Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

স্বৈরাচারের ৫৭২ দোসর জামিনে মুক্ত

ফ্যাসিবাদ রক্ষায় শক্তি প্রয়োগকারীদের বিরুদ্ধে ২২৫ মামলা

Icon

সিরাজুল ইসলাম

প্রকাশ: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

স্বৈরাচারের ৫৭২ দোসর জামিনে মুক্ত

ছবি: সংগৃহীত।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ফ্যাসিবাদের দোসরদের বিরুদ্ধে রাজধানীর ৫০টি থানায় অসংখ্য মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ২২৫টিকে বিশেষ মামলা হিসাবে বিবেচনায় নিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। এসব মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ দলটির শীর্ষপর্যায়ের নেতা, সাবেক-বর্তমান আমলা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎকালীন পদস্থ কর্মকর্তা, বিতর্কিত ব্যবসায়ীসহ ভিআইপিদের আসামি করা হয়েছে। হেভিওয়েটদের পাশাপাশি প্রতিটি মামলায় আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের স্থানীয় নেতাকর্মীদের আসামি করা হয়েছে। আসামিদের অনেকেই গ্রেফতার হয়েছেন। কিন্তু আদালত থেকে জামিন পেয়ে যাচ্ছেন তারা। বিশেষ মামলাগুলোর মধ্য থেকে ২৬ জানুয়ারি পর্যন্ত জামিনে মুক্তি পেয়েছেন ৫৭২ জন। এসব মামলাসংক্রান্ত এক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে পাওয়া গেছে এসব তথ্য। এ প্রতিবেদনটি সরকারের উচ্চপর্যায়ে পাঠানো হয়েছে। 

পুলিশের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, বিশেষ মামলাগুলোয় শেখ হাসিনা সরকারের স্থানীয় নেতাকর্মীরা নিয়মিতভাবে জামিন পাচ্ছেন। এ ধারা অব্যাহত থাকলে একপর্যায়ে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতাও জামিন পেয়ে যাবেন। এতে মৃত্যু ঘটবে জুলাই-আগস্ট বিপ্লব আদর্শের। ইতোমধ্যে এর নমুনা শুরু হয়েছে। স্থানীয় নেতাকর্মীদের পাশাপাশি মুক্তি পেতে শুরু করেছেন বড় নেতারাও। ছোটদের রেফারেন্সের জেরে যেসব বড় নেতা এবং স্পর্শকাতর মামলার আসামি গত কয়েক মাসে ছাড়া পেয়েছেন, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন-সাবেক হুইপ আ স ম ফিরোজ, সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর, সচিবালয় ঘেরাওয়ে অংশ নেওয়া অন্তত ১০ আনসার সদস্য, সাবেক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী, যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও প্রেসিডিয়াম সদস্য আনোয়ারুল ইসলাম, সাবেক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ইসমাইল হোসেন (এনডিসি), ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দিলীপ কুমার আগারওয়ালা, সাবেক প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী, আওয়ামী লীগ নেতা জামাল মোস্তাফা ও তার স্ত্রী রোকেয়া জামাল, যুবলীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য মজিবুর রহমান, সাবেক এমপি গোলাম কিবরিয়া টিপু, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বান্ধবী ও সাবেক এমপি জোবেদা খাতুন পারুল, বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক রাদিউজ্জামান রাতুল প্রমুখ।

জানতে চাইলে পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট ওমর ফারুক ফারুকী যুগান্তরকে বলেন, প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে আমরা প্রতিটি মামলার আসামিদের জামিনের শতভাগ বিরোধিতা করছি। আমার অবস্থান জিরো টলারেন্স (শূন্যসহিষ্ণুতা)। ফ্যাসিস্ট সরকারের কোনো সহযোগী জামিন পেতে পারে না। তবে বিষয়টি নির্ভর করে জজদের ওপর। তারপরও বলেছি, কেউ জামিন চাইলে যেন আমার কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ফারুকী বলেন, জামিনের ক্ষেত্রে বয়স, নারী, তদন্ত কর্মকর্তার (আইও) রিপোর্ট, তদবির, অসুস্থতা, দলীয় পরিচয় প্রভৃতি বিবেচনা করা হয়। অনেক সময় তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে আসামিদের সমঝোতা হয়ে যায়। তখন তদন্ত কর্মকর্তা সাদামাটা প্রতিবেদন জমা দেন। এতে আসামির জামিন লাভ সহজ হয়। অনেক সময় আইনজীবীরা কাগজ বানিয়ে নিয়ে আসে যে, আসামি জামায়াত-বিএনপির লোক। কখনো এডিট করা ছবি আদালতে হাজির করে বলা হয়, আসামি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে মাঠে ছিলেন। এসব বিষয়ে আমি প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে জোরালোভাবে সব সময় বলে আসছি। বিভিন্ন মিটিংয়েও জজদের সামনে তুলে ধরেছি। গত শনিবারের মিটিংয়েও বলেছি। অনেক সময় জজ সাহেবরা প্রশ্ন করেন, ‘আপনারা কি ফ্যাসিস্ট সরকারের ১৫ বছরের মতো সবাইকে আটকিয়ে রাখবেন?’ 

এক প্রশ্নের জবাবে ফারুকী বলেন, বিভিন্ন জায়গা থেকে তদবিরের কারণেও আসামিরা জামিন পাচ্ছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমরা শ্যোন অ্যারেস্টও করাচ্ছি। বিষয়টি নিয়ে কী যে বিপদে আছি, বলতে পারছি না। আরও বলেন, জামিন চাওয়ার ক্ষেত্রে অনেক সময় আসামির দলীয় পদ-পদবি উল্লেখ করা হয় না। কেবল নাম-ঠিকানা উল্লেখ করা হয়। এক্ষেত্রে আসামি সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানা কঠিন হয়ে পড়ে। তিনি বলেন, মাঠ পর্যায়ে ফ্যাসিস্টের যেসব সহযোগী অপকর্ম করেছে, তাদের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট মামলা হচ্ছে না। অপরদিকে গ্রেফতার ব্যক্তিরা জামিন পেয়ে যাচ্ছেন। যে কারণে সারা দেশে তারা জেগে উঠছেন। জামিনের সময় কেউ বলছেন, ক্যানসারের রোগী, কেউ বলছেন ফুসফুসে সমস্যা, আবার কেউ বলছেন বয়সের ভারে তারা আক্রান্ত। কিন্তু বাস্তব অবস্থা এমন না। অন্দোলনকারীদের বিপক্ষে তারা ঠিকই মাঠে ছিলেন। 

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ১৯ জুলাই বিকালে ভাটারা থানাধীন ফরাজী হাসপাতালের সামনে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সোহাগ মিয়া নামের এক যুবক। এ ঘটনায় ২৮ আগস্ট তার বাবা শাফায়েত হোসেন ভাটারা থানায় হত্যা মামলা করেন। এ মামলায় সাবেক হুইপ আ স ম ফিরোজকে গ্রেফতার করা হয় ২৩ আগস্ট। দুই দফা রিমান্ড শেষে ৯ সেপ্টেম্বর আদালতে হাজির করা হলে মামলার তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত আদালত তাকে কারাগারে আটক রাখার আদেশ দেন। পরে ১৯ জানুয়ারি হাইকোর্ট তাকে জামিন দেন।

রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে ইমরান হোসেন নামে এক তরুণকে হত্যার ঘটনায় করা মামলায় সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার তানিয়া আমীরকে গ্রেফতার করেন আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা। ৫ আগস্ট সকাল ৯টায় মিছিল নিয়ে যাত্রাবাড়ী থানার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় ইমরান গুলিবিদ্ধ হন। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেওয়া হলে সন্ধ্যায় তাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা। ১ সেপ্টেম্বর ইমরানের মা কোহিনূর আক্তার বাদী হয়ে যাত্রাবাড়ী থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। ১১ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টের বিচারপতি মো. মাহমুদুল হক ও বিচারপতি শাহেদ নূরউদ্দিনের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ মামলার আসামি তানিয়া আমীরকে জামিন আদেশ দেন। ৯ সেপ্টেম্বর একই মামলায় সাবেক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু জামিন পান।

বেআইনিভাবে সমাবেশ, সচিবালয় ঘেরাও এবং পুলিশের কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে রাজধানীর শাহবাগ ও রমনা থানায় কয়েক হাজার আনসার সদস্যকে আসামি করে মামলা হয় হয় ২৬ জুলাই। এ দুটি মামলায় ইতোমধ্যে অনেক আনসার সদস্য জামিন পেয়ে গেছেন। যারা জামিন পেয়েছেন, তাদের মধ্যে রমনা থানার মামলার আসামি রোকসানা খাতুন, লাবনী আক্তার, সুমন মিয়া, মো. শামীম, সুজন মিয়া, শরিফুল ইসলাম, শাহবাগ থানার মামলার আসামি আশরাফুল ইসলাম, রাশেদুল ইসলাম, মো. হাসমত প্রমুখ। 

সাবেক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরীকে ৬ অক্টোবর গুলশানের একটি বাসা থেকে আটক করে পুলিশ। পরে তাকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহতের ঘটনায় খিলগাঁও থানায় করা চারটি এবং পল্টন থানার দুটি হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। এর তিনদিনের মধ্যে ৮ অক্টোবর সব মামলায় পৃথক আদালত থেকে জামিন পান তিনি। যখন তাকে জামিন আদেশ দেওয়া হয়, তখন তিনি রিমান্ডে ছিলেন। সাবের হোসেন চৌধুরীর গ্রেফতার, রিমান্ড ও জামিনের বিষয়টি দেশব্যাপী ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল। 

যাত্রাবাড়ী থানার একটি হত্যা মামলায় ১৫ সেপ্টেম্বর সাবেক বিমান ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলীকে গ্রেফতার করা হয়। ১ ডিসেম্বর তিনি জামিনাদেশ পান। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলার অভিযোগে যুবলীগের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও প্রেসিডিয়াম সদস্য আনোয়ারুল ইসলামকে ১ অক্টোবর গ্রেফতার করা হয়। এর দুই সপ্তাহের মধ্যেই তিনি জামিন পেয়ে যান। ১৫ অক্টোবর তাকে জামিন দেন ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মাহবুবুল হক। 

১৯ ডিসেম্বর বিদেশে যাওয়ার সময় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় সাবেক সচিব ইসমাইল হোসেনকে আটক করে পুলিশ। পরে তাকে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে করা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। ৬৫টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের ৪৩ কোটি টাকা সন্দেহজনক লেনদেনের সঙ্গে ইসমাইল হোসেনের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এই অভিযোগে তাকে রিমান্ডেও নেওয়া হয়। ইতোমধ্যে তিনি জামিন পেয়েছেন বলে আদালত সূত্র জানিয়েছে।

২৩ আগস্ট বাড্ডা থানায় করা একটি হত্যা মামলায় ৩ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার করা হয় ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দিলীপ কুমার আগারওয়ালাকে। ২৪ ডিসেম্বর ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক মনিরুল ইসলাম তার জামিন দেন। তেজগাঁও থানার একটি মামলায় গ্রেফতার করা হয় যুবলীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য মজিবুর রহমানকে। ১৪ অক্টোবর তাকে জামিন দেন মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ আসসামছ ও জগলুল হোসেন। আইনজীবী ছিলেন রতন কুমার অধিকারী। 

পল্টন থানার যুবদল নেতা শামীম হত্যা মামলায় সাবেক প্যানেল মেয়র, কাফরুল আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক কাউন্সিলর জামাল মোস্তফা এবং তার স্ত্রী মহিলা লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রোকেয়া জামালকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। ২৩ জানুয়ারি এ দুজন হাইকোর্ট থেকে জামিন পান। তাদের পক্ষে জামিন শুনানিতে অংশ নেন অ্যাডভোকেট শুভ্র সিনা রায়। 

হাতিরঝিল থানায় করা মামলায় সাবেক সংসদ-সদস্য গোলাম কিবরিয়া টিপুকে ১৪ নভেম্বর গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের এক মাসের মধ্যেই গত ৫ ডিসেম্বর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের অবকাশকালীন জজ তার জামিনাদেশ দেন। 

১১ ডিসেম্বর মিরপুর মডেল থানায় দায়ের করা একটি মামলায় গ্রেফতার হয়েছিলেন সাবেক সংসদ-সদস্য, মহিলা আওয়ামী লীগ কুমিল্লার সভাপতি, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বান্ধবী জোবেদা খাতুন পারুল। ঢাকা মেট্রোপলিটন আদালতের বিচারক শরীফুর রহমান ১৭ ডিসেম্বর তাকে জামিন দেন। একই থানায় দায়ের হওয়া ৩ সেপ্টেম্বরের একটি মামলায় গ্রেফতার হন বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক রাদিউজ্জামান ওরফে রাতুল। ২৪ ডিসেম্বর ঢাকার অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের অবকাশকালীন জজ মো. ইব্রাহিম মিয়া তাকে জামিন দেন।

জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার শেখ সাজ্জাত আলী যুগান্তরকে বলেন, জামিনের বিষয়ে আমাদের কোনো হাত নেই। এটা আদালতের বিষয়। তিনি বলেন, মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা যখন দেখেন গ্রেফতার আসামিরা দ্রুত সময়ের মধ্যে জামিন পেয়ে যাচ্ছে, তখন তাদের মধ্যে একধরনের হতাশা তৈরি হয়। অনেক পুলিশ কর্মকর্তা তাদের হতাশার কথা জানিয়েছেন। বিষয়টি সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষকেও জানানো হয়েছে।


Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম