Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

জাতীয় শহিদ সেনা দিবস আজ

সেনাবাহিনী ও বিডিআরকে দুর্বল করতেই ষড়যন্ত্র

পিলখানা ট্র্যাজেডি : তদন্ত কমিশনের প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ: হাসিনার ক্ষমতার লোভকে কাজে লাগিয়েছে বিদেশি চক্র * ২০০৫ থেকে শুরু হয় ‘নীলনকশা’ তৈরির কাজ, নেপথ্যে তিনটি স্পর্শকাতর ঘটনা

সিরাজুল ইসলাম

সিরাজুল ইসলাম

প্রকাশ: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সেনাবাহিনী ও বিডিআরকে দুর্বল করতেই ষড়যন্ত্র

দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের ‘নীলনকশা’ বাস্তবায়নের অংশ হিসাবেই ঘটানো হয়েছে ইতিহাসের নৃশংসতম পিলখানা ট্র্যাজেডি। ট্র্যাজেডির মাধ্যমে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী ও বিডিআরকে দুর্বল করে দুঃশাসন চালাতে চেয়েছিলেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০০৫ সাল থেকেই শুরু হয় ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের প্রাথমিক কাজ। তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন না তিনি। পিলখানা ট্র্যাজেডির বিষয়ে গঠিত জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনের প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য। সেখানে আরও পাওয়া গেছে, ক্ষমতা দীর্ঘদিন কুক্ষিগত করার লোভ ছিল শেখ হাসিনার। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে হাসিনার মাধ্যমে একটি বিদেশি শক্তি চেয়েছিল বাংলাদেশের সেনাবাহিনী ও বিডিআরকে দুর্বল করতে। বিদেশি ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে ছিল তিনটি স্পর্শকাতর ঘটনা। এসব ঘটনায় দেশের হয়ে সরাসরি ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছিল তৎকালীন বিডিআর (বর্তমান নাম বিজিবি) সদস্যরা। এতে একটি দেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়েছিল। ঘটনাগুলো হয়েছে ২০০১ থকে ২০০৫ সালের মধ্যে। এর জেরেই পরিকল্পিতভাবে ২০০৯ সালে তৎকালীন বিডিআরের সদর দপ্তর পিলখানায় ঘটানো হয় ইতিহাসের নৃশংসতম ট্র্যাজেডি। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত প্রাথমিকভাবে সংগ্রহ করা হয়েছে। কিন্তু তদন্তের স্বার্থে এখনই কমিশনের কেউ এ প্রসঙ্গে সুনির্দিষ্টভাবে মুখ খুলছেন না। 

ভয়াবহ এই পিলখানা ট্র্যাজেডির ১৬ বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এ দিনটি ‘জাতীয় শহিদ সেনা দিবস’ হিসাবে ঘোষণা করেছে। প্রতিবছর ২৫ ফেব্রুয়ারি ‘জাতীয় শহিদ সেনা দিবস’ পালন করা হবে। এ দিবস (সরকারি ছুটি ব্যতীত) পালনের জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবস পালনসংক্রান্ত পরিপত্রের ‘গ’ শ্রেণিভুক্ত দিবস হিসাবে অন্তর্ভুক্তকরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি যথাযথ মর্যদায় পালিত হচ্ছে আজ। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব.) বনানী কবরস্থানে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন সকাল ৯টায়। একই সময়ে সেনাবাহিনীর আয়োজনে শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন করা হবে। সকাল ১১টায় মহাখালী রাওয়া ক্লাবে ফটো এক্সিবিশনের আয়োজন করা হয়েছে। শহিদ পরিবারবর্গ ও শহিদ সেনা অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে বাদ মাগরিব মিরপুর ডিওএইচএস সেন্ট্রাল মসজিদে দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। আর নিহত সেনা কর্মকর্তাদের স্মরণে সরকারের পদস্থ কর্মকর্তা, স্বজন ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা বনানী কবরস্থানে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাবেন। এছাড়া বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) পক্ষ থেকে গ্রহণ করা হয়েছে পৃথক কর্মসূচি। বিজিবি সদর দপ্তরসহ সারা দেশের বিজিবি কার্যালয়গুলোয় বাদ ফজর কুরআন খতম অনুষ্ঠিত হবে। রেজিমেন্টাল পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে। বাদ আসর মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। এদিন বিজিবির সব সদস্য কলো ব্যাজ পরিধান করবেন। 

