‘অ্যান্টিগুয়ার নাগরিক’ বসির ছিলেন ইউসিবির পরিচালক, পাচারচক্রে আরও যারা
![Icon](https://cdn.jugantor.com/uploads/settings/icon_2.jpg)
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১০:০২ এএম
![‘অ্যান্টিগুয়ার নাগরিক’ বসির ছিলেন ইউসিবির পরিচালক, পাচারচক্রে আরও যারা](https://cdn.jugantor.com/assets/news_photos/2025/02/10/Basir-67a97a73b420d.jpg)
বিদেশে অর্থ পাচার সিন্ডিকেটে জড়িত ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) সাবেক পরিচালক বসির আহমেদ। তিনি পাচাকারী চক্রের ‘মাস্টারমাইন্ড’ ব্রিটিশ-বাংলাদেশের দ্বৈত নাগরিক মোহাম্মদ আদনান ইমাম ও রনি সিন্ডিকেটের একজন প্রভাবশালী সদস্য।
পরিচালক পদের প্রভাব খাটিয়ে তিনি আমদানি-রপ্তানির আড়ালে পাচার করেছেন বিপুল অর্থ। পাচারকৃত অর্থের কিছু অংশ বিনিয়োগ দেখিয়ে সপরিবারে নিয়েছেন দ্বীপরাষ্ট্র অ্যান্টিগুয়া অ্যান্ড বারবুডার নাগরিকত্ব। আর পাচারকাণ্ড নির্বিঘ্ন করতে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই ও যুক্তরাজ্যে একই নামে কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছেন। কোম্পানির মালিকানায় লিখিয়েছেন নিজের, স্ত্রী ও সন্তানের নাম। আর পরিচয় গোপন রাখতে নিজেদের জাতীয়তা উল্লেখ করেছেন ‘অ্যান্টিগুয়ান নাগিরক’।
বসিরের স্ত্রী তারানা আহমেদ মেঘনা ব্যাংকের পরিচালক। এই ব্যাংকের আরেক পরিচালক আনিসুজ্জামান চৌধুরী রনির (সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর ভাই) স্ত্রী ইমরানা জামান চৌধুরী। নাভানা ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিডেট নামে প্রতিষ্ঠানেও আদনান, রনি, বসির ও জুনায়েদের যৌথ বিনিয়োগ রয়েছে। এই বিনিয়োগের অর্থও বিভিন্ন ব্যাংক থেকে বের করে নেওয়া হয়েছে। তাদের এই ব্যবসায়িক অংশীদারত্ব সিন্ডিকেটের বিষয়টি স্পষ্ট করেছে। যুগান্তরের নিজস্ব অনুসন্ধানে বিদেশে অর্থ পাচারের চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
এদিকে আদনান-রনি-বসির সিন্ডিকেটের এই অর্থ পাচারের অভিযোগ গড়িয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)। কিন্তু রহস্যজনক কারণে সংস্থাটি বহুল আলোচিত এই সিন্ডিকেটের অর্থ পাচারের ঘটনা অনুসন্ধানের উদ্যোগ নিচ্ছে না। প্রসঙ্গত, সম্প্রতি যুগান্তরে ‘শুধু আবাসন খাতে ১৩৩৯ কোটি টাকা বিনিয়োগ : যুক্তরাজ্যে বিশাল সাম্রাজ্য’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে আদনান ও রনির যুক্তরাজ্যের কোম্পানি, স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের দালিলিক তথ্য-প্রমাণও তুলে ধরা হয়েছে। এরপরও দুদক নীরব।
অভিযোগ আছে-প্রবাসীদের উদ্যোগে গড়া এনআরবিসি ব্যাংকের এক্সিকিউটিভ কমিটির চেয়ারম্যান আদনান ইমাম। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের দোসর এনআরবিসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান পারভেজ তমাল, আদনান ও সাবেক সংসদ সদস্য শহিদুল ইসলাম পাপুলের অর্থ পাচারের তদন্তকালে দুদকের একশ্রেণির অসৎ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আদনান চক্রের ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। অনৈতিক প্রভাবের কারণে সংস্থাটির ভেতরের প্রভাবশালী ওই চক্রই এখনো আদনান সিন্ডিকেটের সদস্যদের রক্ষার চেষ্টা করছে।
ইউসিবি ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে বলেছেন, ব্যাংকটির আগের পরিচালনা পর্ষদের মদদে অর্থ লোপাটের ঘটনা উদঘাটনে ফরেনসিক তদন্তে এই চক্রের অর্থ পাচারের প্রমাণ পাওয়া গেছে। পুরো ঘটনা তুলে ধরে ব্যবস্থা নিতে দুদক চেয়ারম্যান বরাবর চিঠিও দেওয়া হয়েছে। দুদক এখন কী ব্যবস্থা নেয় সেটাই দেখার বিষয়।
জানতে চাইলে দুদকের উপপরিচালক আকতারুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, যাচাই-বাছাই কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক অভিযোগের বিষয়ে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আগের অনুসন্ধান সম্পর্কে আমি কিছু বলতে পারব না।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত বছরের ২৭ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশে ইউসিবি ব্যাংকের বোর্ড পুনর্গঠন করা হয়। এর আগে ব্যাংকটির পরিচালক থাকাকালে বসির আহমেদ ধারাবাহিকভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে ব্যক্তিস্বার্থে আর্থিক লেনদেনের সুবিধা নিয়েছেন। ব্যাংকটির ফরেনসিক তদন্তে প্রাপ্ত নথিতে দেখা গেছে, ইউসিবি ব্যাংকের চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ ও ঢাকার কাওরান বাজার শাখা থেকে দুবাইয়ে বসির আহমেদের মালিকানাধীন প্যানমার্ক ইম্পেক্স মেঘা ট্রেডিংয়ের নামে ২ লাখ ৪৬ হাজার ২৯৪ ইউএস ডলারের ৫১টি লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) খোলা হয়। এই এলসিগুলোর আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান হিসাবে তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত সালেক্সট্রা লিমিটেড, নাজ ইন্টারন্যাশনাল ও জিএইচএম ট্রেডার্স ও আলোক ট্রেডার্সের নাম উল্লেখ করা হয়।
তদন্তে দেখা গেছে, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ লঙ্ঘন করে ওভার ইনভয়েসের মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাচার করতেই পরিকল্পিতভাবে এই লেনদেন করা হয়েছে। বসির আহমেদের বিরুদ্ধে প্যানমার্ক ইম্পেক্স মেগা ট্রেডিং (দুবাই) এবং প্যানমার্ক ইম্পেক্স মেগা ট্রেডিং লিমিটেড (ইউকে)সহ অফশোর কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে অবৈধ পথে উপার্জিত বিপুল অর্থ পাচারের তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে।
ব্রিটিশ কোম্পানি হাউজ থেকে প্রাপ্ত নথিপত্রে দেখা গেছে, ২০২০ সালের ১৪ ডিসেম্বর যুক্তরাজ্যে প্যানমার্ক ইমপেক্স মেঘা ট্রেডিং লিমিটেড নামের একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন বসির আহমেদ ও তার সহযোগীরা। এই কোম্পানির অফিসের ঠিকানা-অ্যাপার্টমেন্ট ৩০২, ৩ মার্সেন্ট স্কোয়ার, লন্ডন, ইংল্যান্ড ডব্লিউ২ ১এজেড। প্রতিষ্ঠাকালে বসির আহমেদ (জাতীয়তা-সিটিজেন অব অ্যান্টিগুয়া অ্যান্ড বারবুডা) প্রধান নির্বাহী, তার স্ত্রী তারানা আহমেদ (জাতীয়তা-সিটিজেন অব অ্যান্টিগুয়া অ্যান্ড বারবুডা) চেয়ারম্যান ও মেয়ে আরওয়া বসির আর ছেলে ইয়ামিন আহমেদ (জাতীয়তা-সিটিজেন অব অ্যান্টিগুয়া অ্যান্ড বারবুডা) উদ্যোক্তা পরিচালক হিসাবে যুক্ত হন। এরপর আবাসন খাতে তারা বিপুল বিনিয়োগ করেন। এই বসির আহমেদ কোম্পানির অধীনে অ্যাপার্টমেন্ট ২৮০৩, ওয়েস্টমার্ক টাওয়ার, ১ নিউক্যাসল প্লেস, লন্ডন, ডব্লিউ২ ১ভিডব্লিউসহ অনেক সম্পদ কেনা হয়েছে। তবে ২০২৪ সালে বসিরসহ অন্যরা এই কোম্পানি থেকে পদত্যাগ করেছেন বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, এনআরবিসি ব্যাংকের এক্সিকিউটিভ কমিটির চেয়ারম্যান ও দেশের আর্থিক খাতের ‘হোয়াইট কলার ক্রিমিনাল’ হিসাবে কুখ্যাত আদনান ইমামের হাত ধরেই অর্থ পাচার করে যুক্তরাজ্যে সাম্রাজ্য গড়ার নেশায় পায় বসির আহমেদকে। এরই ধারাবাহিকতায় আদনান, রনি ও বসিরের ঘনিষ্ঠ পারিবারিক সম্পর্কও গড়ে ওঠে। লন্ডন ও ফ্রান্সে এই তিন পরিবারের সদস্যদের একসঙ্গে ভ্রমণের অনেক স্থিরচিত্র এসেছে এ প্রতিবেদকের হাতে।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, আদনান ইমামের হাত ধরেই যুক্তরাজ্যের আবাসন খাতে হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ শুরু করেন সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ। এই সূত্রে তার ভাই আনিসুজ্জামান চৌধুরী রনির সঙ্গে আদনানের সম্পর্ক বন্ধুত্বে গড়ায়। তখন রনি নিজেও বিপুল অর্থ পাচার করে যুক্তরাজ্যের আবাসন খাতে বিনিয়োগ করেন।
জানা গেছে, ব্যাংক থেকে ঋণের নামে টাকা সরিয়ে আত্মসাৎ করে দেশেও যৌথ বিনিয়োগ রয়েছে এই চক্রের। ইউসিবি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ থেকে দুদকে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালে ব্যাংক থেকে নিয়মবহির্ভূতভাবে বড় অঙ্কের ঋণ বিতরণ করা হয়েছে এই চক্রের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে। এর মধ্যে জেনেক্স ইনফোসিস লি., জেনেক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লি., এ অ্যান্ড পি ভেঞ্চার লি., এডব্লিউআর ডেভেলপমেন্ট, এ ডব্লিউআর রিয়েল এস্টেট অন্যতম। এসব প্রতিষ্ঠানের নামে অন্তত দুই হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ দেওয়া হয়েছে। মূলত কোনোরকম নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে ঋণের নামে এই বিপুল টাকা বের করে জাভেদ, রনি আদনান ও বসির ভাগবাটোয়ারা করে বেশির ভাগ অর্থ নানা কায়দায় বিদেশে পাচার করেছেন।
এদিকে বসির আহমেদ ও তার পরিবারের অফশোর ব্যাংকিং ও বিপুল অর্থ পাচারের তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ জমা পড়েছে।
অভিযোগকারী বলেছেন, অর্থ পাচার করা ছাড়া বসির আহমেদ সপরিবারে অ্যান্টিগুয়া অ্যান্ড বারবুডার নাগরিকত্ব নিতে পারেননি। বিনিয়োগ কোটায় সেখানে তাদের নাগরিকত্ব নিতে হয়েছে। ব্যাংকের ফরেনসিক অডিটেও তাদের অর্থ পাচারের প্রমাণ মিলেছে। এখন দুদক সদিচ্ছা দেখালেই তাদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব। টাকা পাচার করে তারা বিদেশি নাগরিকত্ব নিয়েছেন এটাও দিবালোকের মতো সত্য। যুক্তরাজ্যের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থাসহ আন্তর্জাতিক সহযোগিতা নিলে অ্যান্টিগুয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও লন্ডন থেকে পাচারের অর্থ ফিরিয়ে আনাও সম্ভব।
জানতে চাইলে বসির আহমেদ সপরিবারে অ্যান্টিগুয়া বারবুডার নাগরিকত্ব নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে যুগান্তরকে বলেন, ‘ওখানে নাগরিকত্ব নেওয়ার জন্য আমি কোনো টাকা পাচার করিনি। কানাডা থেকে আমার বন্ধু ওই টাকা ধার দিয়েছে। তাছাড়া আমি একা নই, বাংলাদেশের অনেকেই ওখানকার নাগরিকত্ব নিয়েছেন। আমি কোনো মানি লন্ডারিংয়ের সঙ্গে জড়িত নই। আমি দুবাইয়ের পার্মানেন্ট রেসিডেন্স হোল্ডার। সেখানে আমার কোম্পানি আছে। আমি এক্সপোর্ট করি। লন্ডনে আমি কোম্পানি করেছিলাম, সেটা বন্ধ করে দিয়েছি। লন্ডনে আমার কোনো বাড়ি নেই। তাছাড়া লন্ডনে কোম্পানি খুলতে কত টাকা লাগে সেটা আপনিও জানেন।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি একটি ব্যাংকের ডাইরেক্টর ছিলাম। আমার সঙ্গে অনেকেরই পরিচয় আছে। রনি আমার এলাকার বন্ধু। আদনানকেও আমি চিনি। তবে অর্থ পাচারকারী কোনো সিন্ডিকেটের সঙ্গে আমি জড়িত নই।’