উচ্চ আদালতে বিচার কার্যক্রম
২৬ বছরে অর্ধলক্ষের ওপরে বাংলায় রায়-আদেশ

আলমগীর মিয়া
প্রকাশ: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১০:১৩ এএম

ফাইল ছবি
উচ্চ আদালতে রায় ও আদেশ লেখায় বাংলা ভাষার ব্যবহার বাড়ছে। চলতি ফেব্রুয়ারিতেই চাঞ্চল্যকর একটি মামলার রায় বাংলায় দিয়েছেন হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ। বিচারপতি মুহাম্মদ মাহবুব-উল ইসলাম ও বিচারপতি মো. হামিদুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ গত ৫ ফেব্রুয়ারি এ রায় দেন।
পাবনার ঈশ্বরদীতে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনাকে বহনকারী ট্রেনে গুলি ও বোমা হামলার অভিযোগে করা মামলায় আসামিদের ডেথ রেফারেন্স, আপিল ও জেল আপিলের ওপর বাংলায় এ রায় আসে। বাংলায় রায়ের পর্যবেক্ষণ ও সিদ্ধান্ত অংশটুকু আদালত ঘোষণা করেন। জানতে চাইলে ওই বেঞ্চের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ মুজিবুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, মূলত মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসার টানে আদালত বাংলায় রায় দিয়েছেন। প্রসঙ্গত, ২০০৭ সাল থেকে হাইকোর্ট বিভাগে দেওয়ানি, ফৌজদারি ও রিট মামলায় কয়েকটি রায় বাংলায় দেওয়া হয়।
জানা যায়, চলতি ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে হাইকোর্ট বিভাগ থেকে অর্ধশত রায় ও আদেশ বাংলায় এসেছে। এছাড়া হাইকোর্টের দুজন বিচারপতি নিয়মিত বাংলায় রায় ও আদেশ দিয়ে যাচ্ছেন। একজন বিচারপতিই এ পর্যন্ত প্রায় ৩০ হাজার রায় ও আদেশ লিখেছেন বাংলায়। সব মিলে ২৬ বছরে অর্ধলক্ষের ওপরে রায় ও আদেশ লেখা হয়েছে বাংলা ভাষায়। উচ্চ আদালতে আবেদনও বাংলায় করা যাচ্ছে। ফলে বিচারপ্রার্থী সাধারণ মানুষ স্বস্তিবোধ করছে। উচ্চ আদালতে বাংলায় রায়-আদেশের সংখ্যা বাড়ায় বিচারপ্রার্থীদের বিড়ম্বনা কমেছে বলে মনে করেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার অনীক আর হক। তিনি যুগান্তরকে বলেন, বিচারপ্রার্থীদের কথা চিন্তা করে আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার আরও বাড়ানো উচিত। ইংরেজিতে রায় বা আদেশ হলে সেটা বুঝতে বিচারপ্রার্থীর অন্যের সহযোগিতা নিতে হয়। সেই বিবেচনায় ইংরেজির পাশাপাশি বাংলায় রায়-আদেশ দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন সুপ্রিমকোর্ট। সূত্র জানায়, বছর দশেক আগেও বাংলায় রায়-আদেশ দেওয়ার সংখ্যা ছিল হাতেগোনা। এখন বাড়ছে। বাংলা ভাষার ব্যবহার আরও বাড়ানোর সুযোগ আছে বলে মনে করেন তারা। ১৯৯৯ সালে উচ্চ আদালতের কয়েকজন বিচারক বাংলায় রায় লেখার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ২০০৭ সাল থেকে হাইকোর্ট বিভাগে দেওয়ানি, ফৌজদারি ও রিট মামলায় কয়েকটি রায় বাংলায় দেওয়া হয়। সাবেক প্রধান বিচারপতি অবসরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত প্রায় ২০০ রায় বাংলা ভাষায় লিখেছিলেন।
আপিল বিভাগের সাবেক জ্যেষ্ঠ বিচারপতি ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি অনেক রায়, আদেশ ও নির্দেশ বাংলায় দিয়েছেন। ১৫ হাজারের বেশি রায় বা আদেশ বাংলায় দিয়েছেন তারা।
২০২২ সালে ভাষার মাসে বাংলায় রায় ও আদেশ দেওয়া শুরু করেন বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিমের হাইকোর্ট বেঞ্চ। ওই বছর ভাষার মাসে তিনি বিভিন্ন মামলায় ১১৭৫টি রায় এবং ৬৩৭টি আদেশ বাংলায় দিয়েছেন। এ বেঞ্চ আলোচিত গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা মামলার রায়ও দিয়েছেন বাংলায়। হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন যোগদানের পর নিয়মিত বাংলায় রায় ও আদেশ দিয়ে যাচ্ছেন। এ পর্যন্ত ৩০ হাজারের বেশি মামলার রায় ও আদেশ বাংলায় দিয়েছেন এ বিচারপতি। তিনি বলেন, ২০১০ সালের ২২ এপ্রিল থেকে বাংলায় রায়-আদেশ দিয়ে যাচ্ছি। আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার আরও বাড়ানোর সুযোগ আছে বলে মনে করেন তিনি। বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেনের উল্লেখযোগ্য বাংলায় রায়ের মধ্যে আছে চাঁদপুরের আলোচিত লঞ্চডুবি এবং বাংলাদেশ হাউজবিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনের লোন সংক্রান্ত একটি মামলা। ২০২২ সালে আলোচিত পিলখানা হত্যা মামলায় ২৯ হাজার ৫৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ পায়। দেশের ইতিহাসে এ মামলার আসামির সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। আর রায়ের পৃষ্ঠার সংখ্যার দিক থেকেও এটি সবচেয়ে বড় রায়। সেই রায়ের ১৬ হাজার ৫৫২ পৃষ্ঠা বাংলায় লিখে আলোচনায় আসেন তৎকালীন বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী। ওই রায়ের অনুলিপি সংরক্ষণের জন্য বাংলা একাডেমিতে হস্তান্তর করে সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন। হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল নিয়মিত বাংলায় রায় লিখে যাচ্ছেন।
এর আগে বাংলায় রায় লিখেছেন বিচারপতি মুহম্মদ হাবিবুর রহমান, বিচারপতি কাজী এবাদুল হক, বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক, বিচারপতি হামিদুল হক, বিচারপতি এআরএস আমিরুল ইসলাম চৌধুরী, বিচারপতি একে বদরুল হক, বিচারপতি ফজলুল করিম, বিচারপতি মোয়াজ্জেম হোসেন, বিচারপতি মো. আবদুল কুদ্দুস, বিচারপতি এসএম জিয়াউল করিম, বিচারপতি মো. জয়নুল আবেদিন, বিচারপতি মো. হাসান আমীম, বিচারপতি মো. মমতাজ উদ্দিন প্রমুখ। সুপ্রিমকোর্টে প্রায় ১০ হাজার আইনজীবীর মধ্যে মাত্র দুজন মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম ও আবু ইয়াহিয়া দুলাল উচ্চ আদালতে বাংলায় মামলা দায়ের ও শুনানি করছেন। যদিও তারা আদালতের রায় বা আদেশের কপি পান ইংরেজিতে।
এদিকে গত বছর ভাষার মাসের প্রথম দিনে ভাষাশহিদদের প্রতি সম্মান জানিয়ে বাংলা ভাষায় রায় ও আদেশ দিয়েছেন হাইকোর্টের দুটি বেঞ্চ। বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুরের একক হাইকোর্ট বেঞ্চ ওইদিন একটি মামলায় (সিভিল রিভিশন) বাংলায় রায় ঘোষণা করেন। একই দিন বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মো. আতাবুল্লাহর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ দুটি মামলায় বাংলা ভাষায় রায় দিয়েছেন। ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্ত এবং একটি বহুমুখী সমিতির নির্বাচন নিয়ে করা রিটের ওপর রায় দিয়েছেন আদালত। এছাড়া কয়েকটি মামলায় আদেশও বাংলায় দিয়েছেন।
সব ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রচলন বিষয়ে বেতার ও টেলিভিশনে বাংলা ভাষার বিকৃত উচ্চারণ এবং দূষণ রোধে হাইকোর্টের রুলসহ নির্দেশনা রয়েছে। দুটি নির্দেশনাই এসেছে ফেব্রুয়ারি মাসে। একটি ২০১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি, অন্যটি ২০১৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি। একটির ক্ষেত্রে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে, অন্যটিতে রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলায় আদেশ দেন হাইকোর্টের দুটি বেঞ্চ। সুপ্রিমকোর্ট সূত্র জানায়, ইংরেজিতে দেওয়া আদালতের রায়গুলো সহজে বাংলায় অনুবাদ করার জন্য ২০২১ সালে ‘আমার ভাষা’ নামে একটি সফটওয়্যারের উদ্বোধন করা হয়। ভাষাশহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে গত বছরের ১ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিমকোর্টের ওয়েবসাইটের ‘বাংলা সংস্করণ’ উদ্বোধন করা হয়।
জানতে চাইলে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের গণসংযোগ কর্মকর্তা মো. শফিকুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ‘আমার ভাষা’ সফটওয়্যার ব্যবহার করে সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের ইংরেজিতে দেওয়া রায় বাংলায় অনুবাদ করা হচ্ছে। জনসাধারণের জন্য প্রচার করা হচ্ছে ওয়েবসাইটে। এ পর্যন্ত হাইকোর্টে বিভাগের ৩৪টি এবং আপিল বিভাগের ১১টি রায় ওয়েবসাইটে বাংলায় আপ করা হয়েছে।
সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও বার কাউন্সিলের সদস্য শাহ মো. খসরুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, ভাষাশহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বিচার বিভাগের সব ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা প্রচলনের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা জরুরি।