Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

হুমকিতে হাজার কোটি টাকার ব্যবসা

আকাশপথে নৈরাজ্য

মুজিব মাসুদ

মুজিব মাসুদ

প্রকাশ: ০৪ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আকাশপথে নৈরাজ্য

ফাইল ছবি

আকাশপথের টিকিট নিয়ে চলছে অরাজকতা। প্রতিদিন বাড়ছে টিকিটের দাম। ঢাকা থেকে সৌদি আরব রুটে আগে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকায় টিকিট পাওয়া গেছে। এখন সেখানে ১ লাখ ৭০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকার নিচে টিকিট নেই। দাম বাড়ায় চরম দুর্ভোগে পড়েছেন ওমরা যাত্রীরা। ঢাকা থেকে বিশ্বের প্রায় সব গন্তব্যে টিকিটের একই অবস্থা। ডলার সংকটের কারণে নিজ দেশে টাকা নিতে না পেরে বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে ৪৫টি ফ্লাইট কমিয়েছে। এতে আসন সংখ্যা কমেছে। যাত্রীর চাপ থাকায় ভাড়া বাড়ছে হুহু করে। এছাড়া বিমানবন্দরে এয়ার ক্রাফটের ল্যান্ডিং, পার্কিং ও নিরাপত্তা এবং গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ে উচ্চ চার্জের প্রভাব পড়ছে টিকিটের ওপর।

এভিয়েশন খাতের বিশেষজ্ঞদের মতে, হঠাৎ করে টিকিটের দাম বেড়ে যাওয়ার নেপথ্যে কারসাজি আছে। উচ্চ ভ্রমণ কর, গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং চার্জ, ল্যান্ডিং ও পার্কিং চার্জসহ ডলার সংকটকে দায়ী করেছেন তারা। এর সঙ্গে যোগ করেন গ্রুপ টিকিট বিক্রি নিয়ে মন্ত্রণালয়ের জারিকৃত পরিপত্র। পরিকল্পিতভাবে এটা জারি করে আকাশ পথে ভাড়া নিয়ে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। পরিপত্রে বলা হয়েছে, এখন থেকে কোনো বিমান সংস্থা তিন দিন বা ৭২ ঘণ্টার বেশি কোনো টিকিটের বুকিং রাখতে পারবে না। বুকিং দেওয়া টিকিট তিন দিনের মধ্যে যাত্রীর নামে ইস্যু করতে হবে। টিকিট বুকিংয়ে সংশ্লিষ্ট যাত্রীর নাম, পাসপোর্ট নম্বর ও পাসপোর্টের ফটোকপিসহ বুকিং সম্পন্ন করতে হবে। তিন দিনের মধ্যে টিকিট ইস্যু না হলে এয়ারলাইনকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ওই টিকিট বাতিলের ব্যবস্থা করতে হবে। আকাশপথে ভ্রমণে টিকিটের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি রোধে এই নির্দেশনা জারি করেছে বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন মন্ত্রণালয়।

এয়ারলাইন্সগুলো সরকারের এই সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ। তাদের মতে, দেশে প্রতিদিনই টিকিটের চাহিদা বাড়ছে। ডলার সংকটে টিকিট বিক্রির ২ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ আটকে আছে দেশের ব্যাংকগুলোতে। বিদেশি এয়ারলাইনগুলো এই অর্থের ‘কস্ট অব ফান্ড’ সমন্বয়ে টিকিটের মূল্য বাড়িয়ে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, টিকিট বিক্রির অর্থ দেশে নিতে না পেরে এয়ালাইন্সগুলো ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে ৪৫টি ফ্লাইট কমিয়ে দিয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা থেকে ২১টি এবং চট্টগ্রাম থেকে কমিয়েছে ২৪টি। ফলে সপ্তাহে ৯ হাজারের বেশি আসনের ক্যাপাসিটি কমেছে।

অর্থনীতির সূচক অনুযায়ী ডিমান্ড বাড়লে পণ্যের দাম বাড়ে আবার ডিমান্ড কমলে দামও কমে। বর্তমানে টিকিটের চাহিদা অনুসারে সরবরাহ কমে যাওয়ায় এয়ার টিকিটের দাম হুহু করে বেড়ে চলছে। বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রণালয় ও এয়ারলাইন মালিকদের সংগঠন ‘বোর্ড অব এয়ারলাইন রিপ্রেজেন্টেটিভস বাংলাদেশ’ (বার) একাধিক বৈঠক করেও কোনো সুরাহা করতে পারেনি। বাধ্য হয়ে গ্রুপ টিকিট নিয়ে মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রটি বাতিল বা সংশোধন করার জন্য বারের পক্ষ থেকে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, এ ধরনের পরিপত্র আন্তর্জাতিক সিভিল এভিয়েশন আইনপরিপন্থি। এ সেক্টরে এমন কোনো বিধিনিষেধ আরোপ করা উচিত হবে না যা এয়ারলাইনের স্বাভাবিক বাণিজ্যিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্ত করে। কারণ এটি বিমান পরিবহণ পরিষেবার অর্থনৈতিক টেকসই ব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে যা বাংলাদেশের ভ্রমণ বাজার এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।

বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব (সিএ) অনুপ কুমার তালুকদার বারের চিঠি পাওয়ার বিষয়টি যুগান্তরকে নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেছেন, গত সপ্তাহের বৃহস্পতিবার চিঠিটি তারা পেয়েছেন। চিঠিতে সরকারি পরিপত্রের কিছু শর্ত নিয়ে তাদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে বলে তারা জানিয়েছেন। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের পরবর্তী বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলেও তিনি জানান। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মন্ত্রণালয় কর্তৃপক্ষ চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই গ্রুপ টিকিট নিয়ে একতরফা পরিপত্র জারি করায় টিকিটের দাম হুহু করে বেড়ে চলছে। ব্যবসায়ীরাও বলেছেন, পরিপত্রের কারণে দেশীয় ট্রাভেল এজেন্সির কাছে অগ্রিম গ্রুপ বুকিং ও বিক্রি বন্ধ রয়েছে। এতে বাংলাদেশের ট্রাভেল ইন্ডাস্ট্রির পুরো ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে বিদেশি অনলাইন ও ট্রাভেল এজেন্সির হাতে। কারণ সরকারের এই পরিপত্র শুধু স্থানীয়ভাবে কার্যকর হলেও আন্তর্জাতিকভাবে এটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়।

জানা গেছে, পরিপত্রের পর বাংলাদেশের ট্রাভেল এজেন্টরা এখন গ্রুপ টিকিটের জন্য দ্বারস্থ হচ্ছে বিদেশি ট্রাভেল এজেন্সির কাছে। এতে পুরো টাকা হুন্ডির মাধ্যমে চলে যাচ্ছে বিদেশে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি অব্যাহত থাকলে আকাশপথের ৪০ হাজার কোটি টাকার টিকিট ব্যবসার পুরো অর্থই বিদেশে পাচারের শঙ্কা রয়েছে।

বারের জেনারেল সেক্রেটারি আহমেদ রেজা স্বাক্ষরিত চিঠি পাঠানো হয়েছে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্তণালয়ে। মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব অনুপ কুমার তালুকদারকে দেওয়া ওই চিঠিতে বলা হয়, গ্রুপ টিকিট বিক্রি নিয়ে যে পরিপত্র জারি করা হয়েছে তা আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল আইন লঙ্ঘনজনিত অপরাধ। বাংলাদেশ সরকার যদি মনে করে তাহলে শুধু বাংলাদেশ থেকে বহির্গামী যাত্রীদের জন্য এই আইন করতে পারে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে এটি বহির্গামী ও আগমনী যাত্রীদের জন্যও করা হয়েছে।

বারের চিঠিতে বলা হয়েছে, বিভিন্ন এয়ারলাইনের বুকিং ক্লাসের জন্য আলাদা নীতি আছে, সেহেতু সব টিকিটের জন্য ৭২ ঘণ্টার প্রয়োগ করা সম্ভব নয়। কারণ বেশির ভাগ বাংলাদেশি যাত্রীকে বিদেশ ভ্রমণের আগে তাদের ভিসা অনুমোদন হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত করতে হয়। প্রায় সব ক্ষেত্রে, এই অনুমোদন পেতে ৭২ ঘণ্টার বেশি সময় লাগে।

গ্রুপ বুকিংয়ের জন্য, টিকিটের প্রকৃত বিক্রয়মূল্য বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়কে জানানো প্রসঙ্গে চিঠিতে বলা হয়েছে, এই ধরনের তথ্য প্রকাশ করা হলে এটি প্রাইজ ফিক্সিংয়ের কারণ হতে পারে, যা বাংলাদেশ এবং আন্তর্জাতিক উভয় প্রতিযোগিতা ও অ্যান্টি-ট্রাস্ট আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন। আহমেদ রেজা তার চিঠিতে বলেন, আমাদের সদস্য এয়ারলাইনগুলো কোনোভাবেই টিকিট সংরক্ষণের পক্ষে নয়, যা বাজারে মূল্য বিকৃতি ঘটায়।

যে কারণে বাড়ছে টিকিটের দাম : যুগান্তরের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, যাত্রী ও এয়ারলাইনের ওপর নানারকম শুল্ক আরোপ করার কারণে আকাশপথের টিকিটের দাম অনেক বেড়ে গেছে। বর্তমানে দেশের এভিয়েশন সেক্টরের ওপর যে কর তা বিদেশি সরকারের আরোপিত করের তুলনায় দ্বিগুণ। এই কর টিকিটের সঙ্গে যোগ করেন মালিকরা। একজন যাত্রী যদি বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, মাস্কট, আবুধাবি, দুবাই, শারজাহ ভ্রমণ করেন তবে তাকে ৯,৮৯০ টাকা কর দিতে হয়। কিন্তু মালয়েশিয়া থেকে বাংলাদেশে ফেরার সময় ওই যাত্রীকে মাত্র ২,৫৬৮ টাকা কর দিতে হয়। অর্থাৎ বাংলাদেশ থেকে যাত্রার সময় যাত্রীরা অতিরিক্ত ৭,৩২২ টাকা গুনতে বাধ্য হন। পদ্মা অয়েল ঢাকার সব এয়ারলাইন্সকে উচ্চমূল্যে জ্বালানি সরবরাহ করে যা বিশ্বের অন্যতম ব্যয়বহুল। ঢাকায় প্রতি লিটার জ্বালানির মূল্য ০.৭৫ ডলার, যেখানে কুয়ালালামপুরে হচ্ছে ০.৫৯ ডলার। বাংলাদেশের ট্রাভেল এজেন্টরা ৭ শতাংশ কমিশন পায়, যা টিকিটের মূল্যে যুক্ত হয়। ঢাকা-কুয়ালালামপুর রুটের টিকিট মূল্য ৩৩,৮৩৩ টাকা হলে যাত্রীদের ১,৬৭৬ টাকা ট্রাভেল এজেন্ট কমিশন হিসাবে পরিশোধ করতে হয়। সাউথ-ইস্ট এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের প্রধান এয়ারলাইন্স নেট মূল্যে টিকিট বিক্রি করে এবং ট্রাভেল এজেন্টদের জন্য নির্দিষ্ট কমিশন রাখে না। ফলে বিদেশ থেকে উড়ে আসতে যাত্রীদের টিকিট খরচ কম হয়।

