পিলখানা হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে তদন্ত কমিশন
হাসিনা-মইনসহ পলাতকদের জিজ্ঞাসাবাদই বড় চ্যালেঞ্জ

বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৮:৪৪ পিএম

ইতিহাসের নৃশংসতম পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বিস্তারিত জানতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) মইন ইউ আহমেদসহ পলাতক অনেককে জিজ্ঞাসাবাদ করা খুবই প্রয়োজন। কিন্তু তাদের সহজেই পাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর দূতাবাস বা হাইকমিশনের সহায়তা চাওয়া হয়েছে। পলাতকদের জিজ্ঞাসাবাদ করাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।
বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ রেফারেন্স ইনস্টিটিউট ফর কেমিক্যাল মেজারমেন্টসে (বিআরআইসিএম) এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান পিলখানা হত্যাকাণ্ডসংক্রান্ত জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনের সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) আ ল ম ফজলুর রহমান।
তিনি বলেন, তদন্ত কাজের অংশ হিসাবে সেনা আইন ভঙ্গের বিষয়টি নিয়ে পর্যালোচনা করছে কমিশন। হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য এ পর্যন্ত ৩৭ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়েছে। পাশাপাশি দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের বিষয়টি জোরালোভাবে খতিয়ে দেখছেন তারা।
২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় ইতিহাসের অন্যতম হত্যাকাণ্ডে শহিদ হন ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন। ঘটনার ১৫ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর এখন পুনরায় তদন্তের দাবি আসছে বিভিন্ন তরফ থেকে। ২৪ ডিসেম্বর অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আ ল ম ফজলুর রহমানকে প্রধান করে বিডিআর হত্যাকাণ্ড তদন্তে ‘জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন’ গঠন করে সরকার। সাত সদস্যের এ কমিশনকে ৯০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের সময় বেঁধে দেওয়া হয়। ৬০ দিনের বেশি অতিবাহিত হলেও তদন্তের তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি নেই। এ কারণে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তদন্ত কাজ শেষ নাও হতে পারে বলে জানিয়েছেন তদন্ত কমিশনের প্রধান আ ল ম ফজলুর রহমান।
তদন্তের অগ্রগতির বিষয়ে কমিশন প্রধান জানান, সহযোগিতা চেয়ে বেশ কয়েকটি দূতাবাসে চিঠি দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি কয়েকজন যেন দেশের বাইরে যেতে না পারে সেজন্য ওইসব ব্যক্তির তথ্য দেওয়া হয়েছে সরকারকে। আর এখন পর্যন্ত সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে ৩৭ জনের। এর মধ্যে তিনজন লেফটেন্যান্ট জেনারেল, দুজন মেজর জেনারেল, পাঁচজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ও পাঁচজন কর্নেল রয়েছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই অবসরে চলে গেছেন। সবশেষ বুধবার বিডিআরের তৎকালীন মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদের ছেলে সাক্ষ্য দিয়ে গেছেন। তিনি বলেন, বিডিআর হত্যাকাণ্ডে সংশ্লিষ্ট অনেকেই দেশ থেকে পালিয়ে গেছেন, তাদের ফিরিয়ে আনতে কিছু বিদেশি দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। তদন্তের স্বার্থে আমাদের আরও অনেকের সঙ্গে কথা বলা প্রয়োজন। এজন্য ইতোমধ্যে বিভিন্ন ব্যক্তির ওপর বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা দিতে কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। কিছু বিদেশি দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
কার কার বিরুদ্ধে বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হচ্ছে, তাদের সংখ্যাই বা কত- এ বিষয়ে প্রশ্নের জবাব দেননি ফজলুর রহমান। তিনি বলেন, তদন্তের স্বার্থে তাদের নাম বলতে পারছি না। কমিশন প্রধান বলেন ১৬ বছরের পুরোনো ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন কিছুটা জটিল হলেও তারা সত্য উদ্ঘাটনে বদ্ধপরিকর। তবে সেক্ষেত্রে কমিশনের জন্য বেঁধে দেওয়া ৯০ দিনের চেয়ে একটু বাড়তি সময় প্রয়োজন হতে পারে।
কমিশনের প্রধান ও বিডিআরের (বর্তমান বিজিবি) সাবেক মহাপরিচালক আ ল ম ফজলুর রহমান আরও জানান, কমিশন পাঁচটি কর্মপরিধি ঠিক করেছে। এর মধ্যে আছে পিলখানায় সংঘটিত ঘটনার স্বরূপ উদ্ঘাটন। এছাড়া ঘটনাকালে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড ও অন্যান্য অপরাধ সংঘটনকারী, সহায়তাকারী, ষড়যন্ত্রকারী, ঘটনার আলামত ধ্বংসকারী, ইন্ধনদাতা এবং ঘটনাসংশ্লিষ্ট অপরাপর বিষয়সহ দেশি ও বিদেশি সংশ্লিষ্ট অপরাধী ব্যক্তি/গোষ্ঠী/সংস্থা/প্রতিষ্ঠান/বিভাগ/সংগঠন ইত্যাদি চিহ্নিতকরণ বিষয় রয়েছে। হত্যাকাণ্ডসহ সংঘটিত অপরাপর অপরাধ প্রতিরোধে ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থতার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করছি। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় করা মামলা এবং সংশ্লিষ্ট মামলায় অভিযুক্তদের দায়/অপরাধ অক্ষুণ্ন রেখে সংশ্লিষ্ট মামলায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, এমন প্রকৃত অপরাধীদের তদন্ত প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে।
তদন্তের চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে ফজলুর রহমান বলেন, এরই মধ্যে অনেক সাক্ষী এবং ঘটনার সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্ট অনেক ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করেছেন, পলাতক আছেন এবং বিদেশে পালিয়ে আছেন কিংবা বিদেশে অবস্থান করছেন। তাদের সাক্ষ্যগ্রহণ কঠিন হয়ে পড়বে বা বিলম্বিত হবে এবং অনেক ক্ষেত্রে অসম্ভব হয়ে পড়বে, এমন ধারণা করা যায়। এ ছাড়া সময়ের বিবর্তনে অনেক সাক্ষীর পক্ষে সঠিক তারিখ, সময় ও ঘটনার অনেক বিষয় স্মরণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, তদন্তের ক্ষেত্রে বেঁচে ফিরে আসা ব্যক্তি; সামরিক বাহিনী; র্যাব ও পুলিশের দায়িত্বশীল ব্যক্তি; ডিজিএফআই; এনএসআই; হুকুমদাতা; সামরিক অপারেশনে বাধাদানকারী; সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়; রাজনৈতিকসংশ্লিষ্টতা; বিদেশিসংশ্লিষ্টতা এবং একই সঙ্গে সেনা আইন ভঙ্গের বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে পর্যালোচনা করছে কমিশন।