসের বিরুদ্ধে বাড়তি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ করেন যাত্রীরা।
পরিবহণসংশ্লিষ্টরা জানান, এবার ঈদে দীর্ঘ ছুটি থাকায় গণপরিবহণে আকস্মিক যাত্রী চাপ হয়নি। অনেকেই আগে বাড়ি যাওয়ায় সড়ক-মহাসড়কেও গাড়ির সংখ্যা ছিল সহনীয়। এছাড়া প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় সড়কে বড় ধরনের যানজট হয়নি। কিছু কিছু বাস বাড়তি ভাড়া নিয়েছে সত্য। বেশির ভাগই সরকার নির্ধারিত ভাড়া আদায় করেছে। তবে টোল প্লাজাগুলোতে গাড়ির দীর্ঘ সারি ছিল বলেও জানান তারা।
এদিকে আকস্মিক সদরঘাট পরিদর্শন করেছেন নৌপরিবহণ উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন। এ সময় তিনি কয়েকটি লঞ্চে গিয়ে যাত্রীদের খোঁজখবর নেন। লঞ্চের নিরাপত্তা ও বাড়তি ভাড়া আদায় করা হয় কিনা- সে বিষয়ে খোঁজখবর নেন। ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন।
এদিকে রেলপথে ভোগান্তি নেই বলে জানান বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক প্রকৌশলী আফজাল হোসেন। তিনি বলেন, কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে ট্রেনের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করার ভোগান্তি নেই। নির্ধারিত সময়েই ছেড়ে যাচ্ছে ট্রেন। ফলে নির্বিঘ্নে বাড়ির পথে রওয়ানা হচ্ছে যাত্রীরা। আমরা প্রতিটা সেকশনে লোকবল রেখেছি। কোথাও কোনো সমস্যা হয়নি। আশা করছি এবার ঈদ যাত্রায় পুরো সময় ধরে সময় অনুযায়ী ট্রেন চলাচল করবে।
ঈদযাত্রায় ঘরমুখো মানুষের ভোগান্তি হয়নি বলে জানান বিআরটিএর চেয়ারম্যান মো. ইয়াসীন। গতকাল মহাখালী বাসস্ট্যান্ডে বিআরটিএর কার্যক্রম ও সার্বিক ব্যবস্থাপনা পরিদর্শন শেষে গণমাধ্যমকে তিনি এ কথা বলেন। তিনি বলেন, সড়ক, মহাসড়কে যানবাহনের বিশৃঙ্খলা কঠোরভাবে বন্ধ করা হচ্ছে। যানবাহনের কোনো ঘাটতি হবে না। ঘরমুখো মানুষের দুর্ভোগ কমাতে সার্বক্ষণিক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করা হয়েছে। অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিষয়টি নজরদারি করা হচ্ছে। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও যত্রতত্র পার্কিং নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে সেনাবাহিনী।
সরেজমিন দেখা গেছে, ঢাকার টার্মিনালগুলোতে গাড়িরজট ছিল। টোলপ্লাজাতে গাড়ির দীর্ঘ সারি ছিল। এছাড়া সড়ক-মহাসড়কগুলোতে উলেখযোগ্য যানজট ছিল না। ঢাকা-ভাঙ্গা, ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে প্রায় একই ধরনের চিত্র দেখা গেছে। রাজধানীর গাবতলী ও গুলিস্তান বাস টার্মিনালে যাত্রী চাপ খুব একটা ছিল না। অনেক বাস ডেকে ডেকে যাত্রী নিতে দেখা গেছে।
তবে বেশ কয়েকটি বাস অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করেছে। গুলিস্তানে ইলিশসহ কয়েকটি বাস বরিশালের ভাড়া ৯০০ টাকা আদায় করেছে। গাবতলী থেকে পাটুরিয়া ফেরিঘাট পর্যন্ত সেলফি বাসে আগে ১৫০ টাকা নিলেও গতকাল ৩০০ টাকা আদায় করেছে।
পরিবহণ শ্রমিকদের দাবি, ফেরার পথে বাসে যাত্রী না থাকায় বাড়তি ভাড়া নেন তারা।
এদিকে গুলিস্থানে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা অভিযান চালিয়ে বাড়তি ভাড়া আদায়ের প্রমাণ পেয়েছেন। বাড়তি ভাড়া আদায়ের দায়ে বিভিন্ন রুটের কয়েকটি বাসকে জরিমানা করেন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণের উপ-পরিচালক বিকাশচন্দ্র দাস। ‘ওয়েলকাম’ পরিবহণকে ৩০ হাজার, ‘দোলা’ পরিবহণকে ২০ হাজার টাকা এবং ‘তাজ আনন্দ’ সার্ভিসকে ৫ হাজার টাকা জরিমানা করেন।
ঈদযাত্রায় ভোগান্তি ছাড়াই গন্তব্যে যেতে সন্তোষ প্রকাশ করেন পূবালী ব্যাংকের নারায়ণগঞ্জ শাখার অপারেশন ম্যানেজার মোহাম্মদ নাসিম উদ্দীন। তিনি বলেন, রাজধানীর দোলাইরপাড় থেকে ইমাদ বাসে মাত্র সোয়া চার ঘণ্টায় খুলনায় পৌঁছেছি। কোথাও যানজটে পড়িনি। ভাড়া আগের মতোই ৬৫০ টাকা নিয়েছে।
তিনি বলেন, বিগত বছরগুলোর অভিজ্ঞতায় এবার নির্বিঘ্নে বাড়ি ফেরা নিয়ে চিন্তায় ছিলাম। কিন্তু কোনো ধরনের ভোগান্তি ছাড়াই বাড়ি ফিরতে পেরে খুব ভালো লাগছে। তিনি আরও বলেন, ঈদে লম্বা ছুটি হওয়ায় অনেকেই আগে বাড়ি চলে যাওয়ায় শেষ মুহূর্তে মানুষের উপচে পড়া ভিড় ছিল না।
শিডিউল বিপর্যয় নেই ট্রেনে : সরেজমিন দেখা গেছে, কমলাপুর ও বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনে যাত্রীচাপ ছিল। সময় মেনে ট্রেন গন্তব্যের উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়ায় যাত্রী দুর্ভোগ একেবারেই কম ছিল বলে জানিয়েছেন সাধারণ যাত্রীরা।
আবার কেউ বলছেন, কমলাপুর থেকে ট্রেন ছেড়ে বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছামাত্রই হুড়হুড় করে যাত্রীরা একটি ট্রেনে উঠছেন। বিনা টিকিটি যাত্রীরা সাধারণ কোচসহ এসি চেয়ার, প্রথম শ্রেণি ও কেবিন কোচে উঠে পড়ছেন। এতে করে টিকিটধারী যাত্রীদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। তবে যাত্রীদের সহযোগিতা করতে স্টেশনে স্কাউট সদস্যদের তৎপরতা দেখা গেছে।
এছাড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দালনের ব্যানারে স্টেশন প্রবেশ মুখে তথ্য সহায়তা কেন্দ্র ছিল। সেখানে ছাত্ররা ট্রেনযাত্রীদের তথ্য দিয়ে সহায়তা করতে দেখা গেছে।
সিল্কসিটি ট্রেনের যাত্রী সোহেল রানা জানান, তিনি পরিবারের ৪ সদস্য নিয়ে রাজশাহী যাচ্ছেন। স্টেশনে প্রবেশ করেই দেখতে পান প্ল্যাটফর্মে ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে। খুব সহজে তারা ট্রেনে উঠতে পেরেছেন।
জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস ট্রেনের যাত্রী জিল্লুল রহমান জানান, আগের মতো ঈদযাত্রায় ভোগান্তি নেই। বিগত বছরগুলোতে ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয়ে যে দুর্ভোগ হতো, সেটা নেই। শিডিউল বিপর্যয় না থাকায় প্লাটফর্মে যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড়ও নেই। বিগত বছরগুলোর তুলনায় এবার স্বস্তিতে বাড়ি ফিরছেন বলেও জানান তিনি।
কমলাপুর স্টেশন ম্যানেজার শাহাদাত হোসেন জানান, কয়েকটি ট্রেন সামান্য বিলম্বে ছেড়েছে। বাকি সব ট্রেন নির্দিষ্ট সময়ে ছেড়ে গেছে। ঢাকা টু নোয়াখালী উপকূল ৩০ মিনিট, ঢাকা টু জামালপুর এক্সপ্রেস ২০ মিনিট বিলম্বে কমলাপুর থেকে ছেড়ে গেছে। ঈদ যাত্রায় প্রতিদিন ৭১টি ট্রেন চলাচল করছে।
তিনি বলেন, কমলাপুর স্টেশনে টিকিট ছাড়া কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। যাত্রী নিরাপত্তায় আমরা সতর্ক অবস্থানে রয়েছি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কমলাপুর স্টেশনে চেয়ে বিমানবন্দর স্টেশনে যাত্রীচাপ বেশি ছিল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, টিকিট ছাড়া যাত্রীরা বিমানবন্দর থেকে বেশি উঠছে। বিশেষ করে গার্মেটস যাত্রীদের অধিকাংশই বিভিন্ন ট্রেনে উঠে পড়ছে। তিনি বলেন, বিমানবন্দর স্টেশনে যাত্রী চাপ বেশি হওয়ায়, বিনা টিকিটি যাত্রী নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে না।
সদরঘাটে যাত্রীচাপ : শুক্রবার সদরঘাটে যাত্রীদের প্রচণ্ড ভিড় ছিল। পাশাপাশি সতর্ক অবস্থায় ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও। নৌ পরিবহণ মন্ত্রণালয়, নৌ পরিবহণ অধিদপ্তর ও বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। নৌপথেও অনেকটা স্বস্তিতে গেছেন যাত্রীরা। গতকাল রাত ৮টা পর্যন্ত সদরঘাট থেকে বিভিন্ন রুটে ৮০টি লঞ্চ ছেড়ে গেছে।
বরগুনাগামী এমভি সুন্দরবন-৯ লঞ্চের যাত্রী ফারুক আলম বলেন, চার বছর আগে ঈদের সময় লঞ্চে জায়গা পাওয়া যেত না। অনেক সময় ছাদে ঝুঁকি নিয়ে যেতে হতো। পদ্মা সেতুর কারণে লঞ্চে আগের মতো উপচে পড়া ভিড় হয় না। তবে ঈদ উপলক্ষ্যে যাত্রীচাপ ভালোই আছে।
তিনি বলেন, নৌপথে যাতায়াত আরামদায়ক ও সাশ্রয়ী। এ কারণে লঞ্চে যাচ্ছি।
প্রায় একই ধরনের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন সুরভী-৭ লঞ্চের যাত্রী আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, বৃদ্ধ মা-বাবাকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে ঈদ করব। রাস্তায় যানজট হতে পারে, তাই আগেভাগেই বাসা থেকে চলে এলাম। আমাদের কেবিন বুকিং ছিল। সরাসরি লঞ্চে চলে এসেছি।
তিনি বলেন, অন্য বছরের তুলনায় এবার ঈদযাত্রায় ভোগান্তি নেই বললেই চলে।
লঞ্চ মালিকরা জানান, নির্ধারিত লঞ্চের পাশাপাশি অতিরিক্ত লঞ্চ রাখা হয়েছে। যাত্রী থাকা সাপেক্ষে অতিরিক্ত লঞ্চ বিশেষ সার্ভিস দিচ্ছে।
বিআইডব্লিউটিএর নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগের ঢাকা নদীবন্দরের যুগ্ম পরিচালক মোহাম্মদ মোবারক হোসেন বলেন, যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কোনো অবস্থাতেই লঞ্চে অতিরিক্ত যাত্রী বহন ও হয়রানি বরদাশত করা হয়নি। নির্ধারিত সময়ে পন্টুন থেকে লঞ্চ ছাড়ছে। সার্বক্ষণিক তদারকি করা হচ্ছে।