মিউচুয়াল ফান্ড খাতের ‘কালপ্রিট’ তাহের ইমামের যত অপকর্ম

যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৩:৫৬ পিএম
-67b500e3de37b-67b5aabb819fa.jpg)
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের মিউচুয়াল ফান্ড ইন্ডাস্ট্রির একক নিয়ন্ত্রক রেস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হাসান তাহের ইমাম।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, হাসান তাহের ইমাম বিভিন্ন ছক কষে প্রতারণা করে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ক্ষতির মুখে ফেলেছেন। তিনি তার নিয়ন্ত্রিত ব্রোকারেজ হাউজ মাল্টি সিকিউরিটিজকে ব্যবহার করে অনৈতিক লেনদেনের মাধ্যমে আত্মসাৎ করেছেন শত শত কোটি টাকা। ব্যবহার করেছেন তার ব্যক্তিস্বার্থের বেশকিছু কোম্পানির অ্যাকাউন্টও। এর মধ্যে রিট করপোরেশন, ভাইকিংস, টার্ন বিল্ডার্স, বিডি এসএমই করপোরেশন, একাসিয়া ফান্ডস, ইনভেস্ট এশিয়া ক্যাপের মতো অ্যাকাউন্টগুলো অন্যতম।
উল্লিখিত এ সিকিউরিটিজগুলোর মাধ্যমেই জালিয়াতি করে তিনি হাতিয়ে নিয়েছেন বিনিয়োগকারীদের কষ্টার্জিত শতকোটি টাকা, যা সিআইডির তদন্ত প্রতিবেদনে স্পষ্টত বেরিয়ে এসেছে। এছাড়া মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর বিনিয়োগকারীদের অর্থ লুটপাট ও ফায়দা হাসিলের জন্য তিনি বাংলাদেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির (বিজিআইসি) বোর্ডে থাকা তার নিকটতম তিন ব্যক্তিকে ব্যবহার করেছেন। অসৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে বড় বোনকেও বিজিআইসিতে অন্তর্ভুক্ত করেন এই হাসান ইমাম।
তিনি বিনিয়োগকারীদের কমপক্ষে ৭০০ কোটি টাকা লোপাট করে বিপুল সম্পদের মালিক বনে গেছেন। এতে অনেক বছর ধরে অনাস্থায় ভুগতে থাকা মিউচুয়াল ফান্ডের ভবিষ্যৎ আরও বেশি হুমকিতে পড়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
৭০০ কোটি টাকা অনৈতিক লেনদেন : হাসান তাহের ইমামের বিরুদ্ধে ২০২৩ সালের ১৯ নভেম্বর পল্টন মডেল থানায় শতকোটি টাকা প্রতারণামূলকভাবে আত্মসাতের অভিযোগ দায়ের করেন মো. রুহুল আমিন আকন্দ নামে একজন বিনিয়োগকারী।
অভিযোগে বলা হয়, হাসান তাহের ইমাম ছলচাতুরী ও অন্যায়-অনিয়মের মাধ্যমে ১২টি মিউচুয়াল ফান্ড ও একটি এসপিভি কোম্পানির বিনিয়োগকারীদের প্রায় ৩০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এর মধ্যে রুহুল আমিনের ব্যক্তিগত ৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এছাড়া হাসান তাহের নিয়মবহির্ভূতভাবে তার নিয়ন্ত্রিত ব্রোকারেজ হাউজ মাল্টি সিকিউরিটিজ অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেডের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে বেশি হারে কমিশন নিয়েছেন। শুধু ২০১৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ৫ বছরে বিনিয়োগকারীদের থেকে ব্রোকারেজ হাউজের লেনদেন কমিশন বাবদ ৫০-৬০ কোটি টাকা বেশি নেওয়া হয়েছে।
পরবর্তী সময়ে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের অনুসন্ধানে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলোর সত্যতা পাওয়া যায়।
মলার তদন্ত কর্মকর্তা জানিয়েছেন, হাসান ইমাম পাবলিক ফান্ডগুলো নিয়ন্ত্রণ করেছেন এবং তার নিজস্ব কোম্পানি, সংস্থা ও তহবিলের স্বার্থে ব্যবহার করেছেন। এর মাধ্যমে তিনি অনৈতিক উপায়ে অর্থ উপার্জন করেছেন। মাত্র ৫ বছরে অনৈতিক ও আইনবহির্ভূতভাবে লেনদেন করে তিনি ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের ক্ষতিগ্রস্ত করে ৭০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
দুদকের অনুসন্ধান : হাসান তাহের ইমামের বিরুদ্ধে বিনিয়োগকারীদের কয়েক শ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ জমা পড়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনেও। লুটপাট করা অর্থে তিনি বিদেশে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন বলে সংস্থাটির কাছে অভিযোগ রয়েছে। কমিশন অভিযোগটি অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য সংস্থাটির সহকারী পরিচালক আফিয়া খাতুনকে দায়িত্ব দিয়েছে। তিনি অনুসন্ধানের স্বার্থে হাসান তাহের ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে-বেনামে থাকা স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের তথ্য চেয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, ব্যাংক-বিমা, সিটি করপোরেশন, ভূমি অফিস, সাবরেজিস্ট্রি অফিসসহ বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি দিয়েছেন। তবে সব দপ্তর থেকে অভিযোগসংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র এখনো দুদকে এসে পৌঁছায়নি। ফলে আটকে আছে অনুসন্ধান কাজও।
গুলশানে বাড়ি ও গাজীপুরে জমি দখলের অভিযোগ : হাসান তাহেরের বিরুদ্ধে আমেরিকা প্রবাসী এক নারীর ১৫ কাঠা আয়তনের গুলশান অ্যাভিনিউয়ের এনই-ব্লকের তিন নম্বর প্লটটি দখল করার অভিযোগ আছে। প্লটটির বাজারমূল্য ২০০ কোটি টাকার বেশি। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী নারী তার বিরুদ্ধে গুলশান থানায় মামলা করতে গিয়ে বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের পলাতক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও তার ভাগিনা সাবিরুলের ক্ষমতার কাছে পরাজিত হয়ে মামলা করতে ব্যর্থ হন।
সবশেষ ২০২৪ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি একটি জিডি (নম্বর-৬৮৯) করেন। এছাড়াও হাসান তাহের ইমামের বিরুদ্ধে গাজীপুরের গাছা থানার পলাসোনা, ইছরকান্দি ও মুদিপাড়া মৌজা এলাকায় দখলবাজ ঠাকুর বাহিনীর মাধ্যমে কয়েক শ বিঘা জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে।
গাজীপুরের গাছা, পলাসোনা মৌজা ও সংশ্লিষ্ট ভূমি আফিসে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গাছা থানার অন্তর্গত পলাসোনা ও গাছা মৌজায় নামমাত্র কিছু জমি কিনে এবং সরকারি খাসজমি মিলিয়ে প্রায় ৫০০ বিঘা জমি এখন ‘নীড় আর্কিটেকচারাল রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড’ নামে একটি বেসরকারি কোম্পানির দখলে। কোম্পানিটির মালিক হিসাবে স্থানীয়রা হাসান তাহের ইমামকেই জানেন। কোম্পানি আইনে ২০১৫ সালে চালু করা এ প্রতিষ্ঠানটির রেজিস্ট্রেশন নম্বর সি-১২৭৭৬২। যার অফিস দেখানো হয়েছে উত্তরার ৬ নম্বর সেক্টরে। আর প্রতিষ্ঠানটির প্রধান হলেন হাসান তাহের ইমাম।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষকদের মতামত : পুঁজিবাজার বিশ্লেষক মুশফিকুর রহমান রনির মতে, যেসব বিনিয়োগকারীর বিনিয়োগ সম্পর্কিত জ্ঞানস্বল্পতা আছে, তারা তাদের অর্থ মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করে থাকেন। বিশ্বের বড় অর্থনীতির সব দেশেই ‘মিউচুয়াল ফান্ড’ ব্যাপক জনপ্রিয় বিনিয়োগমাধ্যম। কিন্তু বাংলাদেশে মিউচুয়াল ফান্ড কোনো কালেই জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি। এর পেছনে হাসান তাহের ইমামের মতো কিছু ব্যক্তি দায়ী। তারা তাদের নিজস্ব স্বার্থ হাসিলের জন্য এই খাতটিকে ব্যবহার করেছেন। বিনিয়োগকারীদের ঠিকমতো লভ্যাংশও দেননি। বিপরীতে নিজেরা সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন। হাসান তাহেরের মতো আর্থিক খাতের এসব নীরব মাফিয়াকে আইনের আওতায় এনে বিচারের সম্মুখীন করা না গেলে বাংলাদেশে মিউচুয়াল ফান্ডের ভবিষ্যৎ ধ্বংস হওয়ার দ্বারপ্রান্তে গিয়ে ঠেকবে।
অভিযোগের বিষয়ে মতামত জানতে চেয়ে হাসান তাহের ইমামের দুটি মোবাইল নম্বরে কল করা হলে তা বন্ধ পাওয়া যায়।