উচ্চ ল্যান্ডিং, পার্কিং ও নিরাপত্তা চার্জ : বাংলাদেশের সিভিল এভিয়েশন অথরিটি বিমান অবতরণ, পার্কিং ও নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত বেশি চার্জ করে যা শেষ পর্যন্ত যাত্রীদের টিকিট মূল্যে প্রভাব ফেলে। একটি বোয়িং ৭৩৭-৮০০ বিমান ঢাকায় অবতরণ করলে ১৫ শতাংশ ভ্যাটসহ ২ লাখ ২৫ হাজার ১৫ টাকা ফি দিতে হয়। একই বিমান কুয়ালালামপুরে অবতরণ করলে মাত্র ১৫ হাজার ৫৩৭ টাকা ফি দিতে হয়।

উচ্চ গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং চার্জ

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ঢাকায় একমাত্র গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সেবা প্রদানকারী কোম্পানি। বিদেশি এয়ারলাইন্সের জন্য এটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল। ঢাকায় একটি বোয়িং ৭৩৭-৮০০ বিমান গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং চার্জ হিসাবে দিতে হয় ৩ লাখ ৫ হাজার ৯৫০ টাকা। একই সেবার জন্য কুয়ালালামপুরে লাগে মাত্র ৯৭ হাজার ৫৪৫ টাকা।

রেমিট্যান্স সমস্যার কারণে অতিরিক্ত খরচ : বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো তাদের বিক্রির অর্থ বাংলাদেশ থেকে নিজ দেশে পাঠাতে পারছে না। বর্তমানে ২ হাজার ১৯ কোটি টাকা আটকে আছে বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যাংকে। যেহেতু এয়ারলাইন্সগুলো সময়মতো অর্থ পাচ্ছে না, তারা মূলধনের ব্যয় হিসাব করে এবং এই খরচ টিকিট মূল্যে যোগ করে টিকিটের দাম নির্ধারণ করছে। এত টিকিটের দাম বেড়ে যাচ্ছে।

ফ্লাইট গুটিয়ে নিচ্ছে বিদেশি এয়ারলাইন্স : ডলার সংকটে বর্তমানে টিকিট বিক্রির ২ হাজার ১৯ কোটি টাকার বেশি অর্থ আটকে আছে। গত বছরের মার্চ থেকে এই তহবিল পাঠানো যাচ্ছে না সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে। নিরুপায় বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ফ্লাইট কাটছাঁট শুরু করেছে বেশির ভাগ এয়ারলাইন্স। এমনকি দুটি এয়ারলাইন্স ফ্লাইট পরিচালনা স্থগিতেরও চিন্তাভাবনা করছে। টার্কিশ এয়ারলাইন্স আগে বাংলাদেশ থেকে সপ্তাহে ১৪টি ফ্লাইট পরিচালনা করলেও এখন করছে মাত্র ৭টি। সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স সপ্তাহে ১০টির জায়গায় এখন চালাচ্ছে ৭টি। মালিন্দো ও ক্যাথে প্যাসেফিক আগে সপ্তাহে ৫টি ফ্লাইট চালালেও এখন মাত্র ১টি ফ্লাইট চালাচ্ছে। ফ্লাই দুবাই ঢাকা ও চট্টগ্রামে সপ্তাহে ১৭টি ফ্লাইট কমিয়েছে। ওমান এয়ার কমিয়েছে চট্টগ্রামে সপ্তাহে ৭টি, জাজিরা এয়ারলাইন্স চট্টগ্রামে সপ্তাহে ৭টি, ইতেহাদ ঢাকয় ৭টি ফ্লাইট কমিয়েছে। আর কুয়েত এয়ারলাইন্স আগে ১২টি ফ্লাইট চালালেও এখন চালাচ্ছে ১০টি। মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্স ইতোমধ্যে বাংলাদেশ থেকে ফ্লাইট পরিচালনা স্থগিতের পরিকল্পনা করছে। বর্তমানে এয়ারলাইন্সটির ৪০০ কোটি টাকার বেশি অর্থ বাংলাদেশে আটকে আছে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম