উত্তরায় দম্পতিকে কোপানোর ঘটনায় গ্রেফতার ৫ জন রিমান্ডে

যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১০:৪৬ পিএম

রাজধানীর উত্তরায় প্রকাশ্যে দম্পতিকে কোপানোর হোতা মেহেদী হাসান সাইফ (২৪) যুবলীগ কর্মী। তিনি স্থানীয় একটি কিশোর গ্যাংয়েরও প্রধান। এরই মধ্যে সাইফসহ পাঁচজনকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ। গ্রেফতার অন্যরা হলেন মো. মোবারক হোসেন (২৫), রবি রায় (২২), মো. আলফাজ মিয়া ওরফে শিশির (২২) ও সজীব (২০)। তাদের কাছ থেকে হামলায় ব্যবহৃত দুটি রামদা উদ্ধার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশের কাছে কোপানোর কথা স্বীকার করেছেন তারা। পাশাপাশি নিজেদের অপকর্মের বিষয়ে নানা তথ্য দিয়েছেন। আরও তথ্য পেতে তাদের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, গ্রেফতার সাইফ ও সজীব সহোদর। আব্দুল্লাহপুর খানবাড়িতে ভাড়া থাকেন তারা। ওই এলাকায় বেপরোয়া চলাফেরা করেন। ছোটবেলা থেকেই উগ্র স্বভাবের সাইফ উত্তরা ৯ নম্বর সেক্টরের যুবলীগ নেতা সোহেল ও মনিরুজ্জামানের অনুসারী। যুবলীগের মিটিং-মিছিলে নিয়মিত অংশ নিতেন। এছাড়া তার একটি কিশোর গ্যাং রয়েছে। উত্তরা এলাকায় প্রভাব বিস্তারে তারা নানা অপকর্মে জড়িত।
পুলিশ জানায়, সোমবার রাতে উত্তরা ৭ নম্বর সেক্টরে মেহেবুল হাসান (৩৭) ও নাসরিন আক্তার ইপ্তিকে (২৮) কোপানোর হোতা সাইফ। তার সঙ্গে রামদা হাতে অংশ নেয় আলফাজ ওরফে শিশির।
বুধবার ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) রওনক জাহান বলেন, সোমবার রাত ৯টা ১৫ মিনিটে সংবাদ পাওয়া যায় ৭নং সেক্টরের ৯নং রোডের বাসার সামনে অজ্ঞাতনামা কয়েকজন অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী এক দম্পতিকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি কোপাচ্ছে। এ সংবাদে পুলিশের একটি টহল টিম তাৎক্ষণিক ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে জনগণের সহায়তায় ঘটনায় জড়িত মো. মোবারক হোসেন ও রবি রায়কে গ্রেফতার করে। পরে ভিকটিম নাসরিন আক্তার ইপ্তি বাদী হয়ে উত্তরা পশ্চিম থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা করেন। এ মামলায় মঙ্গলবার বিকালে আব্দুল্লাহপুর পশ্চিমপাড়া থেকে আলফাজ মিয়া ওরফে শিশিরকে গ্রেফতার করা হয়।
ডিসি বলেন, পরে আলফাজের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বুধবার রাত ২টার দিকে গাজীপুরের কোনাবাড়ী থেকে সজীবকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের দেওয়া তথ্যে ভিকটিমদের এলোপাতাড়ি কুপিয়ে আহত করা অপর এক আসামি মেহেদী হাসান সাঈফকে টঙ্গীর মাজার বস্তি থেকে বৃহস্পতিবার ভোরে গ্রেফতার করা হয়। তার কাছ থেকে ঘটনায় ব্যবহƒত একটি মোটরসাইকেল এবং ঘটনার সময় তার পরিহিত শার্ট জব্দ করা হয়। এছাড়া বুধবার সকালে আলফাজ মিয়া ওরফে শিশির ও মেহেদী হাসান সাইফের দেওয়া তথ্যে তুরাগ নদীর পাড় থেকে হামলায় ব্যবহƒত দুটি রামদা উদ্ধার করা হয়।
উত্তরা পশ্চিম থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. হাফিজুর রহমান বলেন, আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে তারা নদীতে ধারালো অস্ত্রগুলো ফেলেছে। এ তথ্যের ভিত্তিতে আমরা স্থানটিতে অভিযান চালিয়ে রামদা উদ্ধার করেছি। ঘটনার সময় ব্যবহƒত তাদের মোটরসাইকেলও জব্দ করা হয়েছে।
এদিকে গ্রেফতার কিশোর গ্যাং নেতা মেহেদী হাসান সাইফসহ ওই গ্যাংয়ের তিনজনকে বুধবার তিন দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছেন আদালত। অন্যরা হলেন মো. আলফাজ মিয়া ওরফে শিশির ও সজীব। ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট শাহিন রেজার আদালত শুনানি শেষে রিমান্ডের এই আদেশ দেন। এর আগে এ মামলায় মঙ্গলবার মোবারক হোসেন ও রবি রায়ের দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।
যেভাবে হামলা চালানো হয় : মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, সোমবার রাত আনুমানিক ৯টায় মেহেবুল হাসান ও নাসরিন আক্তার ইপ্তি দম্পতি উত্তরা পশ্চিম থানাধীন আমির কমপ্লেক্স থেকে কেনাকাটা করে বাসায় ফিরছিলেন। এ সময় উত্তরা পশ্চিম থানাধীন ৭নং সেক্টরের ৯নং রোডের বাসা নং ১০-এর সামনে তিন ব্যক্তি দুটি মোটরসাইকেল নিয়ে বিকট শব্দ করে দ্রুতগতিতে এলোমেলোভাবে যাচ্ছিল। এ সময় একটি মোটরসাইকেল সামনে থাকা একটি রিকশাকে ধাক্কা দেয়। ওই রিকশায় চার বছরের একটি শিশু তার মায়ের সঙ্গে ছিল। শিশুটির বাবা রিকশা থেকে নেমে মোটরসাইকেলচালক গ্রেফতার আসামি মো. মোবারক হোসেনের সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডা শুরু করেন। ওই সময় রিকশার পেছনে থাকা ভিকটিম দম্পতি তাদের ঝামেলা করতে নিষেধ করে। এরই মধ্যে রিকশার যাত্রীরা চলে যান।
এ ঘটনায় মোটরসাইকেলে থাকা তিনজন মেহেবুল হাসানের সঙ্গে তর্ক শুরু করে এবং একপর্যায়ে তাকে মারধর শুরু করে। এ সময় তারা বলতে থাকে ‘আমাদের চিনিস? আমরা কে?’ সে সময় ভিকটিম দম্পতি আশপাশের লোকজনের সহযোগিতায় আক্রমণকারী একজনকে ধরে ফেলে এবং তার মোটরসাইকেল জব্দ করে। এ সময় ফোন করে সে তার আরও কয়েকজন সহযোগীকে ডেকে নিয়ে আসে। তারা দেশীয় অস্ত্র রামদাসহ ঘটনাস্থলে এসে উপস্থিত জনসাধারণের মধ্যে ভীতি সৃষ্টি করে। একপর্যায়ে রামদা দিয়ে মেহেবুল হাসানকে এলোপাতাড়ি আঘাত করতে থাকে।
হামলার সময় নাসরিন আক্তার ইপ্তি তার স্বামীকে বাঁচানোর জন্য চেষ্টা করলে সন্ত্রাসীরা তাকেও রামদা দিয়ে আঘাত করে। এতে তাদের শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত হয়। খবর পেয়ে উত্তরা পশ্চিম থানা পুলিশের টহল টিম ঘটনাস্থলে গিয়ে মোবারক হোসেন ও রবি রায়কে গ্রেফতার করে। পুলিশ আহত দম্পতিকে উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিয়ে যায়।
ভুক্তভোগীরা ‘স্বামী-স্ত্রী’ নন : হামলার শিকার ওই পুরুষ ও নারী স্বামী-স্ত্রী নন বলে দাবি করেছেন অপর এক নারী শম্পা বেগম। বুধবার তিনি এ বিষয়ে সাংবাদিকদের বলেন, উত্তরায় হামলার শিকার মেহেবুল হাসান আমার স্বামী। পাশে থাকা ওই নারীকে আমি চিনি না। তবে এ ঘটনায় থানায় করা মামলার এজাহারে হামলার শিকার হওয়া দুজনকে স্বামী-স্ত্রী হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। মামলার বাদী হয়েছেন ভুক্তভোগী নারী নাসরিন আক্তার ইপ্তি। এ বিষয়ে তার মন্তব্য জানতে বুধবার সন্ধ্যায় কয়েকবার ফোন করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
শম্পা বেগম বলেন, আমার স্বামী হয়তো গোপনে ওই নারীর সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। ওই নারীর সঙ্গে বিয়ে হয়নি। তবে ওই ঘটনার পর থেকে তারা নিজেদের স্বামী-স্ত্রী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছেন। ওই ঘটনা যখন আমি ফেসবুকে দেখেছি, সঙ্গে সঙ্গে তাকে কল (ফোন) দিই। কিন্তু তিনি কোনো রেসপন্স করেননি। পরে হাসপাতালে গিয়ে তার সঙ্গে আমার কথা হয়। উনি আমাকে এ বিষয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে নিষেধ করেন।
সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় ওই নারী তার শ্বশুরের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। তিনি বলেন, আমার শ্বশুর-স্বামী সবাই আমাকে ভয় দেখাচ্ছে। আমার স্বামী আমাকে বলছে, সে সুস্থ হলে আমাকে দেখে নেবে।
শম্পা বলেন, ‘২০১৬ সালে মেহবুলের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। আমাদের দুটি সন্তান রয়েছে, বয়স ৫ ও ৪ বছর।’ ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টে কর্মরত মেহবুল ঘটনার দিন সকাল ১০টার দিকে বাসা থেকে বের হন জানিয়ে শম্পা বলেন, স্বামী বাইরে থাকলে আমি সাধারণত তার সঙ্গে যোগাযোগ করি না। হামলার বিষয়টি আমি সোশ্যাল মিডিয়ায় জানতে পারি।
এ বিষয়ে উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি মো. হাফিজুর রহমান বলেন, ভিকটিমরা স্বামী-স্ত্রী কি না, সেটি আমাদের তদন্তের মূল বিষয় না। তবে এজাহারে তারা নিজেদের স্বামী-স্ত্রী উল্লেখ করেছেন। এখন যেহেতু শম্পা বেগম নামে আরেকজন নারী মেহেবুল হাসানের স্ত্রী দাবি করছেন, আমরা বিষয়টি তদন্ত করে দেখছি। নাসরিন আক্তার ইপ্তিও ঘটনার সময় আহত হয়েছিলেন। তিনি যদি মেহেবুলের স্ত্রী নাও হয়ে থাকেন, তাহলে একজন ভিকটিম হিসাবেই তাকে বিবেচনা করা হবে।