Logo
Logo
×

জাতীয়

রেলের রানিং স্টাফদের আন্দোলন

‘মাইলেজ-সুবিধা’ আদায়ে যাত্রী জিম্মির কৌশল

শিপন হাবীব

শিপন হাবীব

প্রকাশ: ২৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১১:৪২ পিএম

‘মাইলেজ-সুবিধা’ আদায়ে যাত্রী জিম্মির কৌশল

ফাইল ছবি

ট্রেন যাত্রী ‘জিম্মি’ নাটকের অবসান হলো। এমন বক্তব্য, সাধারণ ট্রেন যাত্রীদের। গত সোমবার থেকে বুধবার ভোর রাত পযর্ন্ত রানিং স্টাফরা ‘কর্মবিরতি’র নামে সব ধরনের ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেয়। এতে পুরো রেলপথ স্থবির হয়ে পড়ে। প্রায় ৩০ ঘন্টা পর বুধবার ভোররাত থেকে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হলেও শিডিউল বিপর্যয় লেগেই আছে। রানিং স্টাফদের দাবি অনুযায়ী, বুধবার ‘মাইলেজ-সুবিধা’ বাড়ানোর প্রজ্ঞাপন জারি করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এতে রানিং স্টাফদের আংশিক দাবি পূরণ হয়েছে জানিয়ে রানিং স্টাফ নেতারা বলছেন, ‘একটি দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে। আমরা আশা করছি দ্রুত সময়ের মধ্যে বাকি দাবিগুলো মেনে নেওয়া হবে’। এদিকে ট্রেন যাত্রীদের অভিযোগ, যাত্রী জিম্মি করে দাবী আদায়ের যে কৌশল স্থাপিত হল-এর মাসুল আগামীতেও সাধারণ ট্রেন যাত্রীদের দিতে হবে। 

এ প্রসঙ্গে বুধবার সন্ধ্যা পৌনে ৭টায় রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান যুগান্তরকে বলেন, আমরা ট্রেন যাত্রীদের সেবা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে সময় অনুযায়ী ট্রেন চালাতে চাই। যাত্রীদের দুর্ভোগ হবে, এমন কোনো কর্মসূচি দেওয়া একেবারেই উচিত নয়। আলোচনার মাধ্যমে যে কোনো সমস্যা সমাধান সম্ভব। আমরা রানিং স্টাফদের দাবি মেনে নিয়েছি। স্টাফরাও কর্মবিরতি প্রত্যাহার করে নিয়েছে। আমরা তাদের সাফ জানিয়ে দিয়েছি, যাত্রীদের জিম্মি করে আর কোনো কর্মসূচি করা যাবে না। আলোচনা হবে, আলোচনায় সমাধান হবে। রানিং স্টাফ নেতারাও আমাদের কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তাদের দাবি আদায়ে যাত্রী জিম্মি করা, ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেওয়ার মতো আর কোন কর্মসূচি দেবেন না। 

বুধবার বিকাল সাড়ে ৫টায় বাংলাদেশ রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি সাইদুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, আমাদের পিঠ দেয়ালে লেগে গিয়েছিল। প্রায় সাড়ে ৩ বছর ধরে আমাদের দাবি পূরণে আওয়ামী লীগ সরকারের রেলপথ মন্ত্রী-সচিব-রেলওয়ে মহাপরিচালক প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভাঁওতাবাজি করেছে। কর্মবিরতি এবং ট্রেন চলাচল বন্ধের মতো কর্মসূচি এর আগেও বহুবার দেওয়া হয়েছে। আমাদের ন্যায্য দাবি আদায়ে আন্দোলন করেছি। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা-সচিবসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা, তারা আমাদের দাবিগুলো মেনে নিচ্ছেন। আমরাও চাই না, যাত্রী জিম্মি করে এমন কর্মসূচি করার। ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকায় যাত্রীরা চরম দুর্ভোগের শিকার হয়। এজন্য আমরা ট্রেন যাত্রীদের কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। আমাদের এমন কর্মসূচির জন্য সাধারণ যাত্রীরা চরম দুর্ভোগে পড়ে, এতে নিশ্চয়ই ঠিক হয়নি। যাত্রী জিম্মি হবে, এমন কর্মসূচি আমরা আর করতে চাই না’। 

রেলওয়ে অপারেশন ও পরিবহণ দপ্তর সূত্র বলছে, একদিন সব ধরনের ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকলে প্রায় ৬ কোটি টাকা লোকসান হয়। এছাড়া ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয় চরমে ওঠে। ওই শিডিউল বিপর্যয় ঠিক হতে অন্তত ৩/৪ দিন লেগে যায়। এতে যাত্রীদের দুর্ভোগ লাগাতারই সৃষ্টি হয়। রানিং স্টাফদের যে সমস্যা-তা সমাধান হলে প্রতি বছর মাত্র আড়াই কোটি টাকা অতিরিক্ত প্রদান করতে হবে। আর তাদের আন্দোলনের কারণে একদিন ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকলে-ক্ষতি হয় প্রায় ৬ কোটি টাকার। রানিং স্টাফদের দাবি পূরণে বিগত সরকার রাজনৈতিক খেলা খেলেছে। প্রতি শ্রুতি দিয়ে দিয়ে স্টাফদের পদে পদে বঞ্চিত করা হয়েছে। রেলে বর্তমানে ৪৮ শতাংশ রানিং স্টাফ স্বল্পতা রয়েছে। ৫২ শতাংশ লোকবল দিয়ে শতভাগ লোকের কাজ করানো হচ্ছে। ৮ ঘন্টা কাজের স্থালে কোনো কোনো স্টাফ ১৩ থেকে ১৯ ঘন্টা পর্যন্ত কাজ করছে। অতিরিক্ত কাজের আর্থিক নিশ্চয়তা প্রদানে আন্দোলন করে আসছিল স্টাফরা। এখন থেকে স্টাফরা রেলওয়ের এস্টাবলিশমেন্ট কোডের বিধান অনুযায়ী রানিং অ্যালাউন্স প্রাপ্য হবেন।

এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ে মাকেটিং অ্যান্ড কর্পোরেট প্ল্যানিং দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, এমনিতেই রেলে লাগাতার লোকসান আর অনিয়ম-দুর্নীতির খবর বেশ এগিয়ে থাকে। যাত্রী সেবা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে অভিযোগের অন্ত নেই। আবার ঊনিশ থেকে বিশ হলে লাইনচ্যুত-দুর্ঘটনা ঘটছেই। তাছাড়া সময় না মেনে ট্রেন চলা এক প্রকার নিয়মে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে রেলওয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নানান দাবি আদায়ে ‘যাত্রী জিম্মি’ করার মতো কর্মসূচি হরহামেশাই হয়। আবার নানা কৌশলে যখন ‘কর্মরিরতি’র মতো কঠোর কর্মসূচি পালিত হয়, তখন যাত্রীদের দুর্ভোগ একেবারেই চরমে উঠে। গত দুই দিন রেলওয়ে রানিং স্টাফদের কর্মবিরতি’র নামে সব ধরনের ট্রেন চলাচল বন্ধের ঘোষণা পুরো রেলকে স্থবির করে দেয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ট্রেন যাত্রী জানান, রেলে সেবা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে কারো খেয়াল নেই। ট্রেন চলাচলে বিলম্ব, বিকল ফ্যান-বাতি, দূরপাল্লার ট্রেনে নিম্মমানের খাবার, অপরিচ্ছন্ন শৌচালয়, ঢিলেঢালা নিরাপত্তা-অভিযোগ রয়েছে ভুরিভুরি। অন্তবর্তী সরকারের রেলওয়ে উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান যাত্রী সেবা ও নিরাপত্তা মানোন্নয়নের ওপর জোর দিয়েছেন। কিন্তু, রেল পরিচালনায় আওয়ামী লীগ সমর্থিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নানা অনিহার কারণে ট্রেন পরিচালনায় সেবা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। পঞ্চগড়গামী যাত্রী বিল্লাল হোসেনের ভাষ্য, রেলে উন্নয়নে নিয়ে সবচেয়ে বেশি অনিয়ম-দুর্নীতির প্রমাণ রয়েছে। উন্নয়ন হচ্ছেও। কিন্তু সময়ে ট্রেন চলার দাবি সকলের অগোচরেই থেকে যায়। এক একটি স্টেশনে দুগর্ন্ধে দাঁড়ানো দুস্কর। প্রতিটি স্টেশন চত্বর ও ট্রেনে পরিচ্ছন্নতা প্রয়োজন। 

কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন যুগান্তরকে জানান, প্রায় ৩০ ঘন্টা ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকায়, ট্রেনের শিডিউল এখনও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। বুধবার সন্ধ্যার দিকেও কিছু কিছু দূরপাল্লার ট্রেন ২ ঘণ্টা থেকে সাড়ে ৩ ঘন্টা বিলম্বে চলাচল করেছে। রানিং স্টাফদের আন্দোলনের কারণে সোমবার থেকে বুধবার মধ্যরাত পযর্ন্ত সব ধরনের ট্রেনের যাত্রা বাতিল করা হয়। এতে টিকিটধারীদের অধিকাংশই টিকিট ফেরত দিয়ে টিকিটের সমপরিমাণ টাকা নিয়ে গেছেন। ফলে লাখ লাখ টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে রেলের। ট্রেন বিলম্বে চলাচল শুধু ঢাকা থেকে নয়, রাজশাহী, সিলেট, চট্টগ্রাম থেকেও বেশ কিছু ট্রেন বিলম্বে চলাচল করছে। আমরা আশা করছি দ্রুত সময়ের মধ্যেই শিডিউল ঠিক হয়ে যাবে।

বুধবার রাত সাড়ে ৭টায় বাংলাদেশ প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর অধ্যাপক ড. এম শামসুল হক যুগান্তরকে বলেন, রানিং স্টাফদের এ আন্দোলন প্রায় ৪ বছর আগের। আওয়ামী লীগ সরকার গত ১৬ বছরের রেলে যে উন্নয়ন করেছে, তার আয় ও সেবা চোখে পড়ছে না। বরং দিন দিন লোকসানের পাল্লা ভারি হচ্ছে। রেলের শ্রমিকদের দাবি পূরণে একটি সেল হতে পারে। কোনো অবস্থাতেই যেন যাত্রী জিম্মি করে দাবি আদায় না করতে হয়। ঘেরাও-ট্রেন বন্ধ-অবরোধ দাবি আদায়ের মাধ্যম হতে পারে না। তবে রেলের শ্রমিকরা দেখছে-উন্নয়নের নামে অনিয়ম দুর্নীতি। তারা আয় করছে, আর মন্ত্রী থেকে শুরু করে ক্ষমতাসীন দলের ‘উপরের’ বড় কর্তা পযর্ন্ত লুটপাটের অংশ ভাগ করে নিচ্ছে। এতে শ্রমিকরা ক্ষুব্ধ হয়। ন্যায্য দাবি আদায়ে সোচ্চার হয়। সময় এসেছে রেলে পরিকল্পনা অনুযায়ী উন্নয়নের। আর যে সব প্রকল্পে ঘিরে অনিয়ম-দূর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত, সেই প্রকল্পে সংশ্লিষ্টদের আইনের আওতায় আনতে হবে। এতে করে শ্রমিকরা নমনীয় হবে। দাবী আদায়ে ক্ষিপ্ত হবে না। নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করবে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম