Logo
Logo
×

জাতীয়

ফ্যাসিস্ট আমলে নিয়োগ পাওয়া অনেক পুলিশ সদস্য এখনো অপতৎপরতায় লিপ্ত

ইকবাল হাসান ফরিদ

ইকবাল হাসান ফরিদ

প্রকাশ: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৭:৫৩ এএম

ফ্যাসিস্ট আমলে নিয়োগ পাওয়া অনেক পুলিশ সদস্য এখনো অপতৎপরতায় লিপ্ত

প্রতীকী ছবি

প্রতিদিনই সারা দেশে বিভিন্ন অপরাধ বাড়ছে। তবে এত পুলিশ থাকার পরও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কেন এত অবনতি হচ্ছে-সেটি নিয়ে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ আর প্রশ্নের শেষ নেই।

বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন, পেশাদার পুলিশিং হচ্ছে না বলেই এমনটি হচ্ছে। বিশেষ করে পুলিশ বাহিনীতে ঘাপটি মেরে থাকা গণ-অভ্যুত্থানবিরোধী পুলিশ সদস্যদের গাফিলতির কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। তাদের মতে, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে এ বাহিনীতে নিয়োগের সময় একেবারে বেছে বেছে আওয়ামীপন্থিদের চাকরি দেওয়া হয়েছে। এ কারণে চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার ওপর সেসব দলীয় পুলিশ সদস্যের ভয়ঙ্কর রূপ দেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে। এ কারণে পুলিশ বাহিনীর বর্তমান আইজিসহ পুলিশের একটি অংশ শত চেষ্টা করেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছেন না। মূলত তৃতীয় পক্ষের ষড়যন্ত্রের কারণে পুলিশের অনেক সদস্য কৌশলে নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। কেউ অফিশিয়ালি বিষয়টি স্বীকার না করলেও এটিই বাস্তবতা।

সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, অপরাধীরা এখন যতটা সক্রিয়, পুলিশ ততটা নিষ্ক্রিয়। পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে অপরাধপ্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। তারা বলছেন, পুলিশ কেন সক্রিয় হতে পারছে না, তা পুলিশকেই পরিষ্কার করে বলতে হবে। তাদের কোনো যৌক্তিক সমস্যা থাকলে তা সমাধান করে জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই হবে।

সাবেক আইজিপি নূরুল হুদা যুগান্তরকে বলেন, ‘পুলিশের ওপর দিয়ে বড় একটা ধকল গেছে। যেটা এখনো তারা কাটিয়ে উঠতে পারছে না। তবে বাহিনীতে নানা কারণে কিছু লোকজন নিষ্ক্রিয় থাকতে পারে। তাদের খুঁজে বের করে ব্যবস্থা নেবেন ঊর্ধ্বতনরা।’ অপরাধ বাড়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দেশে জিনিসপত্রের দাম লাগামহীন। মানুষ অনেকটা অভাবের মধ্যে আছে। এই কারণে অনেকেই অপরাধে জড়াচ্ছে।

চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে গত বছর ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটলে ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর হিসাবে চিহ্নিত পুলিশের অনেক শীর্ষ কর্মকর্তাসহ কয়েকশ পুলিশ পালিয়ে যায়। ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পক্ষে ন্যক্কারজনকভাবে ভূমিকা রাখায় সঙ্গত কারণে দেশজুড়ে পুলিশও ছাত্র-জনতার রোষানলে পড়ে। পুলিশের অনেক স্থাপনা ও যানবাহন আক্রান্ত হয়। ওই পরিস্থিতিতে কার্যত দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়ে। তবে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে নানামুখী প্রচেষ্টা এখনো অব্যাহত আছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির জন্য পুলিশকে সহায়তা করতে শুরু থেকে সেনাবাহিনীর সদস্যরা মাঠে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন। অপরাধী ধরতে চলছে যৌথবাহিনীর অভিযান, অপারেশন ডেভিল হান্ট, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি মনিটরিংয়ে পুলিশ সদর দপ্তরে চালু করা হয়েছে সেন্ট্রাল কমান্ড সেন্টার। এছাড়া নানান উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী খোদা বকশ চৌধুরী এবং পুলিশের আইজি বাহারুল আলমসহ গণ-অভ্যুত্থানের চেতনায় উজ্জীবিত পুলিশের অনেক চৌকশ কর্মকর্তা রাত-দিন পরিশ্রম করছেন। কিন্তু রহস্যজনক কারণে পরিস্থিতি উন্নতি হওয়ার লক্ষণ নেই।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, এমন পরিস্থিতির নেপথ্য কারণ পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা। ফ্যাসিস্ট আমলে নিয়োগ পাওয়াদের একটি বড় অংশ পুলিশ বাহিনীতে রয়েছে। এছাড়া ওই সময়ে সুবিধাভোগীদেরও একটি অংশ এখন ছদ্মবেশে সক্রিয়। সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ ও শহিদুল হকের সময়ে নিয়োগ ও পদোন্নতি পাওয়া অনেক পুলিশ সদস্য এখনো নানা অপতৎপরতায় লিপ্ত। যে কারণে শত প্রচেষ্টায়ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না।

পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যানে জানা গেছে, গত জানুয়ারি মাসে সারা দেশে ৭১টি ডাকাতি, ১৭১টি ছিনতাই, ২৯৪টি খুন, ১০৫টি অপহরণের ঘটনায় মামলা হয়েছে। এই মাসে রাজধানীতে ৮টি ডাকাতি, ৫৪টি ছিনতাই, ৩৬টি খুন এবং ৩১টি অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া ২০২৪ সালে সারা দেশে ৪৯০টি ডাকাতি, ১৪১২টি ছিনতাই, ৩৪৩২টি খুন এবং ৬৪২টি অপহরণের ঘটনা ঘটে। গত এক বছরে ডিএমপিতে ৪১টি ডাকাতি, ২৪৮টি ছিনতাই, ৩৩৯টি খুন ও ১৩২টি অপহরণের মামলা রেকর্ড হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অপরাধের মাত্রা মূলত পরিসংখ্যানের কয়েকগুণ বেশি।

অপরাধ বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক যুগান্তরকে বলেন, অপরাধীদের দৌরাত্ম্য যতটা বাড়ছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা এর চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে। যে কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। তিনি বলেন, কাগজে-কলমে পুলিশি তৎপরতা থাকলেও মূলত সক্রিয় নয় পুলিশ। এখনো আগের মতোই চলছে পুলিশি তৎপরতা। ঘুস বাণিজ্য, মামলায় হয়রানিসহ নানা অপতৎপরতার অভিযোগ রয়েছে পুলিশের বিরুদ্ধে। তিনি বলেন, পুলিশের দুর্বলতা কোথায় তা পুলিশকেই চিহ্নিত করে প্রকাশ করতে হবে। তারা যদি নিরাপত্তা নিশ্চিত না করতে পারে, তাও জনগণকে জানিয়ে দিতে হবে। অপারেশন ডেভিল হান্ট সম্পর্কে তিনি বলেন, কোনো দল-মত নয়, অপরাধী যেই হোক তাকে আইনের আওতায় আনতে পারলে এই অভিযানের সফলতা আসবে। তিনি বলেন, গ্যাংভিত্তিক বড় বড় সন্ত্রাসী-অপরাধী জামিনে বেরিয়ে গিয়ে তারাও নিজের গ্রুপ বা দল বড় করছে, প্রভাব বাড়াচ্ছে। এসব গ্যাংলিডারের গ্রুপে উঠতি সন্ত্রাসী বা ছিনতাইকারী-ডাকাতরাও যুক্ত হচ্ছে। এ বিষয়গুলোতে বাড়তি নজর দিতে হবে।

হাইওয়ে পুলিশের প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মো. দেলোয়ার হোসেন মিঞা শুক্রবার রাতে যুগান্তরকে বলেন, মহাসড়কে যানবাহনে ডাকাতি রুখতে আমরা বেশ কয়েকটি উদ্যোগ নিয়েছি। দূরপাল্লার কোনো গাড়ি পথে থামিয়ে যাত্রী উঠাতে পারবে না। এছাড়া প্রত্যেক গাড়িতে যাত্রীদের উঠানোর সময় বাধ্যতামূলক ভিডিও করতে হবে। দূরপাল্লার কোনো গাড়ি সার্ভিস লেন দিয়ে চলাচল করলেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, ‘আমাদের সীমিত জনবল। তাই মহাসড়কের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমরা জেলা পুলিশের সঙ্গে সমন্বয় করে টহল বাড়িয়েছি।’

অপরাধ বেড়ে যাওয়ার নেপথ্যে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, নানা কারণে পুলিশের একশ্রেণির সদস্যের মধ্যে পেশাদারিত্বের চরম ঘাটতি রয়েছে। গণঅভ্যুত্থানের আগে পুলিশের অনেক সদস্যকে দলীয় ক্যাডারের মতো মনে হতো। ওইসব পুলিশ সদস্য নানা অপরাধবোধ থেকে এখন নৈতিকভাবে খুবই দুর্বল। তারা সত্যিকার পুলিশিং শক্তি দেখাতে পারছে না। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার কারণে অনেকেই মামলা ও গ্রেফতার আতঙ্কে আছেন। আবার কেউ কেউ এ সরকারকে ব্যর্থ করতে ইচ্ছে করে নিজেদের গুটিয়ে রেখেছে।

মূলত এসব কারণে পেশাদার অপরাধীদের মাঝে এখন পুলিশ ভীতি কম এবং দিন দিন এরা বেপরোয়া হচ্ছে। এছাড়া ডিউটি কিংবা সাধারণ অভিযানে যেসব অস্ত্র পুলিশ সঙ্গে রাখছে, সেগুলো মারণাস্ত্র নয়। এর ফলে অপরাধীদের মাঝে এক ধরনের স্বস্তি রয়েছে। তাছাড়া অপরাধীরা সংঘবদ্ধভাবে তৎপরতা চালাচ্ছে। এলাকাভিত্তিক গড়ে উঠেছে গ্যাং। অনেক দাগী অপরাধী জামিনে বেরিয়ে এসে ফের অপরাধ তৎপরতা চালাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার পরিবর্তনের পর থেকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহল কমে যাওয়ায় অপরাধীরা বেশি সক্রিয় হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে রাতে বের হয়ে কারও কারও জীবন বিপন্ন হচ্ছে। পাড়ায়-মহল্লায় গণছিনতাইয়ে নামছে কিশোর গ্যাং। তারা ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে সাধারণ মানুষের সর্বস্ব লুটে নিচ্ছে।

সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘটে যাওয়া কয়েকটি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, ছিনতাই ও ডাকাতির বর্ণনা দিলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার ভয়াবহতা আরও স্পষ্ট হবে।

চলন্ত বাসে ডাকাতি, নারীর শ্লীলতাহানি : গত ১৭ ফেব্রুয়ারি রাত ১০টার দিকে গাবতলী থেকে রাজশাহীর উদ্দেশে ছেড়ে যায় ইউনিক রোড রয়েলস পরিবহণের একটি বাস। গাজীপুরের চন্দ্রা থেকে ওই বাসে ওঠে আরও কয়েকজন যাত্রী। কিছুক্ষণ পর সেই গাড়ির নিয়ন্ত্রণ নেয় যাত্রীবেশে থাকা ডাকাতদল। প্রায় তিন ঘণ্টা বাসটিতে তাণ্ডব চালায় ডাকাতদল। তারা যাত্রীদের সর্বস্ব লুটে নেয়। পাশাপাশি দুই নারী যাত্রীকে শ্লীলতাহানিও করে। এ ঘটনার তিন দিন পর ২১ ফেব্রুয়ারি ভোরে মামলা হয়েছে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর থানায়। মামলায় আসামি করা হয়েছে অজ্ঞাতনামা ৮-১০ জনকে। মামলাটি দায়ের করেছেন নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার বাসযাত্রী ওমর আলী।

পুলিশ সদর দপ্তরের এএআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর যুগান্তরকে বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে আমাদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। প্রতিনিয়ত অপরাধী গ্রেফতারে নতুন নতুন কৌশলে অভিযান অব্যাহত আছে।’ তিনি বলেন, সাধারণ নাগরিকরাও যাতে তথ্য দিয়ে পুলিশকে সহযোগিতা করে সেই আহ্বান জানাচ্ছি।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম