চট্টগ্রাম বন্দরে শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর
ভিন্ন মোড়কে ফেরার চেষ্টা লাইসেন্স বাতিল হওয়া ২৩ প্রতিষ্ঠানের

শহীদুল্লাহ শাহরিয়ার, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১০:৪৯ এএম

নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে ২৩টি শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর লাইসেন্স দিয়েছিল চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক)। শত বাধা, আপত্তি এমনকি উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে সব লাইসেন্স তুলে দেওয়া হয়েছিল বিগত সরকারের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, এমপি, মন্ত্রীর স্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতাদের হাতে। সরকারের পটপরিবর্তনের পর সবকটি লাইসেন্স বাতিল করায় বিদ্যমান অপারেটরদের মধ্যে ফিরেছিল স্বস্তি। কিন্তু সম্প্রতি আবারও টেন্ডারহীনভাবে শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর লাইসেন্স বাগিয়ে নিতে বা বাতিল হওয়া লাইসেন্স ফিরে পেতে তৎপর হয়ে উঠেছে একটি পক্ষ। এরই মধ্যে আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি এমএ লতিফের ব্যবসায়িক অংশীদার হিসাবে থাকা মেসার্স ডিভি আবদুল আজিজ অ্যান্ড কোম্পানিকে লাইসেন্স প্রদান করেছে চবক! একইভাবে মেসার্স এমএন মিয়া অ্যান্ড সন্স নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠানকেও লাইসেন্স দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আর এ কারণে শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটরদের মধ্যে নতুন করে তৈরি হয়েছে শঙ্কা।
বিদ্যমান শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটররা বন্দরের এমন সিদ্ধান্ত বা উদ্যোগকে ‘নজিরবিহীন’ ও এবং বিগত সরকারের ‘পদাঙ্ক অনুসরণ’ করার মতোই ঘটনা বলে মন্তব্য করেছেন। তারা বলছেন, অতীতের ফ্যাসিবাদের অনুসারীরাই নতুন করে ভিন্ন মোড়কে বন্দরে পুনর্বাসিত হওয়ার চেষ্টা করছে। তারা টেন্ডারবিহীন বা দরখাস্ত আহ্বান ছাড়া কোনো ধরনের লাইসেন্স না দেওয়ার জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষকে আহ্বান জানিয়েছেন।
‘চট্টগ্রাম বন্দরে শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর, মন্ত্রী-এমপি আওয়ামী লীগ নেতার হাতেই ২০ লাইসেন্স’ শীর্ষক সংবাদ প্রকাশ করেছিল যুগান্তর। ২০২৩ সালের ২১ মে ওই প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। সে সময় বন্দর কর্তৃপক্ষ বলেছিল বিধিবিধান মেনেই লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পটপরিবর্তনের পর আবার কেন বাতিল করা হলো-এমন প্রশ্নের জবাবে বন্দর কর্তৃপক্ষ এখন বলছে, অনেক সময় নিয়ম মেনে সবকিছু করা সম্ভব হয় না। টেন্ডার বা দরখাস্ত আহ্বান ছাড়া লাইসেন্স দেওয়াটা সঠিক ছিল না। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের অনেক সিদ্ধান্তই চবককে মানতে হয় বলে জানান বন্দরের মুখপাত্র।
নতুন করে টেন্ডারবিহীনভাবে একটি প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স প্রদান এবং আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে প্রদানের উদ্যোগ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক যুগান্তরকে বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে যে প্রতিষ্ঠানটিকে অপারেটিংয়ের অনুমতি দেওয়া হয়েছে সেটি চট্টগ্রাম বন্দরে আগে কাজ করত। নানা কারণে তাদের লাইসেন্স বাতিল বা স্থগিত হয়েছিল। ফি দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি পুনরায় লাইসেন্স নবায়ন করছে মাত্র। এখন বাতিল হওয়া কোনো প্রতিষ্ঠান যদি নতুন করে জরিমানা বা ফি দিয়ে কাজ করতে চায় তাহলে বন্দর তো না করতে পারে না।’
চট্টগ্রাম বন্দর ও সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বর্তমানে বন্দরের তালিকাভুক্ত ও লাইসেন্সপ্রাপ্ত ৩২টি প্রতিষ্ঠান শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর হিসাবে কাজ করছে। প্রতিষ্ঠানগুলো চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে ও কুতুবদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দরে মাদার ভেসেল (বড় জাহাজ) থেকে আমদানি পণ্য হ্যান্ডলিং করে। গড়ে প্রতিবছর ৫ কোটি টন পণ্য হ্যান্ডলিং করে প্রতিষ্ঠানগুলো। অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি সমৃদ্ধ করে দীর্ঘদিন ধরে প্রতিষ্ঠানগুলো এ কাজ করে আসছে। এক সময় সব ধরনের আমদানি পণ্যের শতভাগ হ্যান্ডলিং অপারেটররা করলেও বর্তমানে বড় বড় গ্রুপগুলো নিজেরাই তাদের আমদানি পণ্য হ্যান্ডলিং (জাহাজ থেকে নামানো) করে থাকে। এজন্য বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজ অনেক কমে যায়। সঙ্গে কমে যায় আয়ও। এ অবস্থায় যখন তারা দিশেহারা তখনই বিগত সরকার কোনো নিয়মনীতি না মেনে সরকারি দলের মন্ত্রী, এমপি ও আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রতিষ্ঠানের নামে-বেনামে ২৩টি লাইসেন্স দেয়। এর মধ্যে ২০টিই পায় তৎকালীন সরকারের মন্ত্রী, এমপি, আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতারা। ব্যবসায়ীদের পরিবর্তে মন্ত্রী-এমপিদের প্রতিষ্ঠানের নামে লাইসেন্স দেওয়ার ঘটনাটি সে সময় ব্যবসায়ী মহলে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়।
যারা লাইসেন্স পেয়েছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন সাবেক মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের স্ত্রী, সাবেক এমপি এমএ লতিফ, তার ছেলে ওমর হাজ্জাজ, বরিশালের তৎকালীন মেয়র খোকন সেরনিয়াবাত, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আত্মীয়, বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নুরুল কাইয়ুম খান, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক শাহজাদা মহিউদ্দিন, পাঠানটুলি ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর মোহাম্মদ জাবেদ, এমইএস কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক জিএস আরশেদুল আলম বাচ্চু, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক সীমান্ত তালুকদার। একই ভাবে সাবেক শ্রমমন্ত্রী মুন্নুজান সুফিয়ান, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলসহ বিভিন্ন মন্ত্রী-এমপির সুপারিশেও সরকারি দলের রাঘববোয়ালরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে লাইসেন্স পেয়েছিলেন। এ ঘটনায় দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটররা। বহির্নোঙরে পণ্য খালাস কার্যক্রমে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির আশঙ্কায় শঙ্কিত ছিলেন তারা। কোনো ওজর-আপত্তিতে কাজ না হলেও ৫ আগস্ট সরকারের পটপরিবর্তনের পর সেই দাবি তারা আবার তোলেন। চট্টগ্রাম বন্দরের বর্তমান চেয়ারম্যান এসব লাইসেন্স শেষ পর্যন্ত বাতিল করলে ফিরে আসে স্বস্তি।