হাসিনার পাতানো ভাতিজা আর্থিক খাতের মাফিয়া, কে এই সরাফাত?
যুগান্তর ডেস্ক
প্রকাশ: ২৯ জানুয়ারি ২০২৫, ০৩:১৮ পিএম
ফাইল ছবি
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরই আত্মগোপনে চলে যান সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত এবং তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী, সাধারণ ব্যাংকার ও ব্যবসায়ী চৌধুরী নাফিজ সরাফাত। ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি ও অর্থ লোপাটের জন্য তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
অনুসন্ধান চলমান অবস্থায়ই গত ২৩ সেপ্টেম্বর দেশ ছেড়ে সপরিবারে পালিয়ে গেছেন সরাফাত। এমিরেটস এয়ারলাইন্সের ইকে-৩৭৩ ফ্লাইটে তার দেশত্যাগের ছবিও পেয়েছে যুগান্তর।
দরবেশখ্যাত সালমান এফ রহমানের হাত ধরে উত্থানের শুরু হয় সরাফাতের। হাসিনার অর্থমন্ত্রী লোটাস কামাল ছিলেন তার ‘পাতানো’ চাচা এবং হাসিনা নিজে ছিলেন পাতানো ফুফু। অন্যদিকে সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদকে পরিচয় দিতেন নিজের চাচাতো ভাই হিসেবে।
এসব ‘পাতানো’ সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে তাদের বিক্রি করে সরাফাত যখনই যে কাজে হাত দিয়েছেন, সেখানেই সফল হয়েছেন; গড়ে তুলেছেন বিপুল সম্পদ।
চাচা-ফুফুর বদৌলতে ২০০৯ থেকে ২০১৯ সালে এই দশ বছরে নাফিজ সরাফাত বনে যান দেশের ‘প্রভাবশালী’ ব্যক্তি।
সরাফাত ছিলেন দেশের আর্থিক খাতের অন্যতম প্রভাবশালী মাফিয়া। বাড়ি গোপালগঞ্জে হওয়ার সুবাদে আওয়ামী লীগ সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাও ছিল তার। হাসিনার সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে সরাফাত দিন দিন অত্যন্ত প্রভাবশালী ও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন।
আওয়ামী লীগের সময় আর্থিক খাতে সুবিধা পাওয়া সরাফত ও তার পরিবারের বাড়ি, জমি ও ১৮টি ফ্ল্যাট ক্রোকের আদেশ দিয়েছেন আদালত।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদনে গত ৭ জানুয়ারি মহানগর দায়রা জজ জাকির হোসেন গালিব এ আদেশ দেন।
দুদকের অনুসন্ধান দলের প্রধান সংস্থার উপপরিচালক মাসুদুর রহমান বিতর্কিত ব্যবসায়ী সরাফাত ও তার পরিবারের এসব স্থাবর সম্পদ ক্রোকের আবেদন করেন। দুদকের পক্ষে শুনানি করেন মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর। পরে আদালত এসব সম্পদ ক্রোকের আদেশ দেন।
সরাফাত, তার স্ত্রী আঞ্জুমান আরা ও তার ছেলে রাহিবের নামে দেশের বিভিন্ন স্থানে স্থাবর সম্পত্তির তথ্য পাওয়া গেছে। সরাফাতের নামে গুলশানে ২০ তলা একটি বাড়ি রয়েছে।
তার ফ্ল্যাট রয়েছে- গুলশানে একটি, ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট বাজার এলাকায় চারটি, নিকুঞ্জ উত্তর আবাসিক এলাকায় একটি ও বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় একটি ফ্ল্যাটের ৫০ শতাংশ। প্লট রয়েছে নিকুঞ্জে দুইটি, গাজীপুরের কালিয়াকৈরে ১০ কাঠা করে দুইটি, রাজউকের পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে সাড়ে ৭ কাঠার একটি।
এছাড়া বাড্ডার কাঠালদিয়ায় আড়াই কাঠা, গাজীপুর সদরে ৮ দশমিক ২৫ শতাংশ, জোয়ার সাহারায় ৪ দশমিক ৯৫ শতাংশ জমি রয়েছে তার।
সরাফাতের স্ত্রী আঞ্জুমান আরা সাহিদের নামে রয়েছে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় সাড়ে সাত কাঠা জমির ওপর চারতলা বাড়ি, পান্থপথে একটি, গুলশান লিংক রোডে একটি, মিরপুর ডিওএইচএস এ একটি, শাহজাদপুরে একটি ও বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় একটি ফ্ল্যাটের ৫০ শতাংশ।
এছাড়া তার নামে নিকুঞ্জে তিন কাঠা জমি, বাড্ডার কাঠালদিয়ায় আড়াই কাঠা নাল (আবাদি) জমি ও গাজীপুর সদরে ৮ দশমিক ২৫ শতাংশ চালা (উঁচু) জমি রয়েছে।
ছেলে চৌধুরী রাহিব সাফওয়ান সরাফাতের নামে থাকা বনানীর তিনটি ও বারিধারার চারটি ফ্ল্যাট জব্দের আদেশ দিয়েছেন আদালত।
কে এই সরাফাত
দেশের ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক খাতে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আলোচিত ব্যক্তিদের অন্যতম একজন চৌধুরী নাফিজ সরাফাত। ১৯৯৯ সালে বিদেশি স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকে চাকরিজীবন শুরু হয় তার। পরে এই সুবাদে পরিচয় হয় সালমান এফ রহমানের সঙ্গে। সালমানের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠায় একটি বিদেশি ব্যাংকের চাকরিজীবী হয়েও আরেকটি বেসরকারি ব্যাংক আইএফআইসির স্বতন্ত্র পরিচালক হন তিনি।
এক ব্যাংকে চাকরি আর অন্য ব্যাংকে পরিচালকের মাধ্যমেই আলোচনায় আসেন সরাফাত। ২০০৮ কনজ্যুমার ব্যাংকিংয়ের প্রধান হিসেবে তিনি যোগ দেন আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকে। সেখানে থাকা অবস্থায় একটি মিউচুয়াল ফান্ডের লাইসেন্স নেন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) থেকে। তার কোম্পানির নাম বাংলাদেশ রেস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট।
এর মাধ্যমেই শেয়ারবাজার কারসাজির একজন হোতা বনে যান নাফিজ। পরে ২০১৮ সালে হাসিনার নির্দেশে তাকে পদ্মা ব্যাংকের চেয়ারম্যান করা হয়। আগের ফার্মার্স ব্যাংক নাম বদলে পদ্মা হয়েছিল আওয়ামী লীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীরের দুর্নীতির মাধ্যমে প্রায় বন্ধ হওয়ার মুখে। কিন্তু নাফিজ পদ্মা ব্যাংকটির দায়িত্ব পেয়ে পুরোটাই গিলে খান।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সরাফাত অ্যাসোসিয়েশন অব প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের (এপিইউবি) বোর্ড সদস্য, দ্য অ্যাসোসিয়েশন অব অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিজ অ্যান্ড মিউচুয়াল ফান্ডস অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এবং কানাডা বাংলাদেশ চেম্বার হাউজের (কানাডা) সভাপতি, নিউজ বাংলা২৪-এর সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি।
এ ছাড়া কুর্মিটোলা গলফ ক্লাব ও আর্মি গলফ ক্লাবের সদস্য, ওয়ার্ল্ড চেজ ফেডারেশনের (বাংলাদেশ বিভাগ) সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া চেম্বার অব কমার্সের সদস্য, বাংলাদেশ ইকোনমিক অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য, ইনফরমেশন সিস্টেমস অডিট অ্যান্ড কন্ট্রোল অ্যাসোসিয়েশনের (ইউএসএ) সদস্য।