সেমিনারে বক্তারা
গ্যাসের দাম বাড়লে শিল্প টিকবে না

যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০২ এএম

এমনিতেই নানা সংকটে দেশের শিল্পোদ্যোক্তারা। এরপরও গ্যাসের দাম দ্বিগুণ বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে সরকার। এ অবস্থায় গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে নতুন বিনিয়োগ নয়, পুরোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠানও টিকবে না। রোববার রাজধানীর স্থানীয় একটি হোটেলে পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশ ও ইকোনমিক রিপোর্টাস ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত সেমিনারে ব্যবসায়ীরা এসব কথা বলেন।
ইআরএফ সভাপতি দৌলত আকতার মালার সভাপতিত্বে সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজ। বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ চেম্বারের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ, বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল, নিটওয়্যার পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন এবং ইউরোপীয় চেম্বারের সভাপতি নূরিয়া লোপেজ প্রমুখ। সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ। বক্তাদের মতে, জ্বালানি দুর্ভিক্ষের দিকে যাচ্ছে দেশ। এক্ষেত্রে সরকার জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতে ব্যর্থ হয়েছে। এ সময়ে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তর (এলডিসি উত্তরণ) আরও পেছানোর পক্ষে মত দিয়েছেন তারা।
বক্তারা বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধ এবং সস্তা শ্রম না পাওয়ায় পোশাক উৎপাদন থেকে বেরিয়ে আসছে চীন। এক্ষেত্রে তারা তাদের কারখানাগুলো বাংলাদেশে স্থানান্তর করতে চায়। চীনের মতো আরও অনেক দেশ বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে চায়। তাদের বিনিয়োগকে স্বাগত জানিয়ে আমাদের সুবিধা বাড়ানো উচিত। কিন্তু দেশে গ্যাসের সরবরাহ সমস্যার সঙ্গে এখন নতুন করে দাম দ্বিগুণ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এতে উৎপাদন খরচ বাড়বে। আর উৎপাদন খরচ বাড়লে বিদেশিরা আমাদের দেশে কেন বিনিয়োগ করবেন? তারা আমাদের দেশে বিনিয়োগে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নন। বিদেশিরা সব সময় বিনিয়োগের জন্য ভালো বিকল্প খোঁজেন। যেখানে বেশি সুবিধা পাবেন সেখানেই যাবেন। সেক্ষেত্রে ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, ভারতসহ প্রতিযোগী দেশগুলো আমাদের চেয়ে বেশি সুবিধা দিচ্ছে। গ্যাসের দামে বৈষম্য তৈরি হলে নতুন কোনো স্থানীয় বিনিয়োগও হবে না। এতে দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য কমে কর্মসংস্থান বন্ধ হয়ে যাবে। বিদ্যমান শিল্পগুলোও পুরোপুরি আমদানি নির্ভর হয়ে পড়বে। তাই গ্যাসের দাম না বাড়িয়ে কীভাবে কমানো যায় তা নিয়ে আলোচনা করতে হবে। এক্ষেত্রে সিস্টেম লস কমানো ও গ্যাসের আমদানি মূল্য রিভিউ উচিত।
ইউরো চেম্বারের সভাপতি নূরিয়া লোপেজ বলেন, এখন অর্থনীতির যে অবস্থা তাতে বাংলাদেশ এলডিসি থেকে গ্র্যাজুয়েশনের জন্য প্রস্তুত নয়। মাসরুর রিয়াজ বলেন, এখনকার চ্যালেঞ্জিং সময়ে গ্যাসের দাম দ্বিগুণ করা হলে উৎপাদনমুখী খাতে পণ্য উৎপাদনের ব্যয় বাড়বে। কমবে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা। নতুন বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। একই সঙ্গে সিমেন্ট, ইস্পাত ও সিরামিক খাতে নতুন করে আমদানি নির্ভরতা বাড়বে। ফলে আর্থিক খাতে চাপ পড়বে। আমদানি বাড়লে বৈদেশিক মুদ্রা বেশি লাগবে। আবার গ্যাসের দাম বাড়লে অনেক শিল্প বন্ধ হবে, তখন মন্দ ঋণ বাড়বে।
বিসিআই সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, সস্তা গ্যাসের কারণে দেশে শিল্প-কারখানা হয়েছে। কিন্তু বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার নিরাপত্তা দিতে পারছে না। ব্যাংকে সুদের হার বেশি। এনবিআরেও অন্য সমস্যা আছে। আরেক দিকে গ্যাসের দাম বাড়তি। তারপরও চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস মিলছে না। সরকার নতুন শিল্পের জন্য ১৫০ শতাংশ এবং সম্প্রসারণ শিল্পের জন্য ৫০ শতাংশ গ্যাসের দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে। এমন পরিকল্পনার জন্য সরকারকে ধন্যবাদ। আমরা আর কেউ শিল্প করতে চাই না। তবে বর্তমান শিল্পকে সহায়তা করবেন না, এটা হতে পারে না। দেশের অর্থনীতি ধরে রাখতে হলে গ্যাসের দাম বর্তমানের চেয়ে কমানো দরকার।
বিটিএমএ সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, গ্যাসের বর্তমান দাম কমানোর উপায় নিয়ে গবেষণা করা দরকার। কমিশন খাওয়ায় জন্য স্পট মার্কেট থেকে গ্যাস কিনতে অস্থির ছিল বিগত সরকারের লোকজন। তারা বিদেশে বসে এখনো কমিশন খাচ্ছে। দাম কমানো না গেলে শিল্প থাকবে না। মূলত আমরা ফেঁসে গেছি। কিছু ব্যাংককে টাকা দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক, কারণ ব্যাংকগুলো লুট হয়েছে। ব্যাংকগুলো টিকিয়ে রাখতে টাকা দেওয়া হলেও শিল্প টিকিয়ে রাখার দিকে মনোযোগ নেই। ব্যাংক ঋণের সুদহার ১৮ শতাংশ। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে চলতি মূলধন অর্ধেক কমে গেছে। দেশে এত চিনিকল থাকতে পাকিস্তান থেকে চিনি আমদানি হচ্ছে, এটা লজ্জাজনক। এই আমদানির কারণে কিন্তু কর্মসংস্থান হবে না।
ফরেন চেম্বারের সভাপতি জাভেদ আখতার বলেন, বিদেশি বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশ একমাত্র গন্তব্য নয়। বিদেশিদের কাছে অনেক অপশন থাকে। অনেক অপশনের মধ্যে বাংলাদেশ একটি। বিনিয়োগকারীরা ভালো অপশনগুলো খোঁজেন। গ্যাস-বিদ্যুতের পলিসির ক্ষেত্রে আমাদের চেয়ে কেনিয়া, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ভালো অবস্থানে রয়েছে। তাই আমরা যদি বিদেশিদের ভালো অপশন দিতে না পারি, তাহলে তারা বিনিয়োগ করবে না। তিনি বলেন, আমরা আশা করছি স্বল্পমেয়াদি সমস্যাগুলো সরকার সমাধান করবে। এরপর দীর্ঘমেয়াদের জন্য একটা ভালো নীতি তৈরি করবে।
নিটওয়্যার পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, এখাতে চীন ১৩০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে। তারা যদি এসে দেখে গ্যাসের কারণে স্থানীয় বিনিয়োগকারীরাই কারখানা বন্ধ করে, তাহলে কেন এ দেশে আসবে? আমরা হিসাব করে দেখেছি, যদি দাম বাড়ানো হয়, তবে বছরে তিন কোটি টাকার বেশি বাড়তি বিল দিতে হবে আমাদের। এত টাকা আমরা মুনাফাও করি না। গ্যাসের দাম বেড়েছে বলে বিদেশি ক্রেতাদের কাছে বাড়তি দাম চাওয়া যাবে না। কারণ প্রতিযোগিতার বাজারে অনেক দেশ বসে আছে আমাদের অর্ডার কেড়ে নিতে। দেশ এই মুহূর্তে এলডিসি থেকে উত্তরণে প্রস্তুত নয়। মিথ্যা তথ্য দিয়ে এলডিসি থেকে উত্তরণের জন্য তৈরি হয়েছিল বাংলাদেশ। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন বলেন, আমরা জ্বালানি দুর্ভিক্ষের দিকে যাচ্ছি। এতদিন শুধু সরবরাহ সমস্যা ছিল। কিন্তু একটা সময় এসে অনেক খাতে গ্যাস বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ বাস্তবতা হলো গ্যাসের উৎপাদন কমছে। ২০১৬-১৭ সালে দেশে ২৮শ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন হতো। বর্তমানে তা ১৯শ মিলিয়ন ঘনফুটে নেমেছে।
বিএসআরএমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমীর আলী হোসাইন বলেন, স্টিল উৎপাদন খাতে ৪০ শতাংশের বেশি জ্বালানি খরচ হয়। গ্যাসের দাম বাড়লে উৎপাদন খরচও বাড়বে। এতে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। সুতরাং শিল্প বাঁচাতে হলে জ্বালানি খরচ কমাতে হবে। দেশে একটা সময় খুবই সস্তায় গ্যাস দেওয়া হয়েছে। তখন থেকেই মূল্য সমন্বয় হলে এখন হঠাৎ চাপে পড়তে হতো না উদ্যোক্তাদের। সস্তায় গ্যাস পেয়ে অনেকে ব্যবসা বাড়িয়েছেন। তিনি বলেন, আমরা জানি সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আইএমএফের চাপও রয়েছে। কিন্তু বিনিয়োগের খরচ বাড়লে কেউ বিনিয়োগে আসবে না।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ বলেছেন, গত ১৫ বছরে নতুন কূপ খননের জন্য তেমন কিছুই খরচ হয়নি। তৈরি হয়নি নতুন কোনো নীতিমালাও। যা দেশের গ্যাস সংকটের অন্যতম কারণ। অথচ এলএনজি আমদানির চেয়ে কম খরচে দেশে অনুসন্ধান করা সম্ভব ছিল। ২৬ তারিখে এ বিষয়ে শুনানি রয়েছে, সেখানে দাম বৃদ্ধির বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।