প্রসঙ্গত, ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় ইতিহাসের অন্যতম হত্যাকাণ্ডে শহিদ হন ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন। ঘটনার তদন্তে ১৬ বছরে একাধিক তদন্ত কমিশন ও সরকারের বিভিন্ন সংস্থা প্রতিবেদন দাখিল করেছে। পিলখানায় তৎকালীন বিডিআর সদর দপ্তরে নির্মম ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় করা হত্যা মামলাটি ১৬ বছরেও চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি। এদিকে বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় জামিন পেয়ে ১৬ বছর পর কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন বিডিআরের সাবেক ৪১ সদস্য। তারা সবাই হত্যা মামলায় উচ্চ আদালত থেকে খালাস পাওয়া ব্যক্তি। এ মামলায় বিচারিক আদালতে এখনো সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। অন্যদিকে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদসহ ৫৮ জনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে একটি অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে। নিহত সেনা কর্মকর্তাদের স্বজনদের করা এ অভিযোগটি তদন্তাধীন রয়েছে। হত্যা মামলায় ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর মহানগর দায়রা জজ আদালত রায় প্রদান করেন। রায়ে ১৫২ জনের মৃত্যুদণ্ড এবং ১৬১ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এছাড়া ২৫৬ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা এবং ২৭৭ জন আসামিকে খালাস দেওয়া হয়। অপরদিকে বিস্ফোরক আইনের মামলায় ৮৩৪ জনের বিচার শুরু হয় ২০১০ সালে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর গত ২৪ ডিসেম্বর অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আ ল ম ফজলুর রহমানকে প্রধান করে বিডিআর হত্যাকাণ্ড তদন্তে ‘জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন’ গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। সাত সদস্যের এ কমিশনকে ৯০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের সময় বেঁধে দেওয়া হয়। 

স্বাধীন তদন্ত কমিশন সূত্রে জানা গেছে, তদন্তের অংশ হিসাবে প্রাথমিকভাবে এরই মধ্যে ১৪ জনের ওপর বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেছে তদন্ত কমিশন। এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরও অনেকের ওপর দেওয়া হবে। যাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, তাদের গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী মনে করছে কমিশন। তারা বেশির ভাগই শেখ হাসিনা সরকারের স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র এবং তথ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এছাড়া এ পর্যন্ত ৪০ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। আরও শতাধিক ব্যক্তির সাক্ষ্য নেওয়া হবে। 

কমিশনের প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে আরও যেসব তথ্য এসেছে, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো-আওয়ামী লীগ সরকারের সময় গঠিত তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনগুলো পূর্ণাঙ্গভাবে তৈরি করা হয়নি। সেগুলোয় অনেক ঘাটতি আছে। তখনকার সরকারে থাকা অনেক প্রভাবশালী পিলখানা হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। প্রতিবেদনগুলোয় তাদের এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। নেপথ্যে থাকা আওয়ামী লীগ নেতাদের নাম অতীতের কোনো প্রতিবেদনেই আসেনি। তৎকালীন সামরিক, রাজনৈতিক-দলীয় এবং গোয়েন্দা কমান্ডে থাকা সবাই ছিল পরিকল্পনায়। সমন্বয়কারী হিসাবে কাজ করেছেন সাবেক মন্ত্রী কর্নেল (অব.) ফারুক খান। জঘন্য কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে যেসব সেনা কর্মকর্তা প্রতিবাদ করেছেন, তাদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। পাশাপাশি নেওয়া হয়েছে আয়নাঘরেও। 

বিদেশি ষড়যন্ত্রের কারণ জানতে চাইলে তদন্তসংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, উল্লিখিত তিনটি স্পর্শকাতর ঘটনা আমরা প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করেছি। এখন চলছে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণের কাজ। 

ওই সূত্র আরও জানায়, নীলনকশা অনুযায়ী, বিডিআর এবং সেনাবাহিনী-দুটিকেই দুর্বল করার পরিকল্পনা ছিল। কারণ, বিডিআরপ্রধানসহ সব অফিসারই ছিলেন সেনা কর্মকর্তা। ওই সময় বিডিআরপ্রধান শাকিল আহমেদসহ বেছে বেছে চৌকশ ৫৭ সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করা হয়। অপরদিকে শেখ হাসিনা নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে সেনাবাহিনীকে দুর্বল করতে চেয়েছিলেন। তিনি সেটা পেরেছিলেনও। সেনাবাহিনীকে দুর্বল অবস্থায় রেখে তিনি ১৫ বছরের বেশি সময় দুঃশাসন চালিয়েছেন। শেখ মুজিবুর রহমানও তার শাসনামলে এমনটাই চেয়েছিলেন। ওই চাওয়া থেকেই সেনাবাহিনীকে দুর্বল করে রক্ষী বাহিনী তৈরি করেছিলেন তিনি। 

