জেলার প্রধান সমস্যা ডিসি-এসপি দ্বন্দ্ব
ডিসিরা জনসেবক হবেন কবে
১৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠেয় সম্মেলনে উঠছে ৩ শতাধিক প্রস্তাব: ১৫ বছরে ২২৫০ প্রস্তাবের ৭০ শতাংশ অবাস্তবায়িত * ডিসি-এসপির ছায়া দ্বন্দ্বে জনস্বার্থ বিঘ্নিত হচ্ছে-মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
প্রতিবছর ঢাকঢোল পিটিয়ে জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। ঢাকায় ৩ দিনের জন্য চলে আসেন দেশের সব বিভাগীয় কমিশনার ও ডিসি। বিভিন্ন কর্মসূচিতে মন্ত্রণালয় ও বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারের শীর্ষ নীতিনির্ধারক ও সচিবরা অংশ নেন। শুধু তাই নয়, রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানের সঙ্গেও থাকে বিশেষ অধিবেশন। সবমিলিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা ব্যয়ে এমন গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম থেকে উঠে আসে মাঠপর্যায়ের নানা সমস্যা সমাধানে একগুচ্ছ প্রস্তাব। কিন্তু বছর শেষে দেখা যায় এর প্রাপ্তি খুবই সামান্য। গত ১৫ বছরে দেওয়া এসব প্রস্তাব বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২২৫০টি প্রস্তাবের মধ্যে বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ৭০ শতাংশ। যা খুবই হতাশাজনক বলে মন্তব্য করেছেন জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, অধিকাংশ ডিসি জনসেবার পরিবর্তে রাজনীতিবিদদের বিশেষ সেবা নিয়েই ব্যস্ত সময় কাটান। আর তাদের কাছ থেকে জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রস্তাবও কম আসছে। সবমিলিয়ে ডিসিরা যাতে প্রকৃত জনসেবক হয়ে উঠতে পারেন, সে ব্যাপারে নিজেদের আন্তরিকতা বাড়ানোসহ সরকারের তরফ থেকেও প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি রাজনৈতিক বিবেচনায় ডিসি নিয়োগ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করতে হবে। তবে ব্যতিক্রমও আছে; দেখা গেছে কোনো কোনো ডিসি স্থানীয়ভাবে এমন জনপ্রিয় যে, তারা যখন অন্যত্র বদলি হয়ে যান, তখন স্থানীয়রা তাকে জেলায় রাখার জন্য মানববন্ধনও করেন। ডিসিদের এমন সেবকই হওয়া জরুরি।
বিশেষজ্ঞদের আরও অভিমত-জেলায় ডিসি ও পুলিশ সুপারের (এসপি) মধ্যে ছায়া দ্বন্দ্ব চলছে যুগ যুগ ধরে এবং কেউ কাউকে পাত্তা দিতে চান না। জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির মিটিংয়ে অনুপস্থিত থাকেন এসপি। ডিসি-এসপির ছায়া দ্বন্দ্বে জেলার সেবামূলক কার্যক্রমের স্বাভাবিক গতিও চরমভাবে বিঘ্নিত হয়। এরমধ্যে ১৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠেয় ৩ দিনের সম্মেলনে যে তিন শতাধিক প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে কোনো কোনো প্রস্তাব ডিসি-এসপির ছায়া দ্বন্দ্ব উসকে দেবে। যেমন-এসপির এসিআর দেওয়ার ক্ষমতা পুনর্বহাল, অপরাধ ও এনআইডি সার্ভারে প্রবেশাধিকার ও ডিসির অধীনে বিশেষ ফোর্স গঠন।
সাবেক সিনিয়র সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান যুগান্তরকে বলেন, সমালোচনা, সীমাবদ্ধতা এবং কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি সত্ত্বেও ডিসি সম্মেলনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সম্মেলনে ডিসিরা মাঠের প্রকৃত চিত্র সরকারের নীতিনির্ধারকদের সামনে তুলে ধরতে পারেন। একেবারে সামনাসামনি পয়েন্ট টু পয়েন্ট কথা বলতে পারেন। রাজনৈতিক সরকারের সময় ডিসি ও উপজেলা নির্বাহী অফিসাররা (ইউএনও) দলীয় নেতাদের ব্যাপকভাবে বাধা-বিপত্তির মুখে পড়েন। তারা এসব বিষয় অনেক সময় সরকার প্রধান কিংবা মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের জানাতে পারেন না। এ সম্মেলনে সেই সুযোগ তৈরি হয়। ডিসি সম্মেলনের প্রস্তাব বাস্তবায়ন না হওয়া প্রসঙ্গে সাবেক এই সচিব বলেন, ডিসিদের প্রস্তাব বাস্তবায়ন সরকারের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করে। তিনি আরও বলেন, সম্মেলনে এক মাসের মধ্যে কোন কোন প্রস্তাব বাস্তবায়নযোগ্য তা তালিকা করে বাস্তবায়নে নেমে পড়া উচিত। ডিসি সম্মেলনের অর্জন নিয়ে জানতে চাইলে সাবেক সচিব একেএম আবদুল আউয়াল মজুমদার যুগান্তরকে বলেন, জেলায় ডিসি এবং এসপি পরস্পরকে কন্ট্রোল না করে কো-অর্ডিনেশন করলে ফলাফল ভালো হবে। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, এসপি জেলার বাইরে গেলে ডিসিকে বলে যাবেন। আবার ডিসি কোনো থানা পরিদর্শনে গেলে এসপিকে বলে যাবেন। এটা পারস্পরিক সু-সম্পর্কের ওপর নির্ভর করে। ডিসি সম্মেলনে উত্থাপন করা প্রস্তাব বাস্তবায়নের হার কম হয় জানিয়ে সাবেক এই সচিব বলেন, অনেক মন্ত্রী, উপদেষ্টা ও সচিব মাঠের সমস্যা আমলে নিতে চান না। রাজনৈতিক নেতারা মাঠের সমস্যা বুঝেও না বোঝার ভান করেন। সুতরাং বাস্তবায়নের সঙ্গে ডিসি জড়িত নন। সাবেক সচিব আনোয়ার ফারুক যুগান্তরকে বলেন, ডিসি সম্মেলনের দরকার আছে এবং থাকবে। তবে রাজনৈতি বিবেচনায় ডিসি নিয়োগ বন্ধ করতে হবে। দলীয় পরিচয় দেখে ডিসি নিয়োগ দিলে জনসেবা হবে না। ডিসিরা জনসেবার পরিবর্তে রাজনীতিবিদদের সেবা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। নেতাদের সেবা দিতে পারলে অর্থকড়ি আয় করা যায়, দাপটের সঙ্গে চলা যায়, পদোন্নতি এবং ভালো পোস্টিং পাওয়া যায়। তখন কি আর জনসেবার কথা মনে থাকে? তখন ডিসিরা ক্ষমতা চর্চায় নেমে পড়েন। রাজনীতিবিদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে কোনো কর্মচারীকে দলীয়ভাবে ব্যবহার করব না। সুতরাং রাজনৈতিক শক্তির চিন্তা ও মননে পরিবর্তন হলে মাঠের অনেক সমস্যা চিরতরে শেষ হয়ে যাবে। সরকারের সচিচ্ছা থাকতে হবে প্রশাসনকে দলীয় বিবেচনায় ব্যবহার করব না।
জানতে চাইলে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া যুগান্তরকে বলেন, নানা সীমাবদ্ধতা ও সমালোচনা সত্ত্বেও ডিসি সম্মেলনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কারণ রাষ্ট্রের অনেক গোপন বিষয় থাকে যা পত্র অথবা বাহক মারফত ডিসির কাছে পৌঁছানো যায় না। এ সম্মেলনের মাধ্যমে তা সরাসরি বলা হয়। তাছাড়া সম্মেলনের মাধ্যমে ডিসিদের মধ্যে পারস্পরিক চিন্তার বিনিময় হয়। ফিরোজ মিয়া বলেন, সম্মেলনের পরপর ডিসি পরিবর্তনের ঘটনা কম। জেলা পরিবর্তন হলে সমস্যা নেই। কিন্তু যদি প্রত্যাহার করা হয় তাহলে সমস্যা হতে পারে। তিনি আরও বলেন ডিসিদের কাছ থেকে জনসেবা ও জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রস্তাব কম আসে। এটা বাড়াতে হবে। জেলায় ডিসি ও এসপির দ্বন্দ্বের বিষয়ে ফিরোজ মিয়া বলেন এটা দ্রুত নিরসন হওয়া জরুরি। দীর্ঘমেয়াদে পরস্পরকে উপেক্ষার ফল ভালো হয় না।