সরকারের ছয় মাস পূর্তি
দুষ্টচক্রের ছোবলে দেশের অর্থনীতি
![Icon](https://cdn.jugantor.com/uploads/settings/icon_2.jpg)
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১১:৩১ পিএম
![দুষ্টচক্রের ছোবলে দেশের অর্থনীতি](https://cdn.jugantor.com/assets/news_photos/2025/02/07/image-825037-1720307885-67a6437a2b0ee.jpeg)
প্রতীকী ছবি
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের গৃহীত নীতির ফলে দেশের সার্বিক অর্থনীতি দীর্ঘমেয়াদে দুষ্টচক্রের কবলে পড়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার আগস্টে দায়িত্ব নেওয়ার পর হাতে পেয়েছে ভঙ্গুর অর্থনীতি। ছয় মাসে এ অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে নানামুখী পদক্ষেপ নিলেও চক্রের ছোবলের প্রভাব থেকে বের করা সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থায় লেগেছে বন্যার ধাক্কা। এসব কারণে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলো পরিপূর্ণ সুফল মিলছে না।
একদিকে ইতিবাচক প্রভাব পড়লে, অন্যদিকে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। মূল্যস্ফীতির হার বৃদ্ধির অন্যতম উপকরণ পণ্যমূল্য এখনো নিয়ন্ত্রণে আসেনি। যে কারণে মূল্যস্ফীতিতেও খুব একটা সুফল মিলছে না। তবে অক্টোবরের পর থেকে মূল্যস্ফীতি ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে। আগামী জুনের মধ্যে এ হার ৭ থেকে ৮ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনতে চায় সরকার।
এদিকে চিহ্নিত সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি সব শ্রেণির ভোক্তা। আমন মৌসুমেও অসাধু মিলারদের কারসাজিতে চালের অগ্নিমূল্য। কয়েকটি কোম্পানির সিন্ডিকেটে বাজার থেকে উধাও সয়াবিন তেল। কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বেশি দাম নেওয়া হচ্ছে। ছয় মাসের ব্যবধানে মসুর ডাল কেজিতে ৫ টাকা বেড়ে ১৪০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। মাছ-মাংসসহ একাধিক পণ্যের দামেও রয়েছে অস্বস্তি।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, বাজারে সিন্ডিকেট ধরতে সরকারকে গোয়েন্দাগিরি করতে হবে। যেসব বাজারে সিন্ডিকেটের গন্ধ পাওয়া যায়, সেসব বাজারেই হাত দিতে হবে। বড় বড় খেলোয়াড়কে চিহ্নিত করতে হবে।
সূত্র জানায়, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তাদের ঘনিষ্ঠ লোকদের দুর্নীতি ও লুটপাটের কারণে দেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ১৬০০ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। এ হিসাবে দেশ থেকে ১৫ বছরে পাচার হয়েছে ২৮ লাখ কোটি টাকা। সম্পদ পাচারের কারণে অর্থনীতি রক্তশূন্য হয়ে পড়ে। ব্যাংক খাতে তারল্য কমে যায়। রাজস্ব আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। গত সরকার সাড়ে ১৫ বছরে ছাপানো টাকায় ঋণ নিয়েছে ১ লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকা। ২০২২-২৩ এক অর্থবছরেই নিয়েছে ৯৮ হাজার কোটি টাকা। ছাপানো টাকায় সরকারের ঋণের কারণে মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে পাগলা ঘোড়ার গতিতে। বৈশ্বিক মন্দার প্রভাবে ডলারের দামও বেড়েছে। এগুলোর প্রভাব ও বাজার সিন্ডিকেটের কারণে পণ্যমূল্য বেড়েছে লাগামহীন গতিতে। এতে মূল্যস্ফীতিতে চাপ পড়ে।
পতিত সরকারের শেষ মাসে অর্থাৎ জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে সর্বোচ্চ ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশে ওঠে। এরপর থেকে নতুন সরকার নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়ায় মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে। তবে মাঝেমধ্যে ওঠানামা করেছে। জানুয়ারিতে এ হার কমে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশে নেমেছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার এখনো ডাবল ডিজিটে। বিশেষ করে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার বেশি বাড়ায় স্বল্প-আয়ের মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণের সুদ বাড়িয়েছে এবং টাকার প্রবাহ কমিয়েছে। এতে উৎপাদন খাতে টাকার জোগান কমে কর্মসংস্থান হ্রাস পেয়েছে। ফলে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার কমছে। এতে অর্থনৈতিক মন্দা আরও বেড়েছে। আবার সুদের হার কমালে এবং টাকার প্রবাহ বাড়ালে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যায়। এ কারণে সরকার এককভাবে কোনো সূচকের উন্নতির জন্য কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারছে না। আমদানি বাড়াতে গেলে ডলারের ওপর চাপ পড়ে। দাম বেড়ে গিয়ে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যায় এবং টাকার মান কমে। এমন পরিস্থিতিতে সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করে ভোক্তাকে কিছুটা উপশম দিতে চাচ্ছে। এরপর বিনিয়োগ বাড়িয়ে কর্মসংস্থান ও উৎপাদন বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিলে দেশ থেকে টাকা পাচার বহুলাংশে কমে যায়। এতে বাজারে ডলারের প্রবাহ বাড়ে। ফলে ডলার সংকট কিছুটা হলেও কেটে যায়। আগে রিজার্ভ ছিল নিম্নমুখী। এখন সেটি ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। আগে ডলারের অভাবে বৈদেশিক ঋণ শোধ করা সম্ভব হচ্ছিল না। এখন সেগুলো পরিশোধ করা হচ্ছে। সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের ফলে দেশের অর্থনীতির বৈদেশিক খাতে যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ খাতে নেতিবাচক প্রভাব আরও বেড়েছে।
আওয়ামী সরকারের সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের বড় অংশই ছিল তাদের সমর্থিত ব্যবসায়ীদের হাতে। অনেক ব্যবসায়ী পলাতক। দুর্নীতির কারণে কিছু ব্যবসায়ী গ্রুপের বিরুদ্ধে তদন্ত হচ্ছে। ফলে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এর সার্বিক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে অর্থনীতিতে। এতে বিনিয়োগ কমে গেছে।
চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বেড়েছে মাত্র ২ দশমিক ৬৭ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে বেড়েছিল ৫ দশমিক ১১ শতাংশ। বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমার কারণে এ খাতে স্থবিরতা চলছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ঋণপ্রবাহ এ খাতে বাড়তে শুরু করেছে। আগস্ট থেকে অক্টোবরে এ খাতে ঋণপ্রবাহ ছিল ১ শতাংশের কম। নভেম্বর পর্যন্ত ছিল দেড় শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংক আশা করছে, আগামী দিনে ঋণপ্রবাহ আরও বাড়বে।
এদিকে দেশীয় উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ না হওয়ায় বিদেশি উদ্যোক্তারাও এগিয়ে আসছেন না। সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ বা এফডিআই কমে গেছে। গত অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বরে এফডিআই এসেছিল ৬১ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে এসেছে ১৮ কোটি ডলার। এগুলোর বেশির ভাগই দেশে কাজ করছে-এমন বিদেশি কোম্পানিগুলোর অর্জিত মুনাফা থেকে বিনিয়োগ। পুঁজি হিসাবে নতুন বিনিয়োগ আসেনি বললেই চলে।
ডলারের সংকট কমায় আমদানিতে বিধিনিষেধ শিথিল হয়েছে। ফলে আমদানির এলসি খোলা বাড়তে শুরু করেছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বরে আমদানি বেড়েছে ৩ দশমিক ৫৩ শতাংশ। শিল্প খাতে ঋণের জোগান কমলেও কৃষি খাতে সাম্প্রতিক সময়ে ঋণপ্রবাহ বাড়তে শুরু করেছে। ফলে কৃষি উৎপাদনেও ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে। তবে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমায় শিল্পে উৎপাদন কমে যাচ্ছে। একই সঙ্গে কমছে কর্মসংস্থানের হার।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর হুন্ডির মাত্রা কমে গেছে। ফলে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে ২৩ দশমিক ৬১ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে বেড়েছিল মাত্র ৩ দশমিক ৭০ শতাংশ। পাশাপাশি রপ্তানি আয়ও বাড়ছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বরে রপ্তানি আয় বেড়েছে ১৬ দশমিক ৪৪ শতাংশ।
রেমিট্যান্স প্রবাহ এবং রপ্তানি আয় বাড়ায় দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে। এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়ন (আকু), আমদানির চলমান দায় ও বকেয়া বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের পরও দেশের রিজার্ভ বাড়ছে। বৃহস্পতিবার রিজার্ভ বেড়ে ২০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে তা ১৮ বিলিয়নের নিচে নেমে গিয়েছিল। রিজার্ভ বাড়ায় ডলারের বাজারেও স্থিতিশীলতা ফিরে এসেছে। এখন ব্যাংকে ঘোষিত দরেই ডলার বিক্রি হচ্ছে। ডলারের দাম এখন সর্বোচ্চ ১২২ টাকা। গত সরকারের আমলে ব্যাংকে ডলারের দাম ১১০ টাকা হলেও বিক্রি হতো ১৩০ থেকে ১৩২ টাকায়।
এদিকে সরকারের রাজস্ব আয় এখনো নিম্নমুখী। গত অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বরে রাজস্ব আয় বেড়েছিল ৮ দশমিক ৬৩ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তা না বেড়ে বরং কমেছে ১ শতাংশ। এ কারণে সরকারের টাকার সংকট রয়েছে। রাজস্ব আয় বাড়াতে সরকার ভ্যাট আরোপসহ কিছু খাতে সেবার ফি বৃদ্ধি করেছে। এতে পণ্যমূল্য বেড়ে যাচ্ছে।