১৫ আগস্টের মূল পরিকল্পনাকারী কে, জানালেন কর্নেল রাশেদ
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২৬ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯:০৬ পিএম
ফাইল ছবি
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এক সামরিক অভ্যুত্থানে শেখ মুজিবুর রহমানসহ তার পরিবারের প্রায় সব সদস্যদের হত্যা করা হয়। ইতিহাসের আলোচিত এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে মেজর ডালিমের পর এবার প্রথমবার মুখ খুলেছেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) এম রাশেদ চৌধুরী (বীরপ্রতীক)।
শুক্রবার রাতে সাংবাদিক ইলিয়াস হোসেনের
ইউটিউব চ্যানেলে লাইভে যুক্ত হন সাবেক সামরিক কর্মকর্তা রাশেদ চৌধুরী।
বীর মুক্তিযোদ্ধা রাশেদ চৌধুরী জানান,
১৫ আগস্টের অপারেশনের নেতৃত্বে ছিলেন ফারুক, আর রশিদের দায়িত্ব ছিল রাজনৈতিক ব্যক্তিদের
একত্রিত করা। শেখ মুজিবের বাসা, সেরনিয়াবাত, রেডিও স্টেশন ও শেখ মণির বাসাকে টার্গেট
করা হয়। মেজর ডালিম রেডিও স্টেশন ও সেরনিয়াবাতের বাসার দায়িত্বে ছিলেন, আর রাশেদ চৌধুরী
ছিলেন রেডিও স্টেশনে ডালিমের অধীনে।
তিনি জানান, কিভাবে শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের
সঙ্গে তিনি জড়িত হয়েছিলেন। ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড কেন ঘটালেন? জানতে চাইলে সাবেক সামরিক
কর্মকর্তা রাশেদ চৌধুরী জানান, যুদ্ধের পর দেশের অবস্থা দেখে তারা হতাশ হন। ১৯৭২-৭৫
সালের দুর্ভিক্ষ ও লুটপাটের পরিস্থিতি তরুণ অফিসারদের মধ্যে আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে।
পরিবর্তনের উপায় নিয়ে গোপনে আলাপ চললেও সিনিয়ররা তা প্রকাশ করতেন না। ১৯৭৫ সালের ঘটনাটি
আগে থেকেই পরিকল্পনা করা হলেও বাকশাল গঠনের পর চিন্তাভাবনা আরও গভীর হয়।
তিনি বলেন, তবে আমি মূল পরিকল্পনার অংশ
ছিলাম না, শুধু আলাপ-আলোচনা করতাম।
তিনি আরও বলেন, ভোরের দিকে রেডিও স্টেশন টেকেন
ওভার করে ভাষণ দেওয়ার জন্য প্রস্তুত করা হয় এবং পরে ডালিম এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন,
‘উই হ্যাভ ডান ইট।’
অপারেশনে যাওয়ার আগে বিস্তারিত ব্রিফিং
করা হয়নি জানিয়ে রাশেদ চৌধুরী বলেন, মুজিবের ভাগ্য কী হবে তা আমরা জানতাম না। মুজিবকে
বাসায় মারার কোনো প্ল্যান ছিল না; পরিকল্পনা ছিল তাকে অ্যারেস্ট করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে
নিয়ে এসে সামারিক কোর্ট মার্শাল করা। রশিদ ও ফারুক ছিলেন অরিজিনাল প্ল্যানার। এরপর
সকাল সাড়ে ৮টার দিকে রশিদ খন্দকার মোশতাককে নিয়ে রেডিও স্টেশনে আসেন এবং তাকে গার্ড
অব অনার দেওয়া হয়; কারণ তিনি তখন বাংলাদেশের নতুন প্রেসিডেন্ট। এরপর রেডিও স্টেশনটি
নতুন সরকারের হেডকোয়ার্টার হয়ে ওঠে।
রাশেদ চৌধুরী বলেন, মুজিবের বাসভবনে কী
ঘটেছিল তা আমি সরাসরি দেখিনি, তবে পরবর্তীতে জানতে পেরেছি। আমার বইয়ে মেজর বজলুল হুদার
স্টেটমেন্টে উল্লেখ রয়েছে, তিনি সৈন্য নিয়ে ভোরে মুজিবের বাসভবনে পৌঁছে সুবেদারকে
জানান, আর্মি হ্যাজ টেকেন ওভার, মুজিব ইজ নো মোর ইন পাওয়ার। এরপর শেখ কামাল স্টেনগান
নিয়ে গুলি ছুড়তে ছুড়তে নিচে আসেন এবং তার স্ত্রী সুলতানা অটোমেটিক রাইফেল দিয়ে দোতলা
থেকে নিচে গুলি করতে শুরু করেন। এতে এক সিপাহি নিহত হন, কয়েকজন আহত হন; যা দেখে অন্যান্য
সিপাহিরা ক্ষেপে যান।
বজলুল হুদার মতে, শেখ কামাল ও সুলতানা
প্রথমে গোলাগুলি শুরু করেন। শেখ কামাল সিঁড়ি দিয়ে নিচে আসছিলেন, গুলি করতে করতে চিৎকার
করছিলেন। দোতলা থেকে গুলি এসে এক সিপাহি মারা গেলে, একজন গালি দিয়ে বলেছিলেন, ‘শালার
গোষ্ঠীসুদ্ধ মেরে দে।’ শেখ মুজিবের বাসার চাকরও স্বীকার করেছে যে গোলাগুলি প্রথমে তারা
শুরু করেছিলেন। পরে সিপাহিরা গেট ভেঙে ভিতরে ঢুকে যায়, আর হুদা লোকজন নিয়ে প্রবেশ করেন।
সে সময় শেখ কামাল মারা যান।
হুদার বরাত দিয়ে রাশেদ চৌধুরী বলেন, তিনি
কয়েকজনকে নিয়ে ওপরে গিয়ে শেখ মুজিবকে নামানোর চেষ্টা করেন, মেজর মহিউদ্দীনও সঙ্গে ছিলেন।
শেখ মুজিব ঘর থেকে বের হলে, শেখ জামাল ও সুলতানা আবার ওপর থেকে এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়েন।
এক গুলিতে মুজিবের পেছনে থাকা সিপাহি পড়ে যায়। মুজিব দাঁড়িয়ে থাকলেও, হুদা আর মহিউদ্দীন
ডাক করে নিজেদের বাঁচান। গুলির শব্দে লাঞ্চারের লোকজনও এসে পালটা গুলি চালায়। একপর্যায়ে
মুজিবের গায়ে গুলি লাগলে তিনি পড়ে যান।
শেখ রাসেলকে কেন হত্যা করা হলো জানতে চাইলে
রাশেদ চৌধুরী বলেন, সবাই দোতলার একটা রুমে বন্ধ ছিল। শেখ মুজিব পড়ে গেলে ওপর থেকে জানালা
দিয়ে গোলাগুলি শুরু হয়। বজলুল হুদার মতে, কয়েকজন সিপাহি জানালা দিয়ে গ্রেনেড ড্রপ করে।
ওই গ্রেনেড ব্লাস্ট হয়ে বাকি সবাই একসঙ্গে মারা যান। রাসেল নিচে আসেনি। শুধু শেখ কামাল
নিচে মারা যান। মুজিবের মৃত্যুর পর ফরেনসিক করলে হয়তো দেখা যেত তারা কিভাবে মারা গেছে,
গুলিতে না গ্রেনেড বিস্ফোরণে।
রাশেদ চৌধুরী বলেন, শেখ মুজিব ১৯৭২ সালে
ঢাকা ফিরে আসার পর জনগণের বিপুল ভালোবাসা পেয়েছিলেন; যা অন্য কোনো নেতা পায়নি। শেখ
মুজিব একাত্তরের আগে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলেন এবং দেশের স্বাধীনতার জন্য
কাজ করেছিলেন, কিন্তু পরবর্তীতে ক্ষমতায় এসে তার শাসনভঙ্গি পরিবর্তিত হয়। তিনি তখন
গণতন্ত্রের পক্ষে না হয়ে, স্বৈরাচারী হয়ে ওঠেন; যা ছিল খুবই আশ্চর্যজনক।