‘আন্দোলন ক্লিয়ার করতে ১০ মিনিট লাগবে’ বলা সেই র্যাব কর্মকর্তার খোঁজে গোয়েন্দারা

যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৬:১৫ পিএম

অতিরিক্ত ডিআইজি মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন। ছবি: সংগৃহীত
জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান চলাকালে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী হটস্পটে ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে পরিচালিত ক্র্যাকডাউনে নেতৃত্ব দেন পুলিশের আলোচিত অতিরিক্ত ডিআইজি মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম
ফেসবুকে যাকে নিয়ে ট্রল হচ্ছে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় তিনি ছাত্র-জনতাকে উদ্দেশ
করে বলেন-আন্দোলন ক্লিয়ার করতে ১০ মিনিট লাগবে। একটি হত্যা মামলায় ফরিদ উদ্দিনকে ‘গণহত্যার
পাহারাদার’ বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
পুলিশ সূত্র
জানায়, ফরিদ উদ্দিন পলাতক রয়েছেন। তবে তাকে ধরতে গোয়েন্দাদের একটি টিম কাজ করছে। যদিও
যুগান্তরের কাছে পুলিশের এ কর্মকর্তা দাবি করেন, তিনি অসুস্থতাজনিত ছুটিতে আছেন।
বহুল আলোচিত
র্যাব কর্মকর্তা মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন বর্তমানে অতিরিক্ত ডিআইজি হিসাবে এপিবিএনের
পার্বত্য চট্টগ্রামে কর্মরত। তিনি পুলিশে এএসপি হিসাবে নিয়োগ পান ২০০৫ সালে। পতিত স্বৈরাচারী
সরকারের আমলে বিসিএস (পুলিশ) ২৪তম ব্যাচের এই কর্মকর্তা একাধিক প্রাইজ পোস্টিংয়ে কর্মরত
ছিলেন। র্যাব ১০-এর অধিনায়ক হিসাবে ২০২২ সাল থেকে দায়িত্ব পালন করেন। এর আগে ২০১৯
সাল থেকে টানা ৩ বছর ছিলেন সিলেটের পুলিশ সুপার (এসপি)। আগের ৩ বছর ছিলেন ডিএমপির ওয়ারী
বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি)। ওয়ারীতে ডিসি হিসাবে যোগদানের আগে ছিলেন মতিঝিল বিভাগের
অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি)। ডিএমপিতে পদায়নের আগে ছিলেন চট্টগ্রাম জেলার অতিরিক্ত
এসপি।
জুলাই-আগস্ট
বিপ্লবের সময় যাত্রাবাড়ী এলাকায় দেওয়া তার একটি বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল
হয়। ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তাকে বদলি করা হয় এপিবিএন পার্বত্য চট্টগ্রাম
এলাকায়। ইতোমধ্যে তার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি হত্যা মামলা হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের
উচ্চপর্যায়ের সূত্র যুগান্তরকে জানায়, চলতি মাসের শুরু থেকেই কর্মস্থলে অনুপস্থিত আছেন
মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন। যাত্রাবাড়ী এলাকায় আন্দোলন দমনে তার ভূমিকা ছিল খুবই অপেশাদার
ও গুরুত্বপূর্ণ। ২০২৪ সালের নির্বাচনের পর স্বৈরাচারের এই ‘দোসর’ পান বাংলাদেশ পুলিশ
(বিপিএম) পদক।
ফ্যাসিস্ট সরকারের
পক্ষে তার অবদান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। খিলগাঁও, রামপুরা এবং যাত্রাবাড়ী
থানায় তার বিরুদ্ধে চারটি হত্যা মামলা করা হয়েছে (যদিও খিলগাঁও ও রামপুরা র্যাব-৩
এর অধিভুক্ত এলাকা)। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে তার গভীর
ঘনিষ্ঠতার বিষয়টি পুলিশের সবাই জানতেন। সিলেটে থাকা অবস্থায় চোরাকারবারিদের সঙ্গেও
গড়ে তুলেছিলেন বিশেষ সখ্য।
দায়িত্বশীল
পুলিশ কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, বহুবিধ গুরুতর অপরাধের কারণে তাকে শাস্তির মুখোমুখি
হতেই হবে। যদিও ফরিদ উদ্দিন যুগান্তর প্রতিবেদকের কাছে সবই মিথ্যা এবং ষড়যন্ত্রমূলক
অভিযোগ বলে দাবি করেন। মঙ্গলবার তিনি যুগান্তরকে বলেন, অসুস্থতাজনিত কারণে ৮ ফেব্রুয়ারি
থেকে এক মাসের ছুটিতে আছেন।
ছাত্র-জনতার
আন্দোলনে সরকারদলীয় ক্যাডারের মতো ভূমিকা রাখার বিষয়ে ফরিদ উদ্দিন বলেন, এসব আন্দোলনে
ডিএমপি সব সময় মূল ভূমিকা পালন করে। র্যাব ছিল একটি সাপোর্টিং ফোর্স। আন্দোলনের শুরুতে
আমরা যাত্রাবাড়ী থানার সামনেই ছিলাম। সেখানে র্যাবের পক্ষ থেকে কোনো গুলি কিংবা মারণাস্ত্র
ব্যবহার করা হয়নি।
এক প্রশ্নের
জবাবে তিনি বলেন, ‘আমার যে বক্তব্য ভাইরাল হয়েছে, সেখানেও আমি বলেছি, ‘আমরা কোনো প্রাণহানি
চাই না। প্রাণহানি চাইলে এটা ক্লিয়ার করতে ১০ মিনিট সময় লাগবে। কিন্তু আমরা কোনো প্রাণহানি
করব না। প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করব না। আমরা চাই প্রাণহানি ছাড়াই সবাই ঘরে ফিরে
যাক। রাস্তা ক্লিয়ার হয়ে যাক।’ তবে যাত্রবাড়ীতে এত হতাহত কেন হলো জানতে চাইলে তিনি
বলেন, ‘আন্দোলনের সময় আমরা কয়েকটি সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ার শেল ব্যবহার করেছি। ভিডিও
ফুটেজে সব অ্যাকশন দেখা গেছে পুলিশের। র্যাবের কোনো অ্যাকশন ছিল না। শেষদিকে আমাদের
কোনো ফোর্স মোতায়েনও ছিল না। ১ থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত র্যাবের কোনো ডেপ্লয়মেন্ট বাইরে
ছিল না।’
যাত্রাবাড়ীতে
রিয়াজ মোর্শেদ অপু নামের এক যুবককে হত্যার অভিযোগে সম্প্রতি মামলা করেছেন যাত্রাবাড়ী
দক্ষিণ কুতুবখালির জনৈকা রুমা বেগম। ভিকটিম অপু তার ভাগিনা বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে।
মামলায় ফরিদ উদ্দিন ছাড়াও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
আসাদুজ্জামান খান কামালসহ ২৮৫ জনকে আসামি করা হয়। মামলার অভিযোগে ফরিদ উদ্দিনসহ ৪৫
জনের বিষয়ে বলা হয়েছে, ঘটনাস্থলের চারদিক পাহারায় ছিলেন তারা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা
যেন ভিকটিমকে রক্ষা করতে এগিয়ে না আসতে পারে সেজন্য এলোপাতাড়ি গুলি করতে থাকেন এবং
অস্ত্র উঁচু করে ভীতি প্রদর্শন করেন।
এদিকে অতিরিক্ত
ডিআইজি ফরিদ উদ্দিনকে এপিবিএনে পদায়নের পর ছাত্র আন্দোলনের সময় তার ব্যাপক নেতিবাচক
ভূমিকা সামনে আসতে থাকে। আন্দোলনের সময় ধারণ করা একটি ভিডিওতে ওই কর্মকর্তার বক্তব্য
ছিল, ‘এখানে সাধারণ শিক্ষার্থী নেই, সরকারবিরোধী লোকজন জড়ো হয়েছে।’ ওই সময় তিনি আরও
বলেন, ‘আমরা যদি প্রাণহানি ঘটাই তাহলে এখানে ক্লিয়ার করতে ১০ মিনিটের মতো সময় লাগবে।’
জুলাই আন্দোলনে
সম্পৃক্ত নেতাদের অভিযোগ, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তাকে ডিআইজি পদে পদোন্নতি দিয়ে
এপিবিএনের সিইও বদলি করা হয়েছে। তবে সূত্র জানায়, তিনি সবশেষ পদোন্নতি পান ২০২২ সালে।
ওই সময় এসপি থেকে অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতি দিয়ে তাকে র্যাব-১০ এর অধিনায়ক হিসাবে
পদায়ন করা হয়।
গণঅধিকার পরিষদের
উচ্চতর পরিষদ সদস্য ও গণমাধ্যম সমন্বয়ক আবু হানিফ সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘র্যাব
১০-এর অধিনায়ক ফরিদ উদ্দিন যাত্রাবাড়ীর আন্দোলন দমনে ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছিলেন।
কিন্তু দুঃখজনক বিষয়, এ সরকার তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি, তাকে পুরস্কৃত করেছে। তাকে
পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এমন একজন অফিসার কীভাবে বিচারের মুখোমুখি না হয়ে পদোন্নতি পান
সেটা আমাদের প্রশ্ন।’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম
ফেসবুকে এক পোস্টে ঢাকা আইনজীবী সমিতির (এডহক) সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম
লেখেন, যাত্রাবাড়ীতে জুলাই অভ্যুত্থানে গণহত্যার মহানায়ক, ১০ মিনিটে আন্দোলন ক্লিয়ার
করে ফেলবে এবং আন্দোলনকে বিএনপি-জামায়াত সন্ত্রাসীদের পরিকল্পনা বলা র্যাব-১০ এর ফরিদ
উদ্দিনের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা তো দূরের কথা বরং জুলাই হত্যাকাণ্ডের পুরস্কার হিসাবে
তাকে সিইও পদে পদায়ন করা হয়েছে।’
পুলিশের অতিরিক্ত
আইজিপি আবু নাসের মোহাম্মদ খালেদ যুগান্তরকে বলেন, ‘অতিরিক্ত ডিআইজি ফরিদ উদ্দিন ২
ফেব্রুয়ারি থেকে পলাতক আছেন। আমরা তাকে খুঁজছি।’
একই ধরনের তথ্য জানিয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (অপারেশন্স) রেজাউল করিম বলেন, ‘বেশ কয়েকটি হত্যা মামলার আসামি ফরিদ উদ্দিনকে গ্রেফতারে চেষ্টা চালাচ্ছি।’