এখনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পৌঁছেনি এক কোটি বই, নেপথ্যে কী
প্রকাশ: ১৯ মার্চ ২০২৫, ১০:৫০ এএম

৫ আগস্টের পর দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খাতে পরিবর্তন ও সংস্কার করা হলেও শিক্ষাব্যবস্থায় তেমন কোনো উদ্যোগই নেই। যদিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেই জুলাই অভ্যুত্থানের যাত্রা এবং পরে সরকারের পতন হয়।
শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর নতুন কারিকুলাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেয় মন্ত্রণালয়। এতে ২০১২ সালে প্রণীত সৃজনশীল কারিকুলাম স্থান পায় পাঠ্যবইয়ে। বছরের তিন মাস পার হতে চলল, কিন্তু বিনামূল্যের এই বই এখনো সব শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছাতে পারেনি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক কমিটি (এনসিটিবি)।
শেষ সময়ে এসে বিদেশ থেকে কাগজ আমদানির উদ্যোগ নেয় এনসিটিবি। পাঠ্যবইয়ের সংস্কার ও পরিমার্জনের দায়িত্বও পায় বিতর্কিতরা।
বলা যায়, এনসিটিবির এসব নানা অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত ও ধীরগতির কারণে বই ছাপাতে দেরি।
জানা যায়, নতুন শিক্ষাবর্ষের আড়াই মাসের বেশি সময় পার হয়ে গেছে। অথচ এখনো প্রায় এক কোটি বই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পৌঁছাতে পারেননি এনসিটিবি। এখনো ২০ লাখ বই ছাপানো বাকি রয়েছে। এর মধ্যে সবগুলোই মাধ্যমিক স্তরের বই।
এবার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের জন্য প্রায় ৪০ কোটি বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপানো হচ্ছে। এছাড়া শেষের দিকে ছাপানো বইয়ে মান ঠিক রাখছে না বেশ কয়েকটি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান।
সরেজমিন দেখা গেছে, নয়নমনি, ফরাজি, অক্সফোর্ড, কর্ণফুলীসহ বেশ কয়েকটি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান দরপত্র অনুযায়ী কাগজের মান ঠিক রাখেনি। এদিকে সদ্য সাবেক শিক্ষা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ এবার পাঠ্যবই দেরিতে দেওয়া হলেও মান ভালো হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছিলেন। কিন্তু সেই প্রশংসা ধরে রাখতে পারছে না এনসিটিবি।
অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল হক দুলু যুগান্তরকে বলেন, মার্চ মাস শেষ হয়ে যাচ্ছে, শিক্ষার্থীরা এখনো সব বই পায়নি। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া করুক, এনসিটিবি আদৌ সেটি চায় কিনা এটাই এখন বড় প্রশ্ন। শিক্ষার্থীদের স্বার্থের বিষয়টি তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। গদি দখল করে সরকারি টাকা লুটপাট করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন তারা। এবারও বইয়ের গুণগত মান রক্ষা করা হচ্ছে না। এনসিটিবির অসাধু কর্মকর্তার সঙ্গে যোগসাজশে নিম্নমানের কাগজ দিয়ে বই সরবরাহ করা হচ্ছে।
অভিযোগ রয়েছে, এবার বই ছাপানোর কাগজের কৃত্রিম সংকট তৈরি করেন ব্যবসায়ীরা। এ অভিযোগ আমলে নেননি এনসিটিবির চেয়ারম্যান। তিনি বিষয়টি সত্য নয় বলে দাবি করেছেন। কিন্তু শেষ সময়ে এসে তিনি নিজেই বিদেশ থেকে কাগজ আমদানির উদ্যোগ নেন। এই কাগজ এসে পৌঁছায় ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে। অথচ প্রথম থেকে উদ্যোগ নিলে এই সমস্যা অনেকটাই কেটে যেত।
এদিকে গত ২৬ জানুয়ারি এনসিটিবির চেয়ারম্যান ড. একেএম রিয়াজুল হাসান অবসরে যান। এরপর তাকে প্রেষণ প্রত্যাহারক্রমে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসাবে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরে সংযুক্ত করা হয়। পরে ফের দুই মাসের জন্য পুনরায় নিয়োগ দেওয়া হয়।
আগামী ২৫ মার্চ তার এই অতিরিক্ত মেয়াদ শেষ হবে। ফের অতিরিক্ত নিয়োগ পেতে মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন জায়গায় ধরনা দিচ্ছে এই চেয়ারম্যান।
জানা যায়, ২০১৮ সালের ২৫ মার্চ এনসিটিবিতে সদস্য (প্রাথমিক) পদে দায়িত্ব নেন অধ্যাপক রিয়াজুল হাসান। ডা. দীপু মনির সময়েও তিনি সাড়ে চার বছর এ পদে চাকরি করেন। পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের তৎকালীন চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম ও সদস্য অধ্যাপক মশিউজ্জামানের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়ানোয় ২০২৩ সালে এপ্রিল মাসে তাকে ওএসডি করা হয়। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে তদবির করে তিনি নিজেকে ‘বৈষম্যের শিকার’ দাবি করে এনসিটিবির চেয়ারম্যান পদ বাগিয়ে নেন।
অভিযোগ রয়েছে, অধ্যাপক রিয়াজুল হাসান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রজীবনে বাম রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তবে কর্মজীবনে তিনি সব সময় আওয়ামী লীগের পরিচয়ে লোভনীয় ও লাভজনক পদ বাগিয়েছেন। তিনি শেরপুর সরকারি কলেজ ও ঢাকার মিরপুর বাঙলা কলেজের অধ্যক্ষ পদেও ছিলেন।
তাছাড়া তিনি স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক আফজালুর রহমান বাবুর আপন মামাতো ভাই। সাবেক শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির সঙ্গে বিশেষ সখ্যের কারণে একাধিকবার বিদেশ সফরের সুযোগও বাগিয়ে নেন।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. একেএম রিয়াজুল হাসান যুগান্তরকে বলেন, নতুন শিক্ষাবর্ষের কিছু বই এখনো ছাপানো বাকি রয়েছে। দ্রুত কাজ শেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পৌঁছানো হবে বলে জানান তিনি।
এছাড়া পরিমার্জন ও সংশোধনের কারণসহ বেশ কিছু কারণে পাঠ্যবই দিতে দেরি হয়েছে।
শেষ সময়ে কাগজ আমদানির বিষয়ে তিনি বলেন, সিদ্ধান্ত দেরি হওয়ার কারণে এমন হয়েছে। বইয়ের মান নিয়ে তিনি বলেন, এবার সব পাঠ্যবইয়ের মান ভালো না হলেও ৮০ ভাগের মান ভালো।