‘মরলে শহিদ হব’ মাকে নাঈমুরের শেষ কথা
লাশের স্তূপ থেকে ছেলেকে শনাক্ত
ইমন রহমান
প্রকাশ: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহিদ মো. নাঈমুর রহমান।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন মা-বাবার বাধা উপেক্ষা করে প্রতিদিন অংশ নিতেন মো. নাঈমুর রহমান (২২)। মাকে বলতেন, ‘তোমরা দেখবে, স্বৈরাচারের পতন হবেই।’ পতন ঠিকই হলো কিন্তু দেখে যেতে পারলেন না নাঈমুর। স্বৈরাচারের বুলেটের আঘাতে নিভে যায় তার প্রাণপ্রদীপ। শেষবার যখন তিনি বাসা থেকে বের হন তখন মাকে বলেছিলেন, ‘আমার সহপাঠীরা আন্দোলনে যাচ্ছে, আমি ঘরে থাকতে পারব না। আমি যদি মরেও যাই শহিদি মর্যাদা পাব।’
রাজধানীর গুলশান ডিগ্রি কলেজের প্রথমবর্ষের ছাত্র ছিলেন নাঈমুর। তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার বড়। পড়ালেখার পাশাপাশি তেজগাঁওয়ে নর্থ ইন্ড কফি রেস্তোরাঁয় পার্টটাইম কাজ করতেন। স্বজনরা জানান, ১৯ জুলাই সকালে বাসা থেকে বের হয়ে আর ফেরেননি তিনি। ওই দিন বিকাল সাড়ে ৪টায় শাহজাদপুরে বুকে গুলিবিদ্ধ হন নাঈমুর। স্থানীয়রা তাকে উত্তর বাড্ডার এ এম জেড হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। খবর পেয়ে মা-বাবা, ভাই ছুটে যান হাসপাতালে। লাশ নিয়ে গুলশানের কালাচাঁদপুরের বাসায় ফেরার পথে বিভিন্ন স্থানে বাধার মুখে পড়েন তারা। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের হামলায় আহত হন নাঈমুরের ভাই সাইমুর রহমান। পরে গ্রামের বাড়ি মাদারীপুরের শিবচরে নাঈমুরকে দাফন করা হয়।
২৬ জানুয়ারি দুপুরে রাজধানীর কালাচাঁদপুর পশ্চিমপাড়ার ক/৮১ নম্বর বাসায় গিয়ে কথা হয় শহিদ নাঈমুরের পরিবারের সঙ্গে। ভবনটির দ্বিতীয়তলায় দুই রুমের ছোট একটি ফ্ল্যাটে থাকেন নাঈমুরের মা-বাবা ও ছোট দুই ভাই। ছেলেকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ মা নাছিমা। ছেলের স্মৃতি আঁকড়ে থাকেন সারা দিন। কারও সঙ্গে ঠিকমতো কথা বলেন না। নাঈমুরের বিষয়ে জানতে চাইলে অঝোরে কাঁদেন। দিশাহারা বাবা মো. খলিলুর রহমানও। প্রাইভেটকার চালিয়ে তিলতিল করে ছেলেকে বড় করেছেন।
খলিলুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, আমি ২২ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করি। সেই টাকায় কোনো মতে টেনেটুনে সংসার চালাই। নাঈমুর পার্টটাইম কাজ করে আমাকে সহযোগিতা করত। সে ছিল আমার বেঁচে থাকার অবলম্বন। দুই ছেলেকে নিয়ে আর্থিক কষ্টের মধ্যে আছি। নাঈমুরের মৃত্যুর পর মেঝ ছেলে সাইমুরের পড়ালেখা বন্ধ হয়ে গেছে। তাকে একটি কফিশপে কাজে দিয়েছি।
ঘটনার দিনের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ১৯ জুলাই সকালে আমি নাঈমুরকে বলেছিলাম, দেশের পরিস্থিতি ভালো না। তুমি রাস্তায় যেও না। তার মাও বাধা দিয়েছিল। কিন্তু সে কারও কথা শোনেনি। তিনি আরও বলেন, বিকালে আমার ছেলের মোবাইল থেকে একটি ফোন আসে। জানায়, সে গুলিবিদ্ধ হয়েছে। হাসপাতালে যাওয়ার পথে রাস্তায় ছিল প্রচণ্ড গুলির শব্দ আর কাঁদানে গ্যাস। লাশঘরে ৮/১০টি লাশের মধ্য থেকে নাঈমুরের লাশ শনাক্ত করে তার মা।
নাঈমুরের ভাই সাইমুর রহমান বলেন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলেছিল, এখানে পরিস্থিতি খারাপ। লাশ বেশিক্ষণ রাখা যাবে না। আপনারা লাশ নেওয়ার ব্যবস্থা করেন। হাসপাতাল থেকে অ্যাম্বুলেন্স চাইলে তাও দেওয়া হয়নি। পরে অটোরিকশায় ভাইয়ের এক সহকর্মী আর আমি লাশ নিয়ে বাসার উদ্দেশে রওনা দিই। আমার হাতের ওপর ছিল ভাইয়ের শরীর। তার নাক দিয়ে অনবরত রক্ত বের হচ্ছিল। পথে নতুন বাজারে প্রচণ্ড গোলাগুলির মধ্যে পড়ি আমরা। ইট এসে লাগতে থাকে রিকশায়। পরে কিছু সময় রিকশা ঘুরিয়ে হুড তুলে দাঁড়িয়ে থাকি। সন্ধ্যায় নর্দা এলে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা আমাদের ওপর হামলা করে। আমার হাতে প্রচণ্ড আঘাত করে। অনেক কষ্টে লাশ ধরে রেখেছিলাম।
এদিকে নাঈমুর হত্যার ঘটনায় বাবা খলিলুর রহমান বাদী হয়ে গুলশান থানায় ৬৪ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা ৪০০-৫০০ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন। মামলায় শেখ হাসিনাকে এক নম্বর আসামি করা হয়।