সূত্রমতে, পিলখানা হত্যাকাণ্ডের পর বিডিআরকে দুর্বল করতে তৎকালীন সরকার বিসিএস অফিসার দিয়ে বিডিআর পরিচালনা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কিছু কিছু সেনা কর্মকর্তার কারণে সেটা হয়নি। যেসব সেনা কর্মকর্তার কারণে ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি বা যারা পিলখানা হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সরব ছিলেন, তাদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছে, আয়নাঘরে নেওয়া হয়েছে।

আরও জানা গেছে, বিডিআর বিদ্রোহের পরিকল্পনা করা হচ্ছিল ২০০৫ সাল থেকে। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর সেটি বাস্তবায়ন করা হয়। এক্ষেত্রে কাজে লাগানো হয় ঊর্ধ্বতনদের প্রতি বিডিআর জওয়ানদের ক্ষোভকে। ওই সময় সামরিক, রাজনৈতিক-দলীয় এবং গোয়েন্দা কমান্ডে যারা ছিলেন, তারা সবাই পিলখানা ট্র্যাজেডির পরিকল্পনায় ছিলেন। অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন, মতিয়া চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, মির্জা আজম, জাহাঙ্গীর কবির নানক, কর্নেল (অব.) ফারুক খান, মেজর জেনারেল (অব.) তারেক সিদ্দিক, শেখ ফজলে নূর তাপসসহ অনেকের ভূমিকা ছিল তখন প্রশ্নবিদ্ধ। তাদের মধ্যে ফারুক খান সমন্বয়কারী ছিলেন বলে সূত্র জানিয়েছে। 

পিলখানা ট্র্যাজেডিতে শেখ হাসিনার সংশ্লিষ্টতা উল্লেখ করে তদন্ত কমিশনের একজন সদস্য বলেন, গোয়েন্দা তথ্য আগে থেকেই ছিল। তারপরও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। হত্যাযজ্ঞ শুরু হওয়ার পর তৎকালীন বিডিআরপ্রধান পিলখানার ভেতর থেকে ওই সময়ের সেনাপ্রধান এবং প্রধানমন্ত্রীর কাছে বারবার ফোন করে জীবন বাঁচানোর আর্তি জানিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। পিলখানার ভেতরে অভিযান চালাতে সামরিক বাহিনী এবং র‌্যাব প্রস্তুত ছিল। সঠিক নির্দেশনা না থাকায় কেউ ভেতরে প্রবেশ করতে পারেননি। আর এ সুযোগে হত্যাকাণ্ডের পর লাশ পোড়ানো হয়েছে। মাটির নিচে পুঁতে ফেলা হয়েছে। ড্রেনে-স্যুয়ারেজ লাইনে ফেলে দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, ঘাতকদের পলায়নের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এসবের দায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এড়াতে পারেন না। 

জানতে চাইলে পিলখানা হত্যাকাণ্ড সংক্রান্ত জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনের সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) আ ল ম ফজলুর রহমান বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, তদন্ত কমিশনের অগ্রগতি ইতোমধ্যে গণমাধ্যমকে জানিয়েছি। এ মুহূর্তে আর কিছু বলা যাবে না। গত ২০ ফেব্রুয়ারি তিনি সাংবাদিকদের জানান, ঘটনার বিস্তারিত জানতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদসহ পলাতক অনেককে জিজ্ঞাসাবাদ করা খুবই প্রয়োজন। আমরা দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের বিষয়টি জোরালোভাবে খতিয়ে দেখছি। 

তদন্তের অগ্রগতি জানতে চাইলে তদন্ত কমিশনের অপর একজন সদস্য বলেন, আমরা প্রাইমারি এবং সেকেন্ডারি তথ্যপ্রমাণ নিয়ে কাজ করছি। আমাদের সাতটি এরিয়া দেওয়া হয়েছে। ওই এরিয়ার মধ্য থেকে তদন্ত চালাচ্ছি। আমরা এখন ব্যক্তি ও পারিবারিক সাক্ষ্য নিচ্ছি। এটা শেষ হলে অডিও-ভিডিও সংক্রান্ত ডকুমেন্ট সরবরাহ করব।


Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম