Logo
Logo
×

জাতীয়

ভোলার ২০০ বছরের ঐতিহ্য মহিষের দধি, যেসব কারণে আজও অনন্য

Icon

কামরুল হাসান কাওছার

প্রকাশ: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০৭ পিএম

ভোলার ২০০ বছরের ঐতিহ্য মহিষের দধি, যেসব কারণে আজও অনন্য

মেঘনা, তেঁতুলিয়া আর বঙ্গোপসাগরের অথৈ জলরাশিবেষ্টিত বাংলাদেশের দক্ষিণের জনপদ ভোলা। এই জনপদটির জন্ম খুব বেশি দিনের নয়। ঐতিহাসিকদের মতে, এই দ্বীপটি জেগে উঠতে শুরু ১২৩৫ খ্রিস্টাব্দের দিকে। এবং ১৩০০ সালের দিকে এখানে চাষাবাদ শুরু হয় বলে ধারণা করা হয়।

পলিকণা দিয়ে গঠিত এই জনপদটির মাটি খুব বেশি উর্বর হওয়ার কারণে সেই প্রথম থেকেই এই দ্বীপটিতে ধান, সুপারি, নারিকেলসহ শাক-সবজি প্রচুর পরিমাণে উৎপাদন হত। এছাড়া নদীবেষ্টিত হওয়ায় এখানে পাওয়া যেত বিপুল পরিমাণ ইলিশসহ নানা ধরনের সামুদ্রিক মাছও। প্রাকৃতিক এসব প্রাচুর্যের কারণেই যুগে যুগে বিভিন্ন বিদেশি শাসকসহ পর্তুগিজ, আরাকানের মগ, বর্গি জলদস্যুদের আনাগোনা ছিল এই দ্বীপে। 

২০২২ সালের সর্বশেষ আদমশুমারি অনুযায়ী, ‘কুইন আইল্যান্ড অব বাংলাদেশ’ নামের এই দ্বীপটিতে ১৯ লাখ ৩২ হাজার ৫১৪ মানুষের বসবাস। এখানকার অধিকাংশ মানুষই জীবিকা নির্বাহ করে আসছে পশু পালন, চাষাবাদ, নারিকেল-সুপারি আর ইলিশ মাছের ওপর নির্ভর করে। এর জন্যই প্রাচীন একটা প্রবাদবাক্য রয়েছে এই জেলা নিয়ে। ‘ধান, সুপারি আর ইলিশের গোলা এই তিনে ভোলা’। শত বছর ধরে এই প্রবাদবাক্যের মাধ্যমেই পরিচিত হয়ে আসছে এই জেলাটি। এছাড়া নদী আর সমুদ্রবেষ্টিত হওয়ায় এখানকার মানুষের রয়েছে কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। খাবারে রয়েছে নিজস্বতা।

তবে মাছ ধরা বা চাষাবাদ করার পাশাপাশি এই জেলায় মহিষ পালন একটি ঐতিহ্যগত পেশা। এখানকার প্রায় অর্ধশতাধিক চরের মানুষ বংশ পরম্পরায় মহিষ পালন করে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। পরিবেশ ও আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় জেলার ছোটবড় ২১টি চরের ৬৯টি বাথানে ১ লাখ ২৪ হাজার মহিষ পালন করা হচ্ছে । প্রতিদিন দুধ উৎপাদন হচ্ছে ১৫ থেকে ২০ টন। প্রতিটি মহিষের বাথানে দশ থেকে হাজার পর্যন্ত মহিষ পালন হয়ে থাকে। যা ঘরোয়া পরিবেশে একেবারেই অসম্ভব।

কিন্তু বর্তমানে এ মহিষ পালন অধিক লাভজনক হওয়ায় স্থানীয়রা বসত বাড়ির গোয়ালঘরে পালন শুরু করেছেন। মহিষ পালনের ব্যাপকতা ও এর দুধের চাহিদার কারণে এলাকার দরিদ্র কৃষকরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে উঠছেন। একদিকে মহিষ বিক্রি অন্যদিকে মহিষের দুধের তৈরি টক দই বিক্রি করে লাভবান হচ্ছেন উপকূলের চাষীরা।

মহিষের দুধের তৈরি এই দইকে স্থানীয় ভাষায় ‘মইষা দই’ বলে থাকে। এই দই প্রায় প্রায় ২০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী খাবার হিসেবে সমাদৃত হয়েছে আসছে এখানকার মানুষের কাছে।

সম্প্রতি জিওগ্রাফিকাল আইডেনটিফিকেশন (জিআই) বা ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন পেটেন্ট, শিল্প-নকশা ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তরের ৫৫টি জিআই পণ্যের মধ্যে ২৯ নম্বর শ্রেণীতে ব্রান্ডিং পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে দ্বীপজেলার ২০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী মহিষের দুধের কাঁচা টক দধি ‘মইষা দই’। এখন শুধু অপেক্ষা আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ইনটেলেকচুয়াল প্রোপার্টি অর্গানাইজেশন (ডব্লিউআইপিও) এর চূড়ান্ত সনদের। এ সনদ পেলে মিলবে জিআই পণ্যের স্বীকৃতি। এতে আনন্দিত এ জেলার সর্বস্তরের মানুষ।

জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের তথ্য মতে, ভোলার ৭ উপজেলার মহিষের বাথানগুলো থেকে প্রতিদিন দুধ উৎপাদন হয় প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ টন। মহিষের দই তৈরির জন্য ব্যবসায়ীরা বেশিরভাগ দুধ সংগ্রহ করেন এসব চর থেকেই।

তিন দিক নদী ও এক দিক সাগর দ্বারা বেষ্টিত হওয়ায় এই দ্বীপটির বুকে গড়ে ওঠা ছোটবড় প্রায় ২১টি চর। এই চরগুলোতে প্রাচীনকাল থেকেই এখানকার স্থানীয়রা মহিষ পালন করে আসছেন। আর মহিষের কাঁচা দুধ থেকে তৈরি হয় জনপ্রিয় এই টক দই। যার চাহিদা ও জনপ্রিয়তা ভোলার গণ্ডি ছাড়িয়েছে দেশব্যাপী।

বাথানিরা ও গোয়ালরা প্রতিদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মণে মণে মহিষের দুধ নিয়ে আসেন বিভিন্ন বাজারে। বাজার থেকে দই ব্যবসায়ীরা তাদের প্রয়োজনমতো দুধ কেনেন। এরপর বিভিন্ন মাপের মাটির টালিতে দুধ বসিয়ে দই তৈরি করে বিক্রি করেন তারা।

এখানকার সামাজিক, পারিবারিক ও ঘরোয়া ভোজে মইষা দই না থাকলে সে আয়োজন পূর্ণতা পায় না। দই ভাত, মুড়ি, চিড়ার সঙ্গে মিশিয়ে গুড় ও চিনি দিয়েও খাওয়া যায়। এছাড়াও খাবার হজমে সহায়তা করায় দেশজুড়ে ভোলার মৈষা দইয়ের রয়েছে ব্যাপক চাহিদা।

মহিষের টক দই যেভাবে তৈরি করা হয়

টক দই তৈরি করা খুবই সহজ কাজ। এই দই সাধারণত মাটির পাত্রে (টালিতে) বসানো হয়। উপরে শুধু নিউজ পেপার দিয়ে মুড়িয়ে দেওয়া হয়। বেশ কয়েক ধরনের পাত্র থাকে। কোয়াটার, এক লিটার, দেড় লিটার, দুই লিটার এবং পাঁচ লিটার। প্রথমে মাটির পাত্র গুলো ভালোভাবে পরিষ্কার করে নেওয়া হয়।

এরপর কাঁচা দুধ আগুনে গরম না করে ভালোভাবে ছেকে মাটির পাত্রে স্থির জায়গায় রেখে দিতে হয়। সাধারণত গরমের দিনে ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা এবং শীতের দিনে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা সময় লাগে দই তৈরি হতে।

টক দইয়ের গুরুত্ব

ভোলায় পারিবারিক, সামাজিক বা সাংস্কৃতিক যেকোনো অনুষ্ঠানে দই থাকবেই। দই না থাকলে অনুষ্ঠান অপূর্ণ। শিশু থেকে বৃদ্ধ সবার কাছেই সমান প্রিয় এই দই। স্থানীয়রা খাবারের শেষে ভাতের সঙ্গে এই দই খায়। টক দই এর সঙ্গে গুড়, মিষ্টি অথবা চিনি মিশিয়ে খেতে হয়। অনেকে গরমের দিনে দইয়ের সঙ্গে হালকা পানি ও চিনি মিশিয়ে ঘোল তৈরি করে খায়। এ ঘোল গরমের দিনে মানুষের শরীরকে ঠাণ্ডা রাখে। এই দইয়ে আছে প্রচুর ঔষধি গুণ। এটি হজমে সহায়তা করে। স্বাস্থ্যবিদদের মতে, দইয়ে ক্যালসিয়াম, প্রোটিন, ভিটামিনসহ অন্যান্য উপদান থাকে, যা আমাদের দেহের জন্য খুবই উপকারি।

মহিষের টক দইয়ের দাম কেমন

দইয়ের কোয়ালিটির উপর দাম নির্ভর করে। আর দইয়ের কোয়ালিটি নির্ভর করে মহিষের দুধের ওপর। এই দই লিটার হিসাবে বিক্রি করা হয়। প্রতি লিটার দইয়ের দাম ১৫০ থেকে ৩০০ টাকা।

মহিষ পালন ও দই উৎপাদনে সংকট

এতো সম্ভবনার পরও মহিষ পালন ও টক দই উৎপাদনে রয়েছে নানা রকম সংকট। কেননা, এই বিপুল সংখ্যক মহিষের বিচরণের জন্য যেমন দরকার হয় বিশাল বিচরণক্ষেত্র, তেমনই এসব মহিষের খাদ্যের জন্য প্রয়োজন হয় সেই অনুযায়ী ঘাসেরও। যার কোনোটিই এখন আর সেভাবে পাওয়া যায় না এই জেলাতে। 

জেলার বিভিন্ন চরগুলোতে সরকারি খাস জমি স্থানীয় রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালীরা মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে মহিষ মালিকদের কাছে লিজ দেন। দৌলতখান উপজেলার মদনপুর চরের ২৮০ একর জমি ১৮ লাখ টাকা দিয়ে এক বছরের জন্য লিজ নিয়ে তাতে ৩৫০টি মহিষ রাখছেন ভোলার এক মহিষ মালিক। এইভাবে ওই চরের বৈরাগীর চর, কেকরাচর, চরবেড় এমন ১৮টি মৌজার দেড় হাজার একর সরকারি জমি লিজ দিয়ে একটি পক্ষ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। এতে সরকার পায় না কোন রাজস্ব। মহিষ মালিকরা এই সব জমি তাদের নামে সরকারি লিজ দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছেন অনেকদিন থেকে। 

শুধু মহিষ পালনের বিচরণ জমি আর ঘাসের সংকটই নয়, চরগুলোতে নেই প্রয়োজন সংখ্যক কিল্লা (মহিষ রাখার জায়গা), নেই চিকিৎসাসেবাও। যার ফলে, দিন দিন বাড়ছে মহিষের খাদ্য সংকট। এই সব সংকট দূর করা গেলে ভোলার মহিষের দুধ ও দইসহ দুগ্ধজাতপণ্য হতে পারে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সেরাপণ্য। 

তিন দশক ধরে জেলায় মহিষের দই উৎপাদন ও বিক্রি করছেন আদর্শ দধি ভান্ডারের মালিক মো. আব্দুল হাই। তার পিতা প্রয়াত আব্দুল কাদের দীর্ঘ ৫০ বছর এই ব্যবসা করে গেছেন।  

আব্দুল হাই জানান, নতুন করে জেগে ওঠা প্রতিটি চর সরকারি খাস জমি হিসেবে স্বীকৃত। অথচ মহিষের জন্য কোনো জমি সরকারিভাবে দেওয়া হয়নি। মহিষের আবাস হিসেবে কোনো আবাসন গড়ে ওঠেনি। 

তিনি জানান, আমাদের পরিবারের দেড় হাজার মহিষ রয়েছে। মদনপুর চরে প্রতি মহিষের বিচরণের জন্য আগে ইউপি চেয়ারম্যানকে ৫ হাজার টাকা দিতে হত। বর্তমানে ইউপি চেয়ারম্যান নেই। তারপরও ক্ষমতা বদলে চরের এক রাজনৈতিক নেতাকে ৭ হাজার টাকা দিতে হচ্ছে। আবার এক একর জমি ঘাস উৎপাদনের জন্য দিতে হয় ১৫ থেকে ১৭ হাজার টাকা। ১২ গন্ডা জমিতে ১০টি মহিষের ঘাস উৎপাদন করা যায়। অথচ এসব জমি সবগুলোই সরকারি। তবুও ঘাস উৎপাদনের জন্য এসব রাজনৈতিক নেতাদের লিজের নামে চাঁদা দিতে হচ্ছে। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন মহিষ খামারি জানান, ভোলার চরগুলো সবসময় একদল লাঠিয়াল বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকে। তারা প্রতি বছরের জন্য নির্দিষ্ট সীমানা নির্ধারণ করে খামারিদের কাছে চরের ঘাস বিক্রি করেন। এতে চরে মহিষ অবাধে বিরচণ করে কাঁচা ঘাস খেতে পারে না এবং প্রায়ই চরে মহিষের খাবার সংকট দেখা দেয়। ফলে দুধের পরিমাণ কমে। এছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগে মহিষ নিখোঁজ হয়। মহিষের নিরাপত্তায় চরে কিল্লা নেই। এতে দুর্যোগের সময় মহিষগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

ভোলার সচেতন মহল বলছে, ভোলার ঐতিহ্যবাহী মইষা দইয়ের মান ধরে রাখতে হলে প্রশাসনকে নিয়মিত বাজার মনিটরিংয়ে কার্যকর উদ্যোগসহ চরে মহিষের অবাধ বিচরণের ব্যবস্থা নিতে হবে।

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম খান যুগান্তরকে বলেন, জেলায় ১ লাখ ২৪ হাজার মহিষ রয়েছে। এক একটি মহিষের দাম দেড় লাখ টাকা থেকে দুই লাখ টাকা হলে প্রায় দুইশ কোটি টাকার সম্পদ। প্রতিদিন প্রায় ২০ লাখ টাকার দুধ উৎপাদন হয়ে থাকে। অথচ চরাঞ্চলে মহিষ বিচরণের জন্য সরকারিভাবে কোনো জমি বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে না। একাধিকবার প্রস্তাব পাঠানো হলেও স্থানীয় প্রশাসন থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয় না বলেও জানান তিনি। 

চরে মহিষের চিকিৎসার জন্য চিকিৎসা ক্যাম্প গঠন হয় না বলে স্বীকার করেছেন এই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়া যাচ্ছে না। তবে ব্যক্তিগতভাবে মহিষের জন্য ভ্যাকসিন দেওয়া হয়। 

তিনি বলেন, নদীতে নতুন জেগে ওঠা চর যেখানে ঘাস জন্মাতে পারে। ওই ধরনের চর মহিষের জন্য সরকারিভাবে বরাদ্দ দেওয়া হলে মহিষ পালন বাড়বে। একই সঙ্গে দুধের উৎপাদন বাড়বে। মহিষের দুধ দিয়ে দইসহ বিভিন্ন দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদন সম্ভব বলেও তিনি মনে করেন। 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম