গাজা ও বাংলাদেশ প্রসঙ্গে যা বললেন ফরহাদ মজহার

যুগান্তর ডেস্ক
প্রকাশ: ২০ মার্চ ২০২৫, ০৪:০৪ পিএম

পোস্টের সঙ্গে এই ছবি শেয়ার করেছেন ফরহাদ মজহার
কবি ও বুদ্ধিজীবী ফরহাদ মজহার বৃহস্পতিবার দুপুরে ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছেন। এতে তিনি সম্প্রতি ভারত সফরে এসে মার্কিন গোয়েন্দা প্রধান তুলসী গ্যাবার্ড বাংলাদেশ প্রসঙ্গে বক্তব্য যে বক্তব্য দিয়েছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতা, সেনাপ্রধানের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন এবং বাংলাদেশ ও গাজা প্রসঙ্গে কথা বলেছেন। তার স্ট্যাটাসটি যুগান্তর পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো-
‘চোখ বন্ধ রাখলে প্রলয় বন্ধ থাকে না। অথবা কাকের খাসিলত নিয়ে গল্প মনে করুন, কাক মনে করে চোখ বন্ধ করে খেলে কেউ তাকে দেখে না। নোয়াখালীর একটা মশকরা আছে: পুকুরে ডুব দিয়ে পানি খেলে রোজা ভাঙে না, কারণ আল্লাহ আসমান থেকে পানির নিচে কী ঘটছে দেখতে পান না।
তুলসি গ্যাবার্ড ভারতে এসে কি বলবেন, সেটা আমাদের আগাম জানাই ছিল। মার্কিন গোয়েন্দা প্রধান সম্প্রতি ভারতে এসে বলেছেন, বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন এবং হত্যার ঘটনা দীর্ঘদিন ধরে চলছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য উদ্বেগের বিষয়। তিনি ইসলামি চরমপন্থা এবং সন্ত্রাসবাদের উত্থানকে বৈশ্বিক হুমকি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আমরা বুঝি যে, এই সব কথাবার্তা হুমকি-ধমকি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধেরই পুরানা বয়ান। ডোনাল্ড ট্রাম্প এসে একে আবার পুনর্জীবিত করেছেন। ট্রাম্পের দাবি মুসলমানরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পছন্দ করে না। এই অভিযোগের অনুচ্চারিত বিপরীত দিক হচ্ছে হিন্দু ভারত ট্রাম্পকে পূজা করে। মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি এই বিশ্বাস দ্বারাই পরিচালিত হচ্ছে, এই অনুমান অসঙ্গত নয়। এখান থেকে ভূরাজনীতির আঞ্চলিক বাস্তবতা আমরা নির্ণয় করতে অক্ষম হলে চলবে না। একে মোকাবিলা করতে হলে চাই দূরদর্শিতা, প্রজ্ঞা এবং বাংলাদেশে বিপুল বুদ্ধিবৃত্তিক এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলন। কিন্তু কে শোনে কার কথা? আমরা বিপর্যয়ের দিকে ধেয়ে চলেছি।
বাংলাদেশ সরকার যথারীতি প্রতিবাদ জানিয়েছেন। বলেছেন, তুলসি গ্যাবার্ডের বক্তব্য বিভ্রান্তিকর এবং বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করে। কিন্তু সরকারের দাবি ঠিক নয় যে, বাংলাদেশ শান্তিপূর্ণ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ইসলাম চর্চার জন্য পরিচিত। বরং উল্টাটাই অধিক সত্য। একের পর এক মাজার ভাঙা হয়েছে এবং মাজার ভাঙা এখনও বন্ধ হয়নি। এই ধ্বংসযজ্ঞের কী ব্যাখ্যা? সরকার আজ পর্যন্ত মাজার ভাঙার মতো ফৌজদারি অপরাধ যারা করেছে তাদের বিরুদ্ধে মামলা বা গ্রেফতারের উদ্যোগ নিয়েছে কিনা তা জনগণ জানতে পারছে না। রাষ্ট্র মাজার ভাঙার ক্ষেত্রে ফাঁপা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ ছাড়া কার্যত কিছুই করেনি।
সরকার বা প্রশাসন চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে এই সকল দাবিরও কোনো ভিত্তি নাই। প্রকাশ্য সভায় আইনের শাসন বা রাষ্ট্রের তোয়াক্কা না করে ‘হাতের অধিকার’ প্রয়োগ এবং হত্যার হুমকি দেওয়ার পরও তার বিরদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কার্যকর ঘোষণা কি দেওয়া হয়েছে? সরকার কিংবা প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি এটা কি অন্তর্ভুক্তিমূলক ইসলামের নমুনা? আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের জবাবদিহি করবার কিছু কি আছে?
এই যখন পরিস্থিতি তখন সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে দ্বন্দ্ব সৃষ্টির জন্য ক্রমাগত ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রচারণা চলছে। ভুয়া গুজব বিপুল। কিন্তু পরিকল্পিত রাজনৈতিক প্রপাগান্ডাকে উপেক্ষা করা বোকামি। অন্যদিকে প্রধান উপদেষ্টা এবং সেনাপ্রধানের মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে আনার চেষ্টা না করে অনেকে দূরত্ব বাড়িয়ে চলেছেন। আফসোস, রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে দূরদর্শী চিন্তা ও কার্যকর কৌশল নির্ণয়ের ক্ষেত্রে মারাত্মক অভাব রয়েছে, তেমনি রয়েছে বাস্তব পরিস্থিতির মধ্যে সমাধান নির্ণয়ের চেষ্টার অভাব। ফলে আমরা দ্রুত চরম রাজনৈতিক বিপর্যয়ের দিকে ধেয়ে চলেছি। সময় বেশি দূরে নয় সতর্কতার অভাবে আমরা পরস্পরকে দোষারোপ করতে থাকব এবং বাংলাদেশ ইন্দো-মার্কিন-ইসরাইলি পরিকল্পনা বাস্তবায়নে গাজার পর নতুন যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতার প্রশ্ন এখনও অমীমাংসিত রয়ে গেছে। যদি সেনা সমর্থনের ওপর উপদেষ্টা সরকারকে টিকে থাকতে হয় তাহলে দরকার সেনাপ্রধান এবং প্রধান উপদেষ্টার মধ্যে পারস্পরিক আস্থা এবং জনগণ ও সেনাবাহিনীর সম্পর্ক আরো স্বচ্ছ ও মজবুত করা। সম্পর্ক মজবুত ও আস্থা অর্জনের মধ্য দিয়েই উপদেষ্টা সরকারের বৈধতার প্রশ্নের মীমাংসা নিহিত রয়েছে। কারণ যে সংবিধান মেনে অভ্যুত্থান হয়নি তার বোঝা খামাখা বয়ে বেড়ানো ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিপজ্জনক।
তুলসি গ্যাবার্ডের অভিযোগের কূটনৈতিক প্রতিবাদ বাইরের প্রদর্শনী হোক, ক্ষতি নাই। কিন্তু বড় ক্ষতি হবার আগে নিজেদের ঘর ঠিক করা আমাদের সকলের কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে।’