নতুন কৌশলে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা

যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১০:৫৫ পিএম

ফাইল ছবি
রোজার আগে ফের ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা চলছে। ইতোমধ্যে ব্যবসায়ীদের সংগঠনের পক্ষ থেকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে লিটারে ১৫ টাকা বাড়ানোর জন্য প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। কার্যকর না হওয়ায় তেল কোম্পানিগুলো জোটবদ্ধ হয়ে একই সময় তেল সরবরাহ করছে না বলে অভিযোগ উঠেছে।
ফলে খুচরা বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি হয়েছে। এ সুযোগে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের গায়ের মূল্য ১৭৫ টাকা মুছে ১৯০ টাকায় বিক্রি করছেন খুচরা বিক্রেতারা। খোলা সয়াবিনের দর গিয়ে ঠেকেছে ২০০ টাকায়।
জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে আবার সয়াবিন তেলের দাম বাড়াতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব দিয়েছে ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন। লিটারপ্রতি ১৫ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। হিসাব করে ১১ টাকা বাড়ানোর পক্ষে যুক্তিতর্ক চলছে। সর্বশেষ ২৩ জানুয়ারি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বাণিজ্য উপদষ্টো শেখ বশিরউদ্দীনের বৈঠক হয়। তবে সেখানে কোনো সদ্ধিান্ত আসেনি। ব্যবসায়ীদের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের মতামত চেয়ে প্রতিবেদন দিতে বলেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সেই প্রতিবেদন এখনো জমা পড়েনি।
এদিকে মঙ্গলবার বেলা ১১টায় রাজধানীর
জিনজিরা কাঁচাবাজারে ৫টি খুচরা দোকান ঘুরে বোতলজাত সয়াবিন তেলের বোতলের গায়ে মূল্য
পাওয়া যায়নি। খুচরা বিক্রেতারা বোতলজাত তেলের বোতলের গায়ের মূল্য মুছে লিটারপ্রতি
১৮০ থেকে ১৯০ টাকায় বিক্রি করছেন। অথচ সরকার নির্ধারিত মূল্য ১৭৫ টাকা। এছাড়া খোলা
সয়াবিন প্রতি লিটার ১৯৫ থেকে ২০০ টাকায় বিক্রি করতে দেখা গেছে, যা সাতদিন আগেও ১৮০
টাকায় বিক্রি হয়েছে। এক মাস আগে দাম ছিল ১৭০ টাকা। তবে সরকার নির্ধারিত মূল্য ১৫৭ টাকা।
জিনজিরা কাঁচাবাজারের মুদি বিক্রেতা
নাজমুল (ছদ্মনাম) যুগান্তরকে বলেন, রোজার আগে সরকারিভাবে ফের সয়াবিন তেলের দাম বাড়াতে
ছয় কোম্পানি জোটবদ্ধ হয়েছে। কোম্পানিগুলো তাদের ডিলারদের মাধ্যমে খুচরা বাজারে
একসঙ্গে নয়, কয়েকদিন পরপর পর্যায়ক্রমে তেল সরবরাহ করছে। তিনি জানান, কোম্পানিগুলো
নানাভাবে বিক্রেতাদেরও চাপে ফেলে তেল বিক্রি করছে। তেল পেতে হলে এসব কোম্পানির ৮-১০টি
পণ্য নিতে বাধ্য করছে। সেক্ষেত্রে রূপচাঁদা তেল পেতে চাইলে ব্যান্ডটির ছোট-বড় সব সাইজের
সরিষার তেল নিতে হচ্ছে।
তীর সয়াবিনের সঙ্গে লবণ ও সব
ধরনের গুঁড়া মসলা নিতে হচ্ছে। পুষ্টি কোম্পানির তেল নিতে চাইলে ওই ব্যান্ডের আটা-ময়দা
নিতে হচ্ছে। ডিলারদের কাছ থেকে সান ব্যান্ডের সয়াবিন তেল পেতে হলে ওই ব্রান্ডের লবণ
নিতে হচ্ছে। কিন্তু সয়াবিন তেল ভোক্তার কাছে বিক্রির সময় এই বাড়তি পণ্য কিনতে বাধ্য
করা যাচ্ছে না। এতে লোকসান গুনতে হচ্ছে। তাই দোকানিরা লোকসান থেকে মুক্তি পেতে বোতলজাত
তেলের বোতলের গায়ের মূল্য ১৭৫ টাকা মুছে ১৮০-১৯০ টাকায় বিক্রি করছেন।
দুপুর ১টায় রাজধানীর নয়াবাজারের
৪টি দোকান ঘুরে একটি দোকানেও এক লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেলের গায়ে মূল্য লেখা দেখা
যায়নি। সরকারি মূল্য ১৭৫ টাকা নির্ধারণ করলেও বিক্রি হচ্ছে প্রতি লিটার ১৮৫-১৯০ টাকা।
আর খোলা সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১৯০-১৯৫ টাকায় বিক্রি করতে দেখা গেছে। ঠিক এমন পরিস্থিতি
মালিবাগ কাঁচাবাজারেও।
নয়াবাজরের মুদি বিক্রেতা তুহিন
যুগান্তরকে বলেন, রোজায় আরেক দফা দাম বাড়াতে ইচ্ছা করে কোম্পানিগুলো সংকট তৈরি করে
রেখেছে। কোম্পানিগুলোর ডিলাররা পরিচিত দোকান ছাড়া সয়াবিন তেল সরবরাহ করছে না। তিনি
বলেন, ২০ কার্টনের চাহিদা দিলে সরবরাহ করছে ৩-৪ কার্টন। এছাড়া তেলের সঙ্গে ৬-১০টি পণ্য
নিতে বাধ্য করছে। আর ওইসব পণ্য না নিলে তেল সরবরাহ করছে না। তিনি জানান, ভোজ্যতেল
কোম্পানিগুলো জোটবদ্ধ হয়ে একসঙ্গে বাজারে তেল সরবরাহ করছে না।
কাওরান বাজারে তীর কোম্পানির
ডিলার মোহাম্মদ সেলিম বলেন, কয়েক মাস ধরেই তেল সরবরাহ নিয়ে সমস্যা হাচ্ছে। মিল থেকে
যে পরিমাণ তেল পাচ্ছি, তা খুচরা পর্যায়ে ভাগ করে দিচ্ছি। সেক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে বেশ
কয়েকদিন পরপর তেল খুচরা পর্যায়ে সরবরাহ করতে পারছি। এদিকে গত বছর নভেম্বরের
শুরুতে অস্থিরতা শুরু হয় ভোজ্যতেলের বাজারে। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার দফায় দফায় শুল্ক
কমায়। কিন্তু এতেও তেমন কাজ হয়নি, কাটেনি অস্থিরতা ।
রমজান সামনে রেখে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেছে বাংলাদেশ ট্রড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন। সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বছরে দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে ২৩ থেকে ২৪ লাখ টন। এর মধ্যে রমজানে চাহিদার পরিমাণ ৩ লাখ টন। দেশে ১ জানুয়ারি ২০২৪ থেকে ৫ জানুয়ারি ২০২৫ পর্যন্ত আমদানি হয়েছে ১৮ লাখ ৫৭ হাজার ৫৪৮ টন। এছাড়া দেশীয়ভাবে উত্পাদন করা হয় ২ লাখ ৫০ হাজার টন। আর আমদানি পর্যায়ে এখনো পাইপলাইনে আছে ৮ লাখ ১২ হাজার ৫৬৫ টন। আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য নম্নিমুখী হওয়ায় স্থানীয় বাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের
(ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন যুগান্তরকে বলেন, সংকটের
কোনো কারণ নেই। আমরা বিগত বছরে দেখেছি দেশে ৫ থেকে ৬টি কোম্পানি সয়াবিনের দাম বাড়ানোর
প্রস্তাব দেওয়ার পর সাপ্লাই বন্ধ করে দেয়। সরকারিভাবে দাম বাড়ালেও তারা বাজারে পর্যাপ্ত
তেলের সরবরাহ করে না। রোজা ঘিরে তারা এমন কারসাজি করে।
এদিকে রোজায় ভোজ্যতেলের সরবরাহে
যাতে কোনো ধরনের ঘাটতি না হয়, সেজন্য ভোজ্যতেল কোম্পানিগুলোকে অনুরোধ করেছে জাতীয়
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলীম আখতার খান। সম্প্রতি
তেলের পরিশোধন কারখানা পরিদর্শনকালে তিনি এ অনুরোধ করেন। এছাড়া তিনি বলেন, বাজারে
অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে তদারকি চলমান আছে। মূল্য নিয়ে কারসাজিতে অসাধুদের শাসি্তর আওতায়
আনা হচ্ছে।