দুদক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন
সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে স্বীকৃতিসহ ৪৭ সুপারিশ
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৫ জানুয়ারি ২০২৫, ০৮:৫৬ পিএম
দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) শক্তিশালী করতে বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে স্বীকৃতি প্রদানসহ ৪৭ দফা সুপারিশ করেছে দুদক সংস্কার কমিশন। এতে রাজনীতি ও আমলানির্ভরতা কমানো, কমিশনের সদস্য তিনজন থেকে (একজন নারী কমিশনারসহ) বাড়িয়ে পাঁচজন, নিজস্ব প্রসিকিউশন ইউনিট গঠন, দুদকের কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়। দুদক কমিশনারদের মেয়াদ হবে চার বছর। বুধবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেওয়া প্রতিবেদনে এসব সুপারিশ করেছে এ সংক্রান্ত সংস্কার কমিশন।
সুপারিশে ব্যক্তিস্বার্থে সাংবিধানিক ও আইনগত ক্ষমতার অপব্যবহার এবং আইনে কালোটাকা সাদা করার বৈধতা স্থায়ীভাবে বন্ধ করাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এছাড়া দুদকে নিয়োগের ক্ষেত্রে বেশকিছু সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করা হয়। দুদকে শৃঙ্খলা অনুবিভাগ রাখার সুপারিশ করা হয়েছে। এটির দায়িত্ব হবে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে বরখাস্ত করা। দুদকের ভেতরের দুর্নীতি বন্ধে কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে নজরদারি অব্যাহত রাখার সুপারিশও করেছে কমিশন।
প্রতিবেদন প্রসঙ্গে সংস্কার কমিশনের প্রধান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, সুপারিশের ভিত্তিতে একটি কার্যকর দুদক গড়ে তুলতে রাজনীতি ও আমলাতন্ত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে হবে, না হলে দুদক কার্যকর হবে না।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে পালানোর পর ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন খাতে সংস্কারের জন্য কমিশন গঠন করে। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সংস্কারে কমিশন গঠন করা হয়। ড. ইফতেখারুজ্জামানের নেতৃত্বে এ সংস্কার কমিশন ৩ অক্টোবর কার্যক্রম শুরু করে। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে কমিশনের প্রতিবেদন দেওয়ার কথা থাকলেও কাজ শেষ না হওয়ায় ৩ জানুয়ারি প্রতিবেদন দেওয়ার সময় বাড়ানো হয়।
জানা যায়, দুদককে শক্তিশালী, কার্যকর ও ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে তুলতে কমিশনারদের পদ বাড়ানো, নিয়োগ, সার্চ কমিটি, আইনের সংস্কার, বেতন বৃদ্ধি ও প্রণোদনার জন্য সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন। তারা বলছে, দেশে জাতীয় দুর্নীতিবিরোধী কোনো কৌশল নেই। দুর্নীতি দমন শুধু দুদকের একার কাজ নয়, এখানে রাষ্ট্রীয় ও অরাষ্ট্রীয় অনেক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা রয়েছে। যেমন: সংসদ, আইন ও বিচার বিভাগ, প্রশাসন, সেনাবাহিনী, বিভিন্ন কমিশন, ব্যবসা খাত ও রাজনৈতিক দল এবং নাগরিক সমাজের দুর্নীতিবিরোধী ভূমিকা থাকতে হবে। যে জাতীয় কৌশল প্রণয়নের কথা বলা হচ্ছে, তাতে রাষ্ট্রীয় ও অরাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা নির্ধারণ করা থাকবে; যার মাধ্যমে দুর্নীতিবিরোধী পদক্ষেপগুলো কতটুকু বাস্তবায়িত হচ্ছে, সেটি নিয়মিতভাবে নজরদারি করতে হবে।
দুর্নীতি দমনে সব সেবামূলক খাত স্বয়ংক্রিয় বা অটোমেশনের আওতায় আনার সুপারিশ করেছে কমিশন। কমিশন বলছে, বেসরকারি খাতে ঘুস লেনদেন এখন পর্যন্ত অবৈধ নয়। আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী কনভেনশনের আওতায় সরকারি খাতের মতো বেসরকারি খাতেও ঘুস লেনদেন অবৈধ, কিন্তু সেটা এখনো কার্যকর হয়নি। দুদককে শক্তিশালী করতে কয়েকটি আইন সংস্কারের তাগিদ দিয়েছে কমিশন। দুর্নীতির তথ্য প্রকাশকারীর সুরক্ষা আইন এর একটি। যিনি দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ করেন, তার সুরক্ষায় আইন করতে হবে। একটা তথ্য প্রকাশ সুরক্ষা আইন রয়েছে, তবে সেটির কোনো প্রয়োগ ও কার্যকর প্রচার নেই। এ আইন যথেষ্ট নয়। তাই আইনটি সংশোধন করে কার্যকর ও প্রচার করার সুপারিশ করা হয়েছে।
অর্থ পাচার বন্ধে সুনির্দিষ্ট কিছু আইন করার কথা বলেছে সংস্কার কমিশন। কমিশনের মতে, সুনির্দিষ্ট আইন না থাকায় অর্থ পাচার বন্ধ করা যাচ্ছে না। কমিশন বলছে, যে ব্যক্তি একটি প্রতিষ্ঠান ও মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে রয়েছেন, তিনি ব্যক্তিগত স্বার্থ ও বন্ধুত্বের বলয় থেকে সিদ্ধান্ত নেন। এটা বন্ধে স্বার্থের দ্বন্দ্ব নিরসন আইন দরকার।
রাজনৈতিক দলের নির্বাচনি আয়-ব্যয় নিয়মিত প্রকাশের ওপর গুরুত্বারোপ করেছে সংস্কার কমিশন। তাদের মতে, রাজনৈতিক দলের নির্বাচনি আয়-ব্যয় নিয়মিত প্রকাশ করতে হবে। হলফনামার তথ্য প্রকাশ করতে হবে। যদি হলফনামায় পর্যাপ্ত তথ্য না থাকে, তথ্য গোপন করা হয় এবং বৈধ আয়ের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পদ থাকে, তবে তার জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। স্থানীয় থেকে জাতীয়-সব পর্যায়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার তিন মাসের মধ্যে তাদের পরিবারের সবার সম্পদের বিবরণী নির্বাচন কমিশনে জমা দেবেন। সেটি নির্বাচন কমিশন প্রকাশ করবে। এটি প্রতিবছর হালনাগাদ করতে হবে, যতদিন তারা জনপ্রতিনিধি থাকবেন।
দেশের প্রত্যেক নাগরিকের দেশ-বিদেশে থাকা ব্যাংক হিসাবের লেনদেন ‘কমন রিপোর্টি প্র্যাকটিস’-এর আওতায় আনার কথা বলেছে কমিশন। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটসহ (বিএফআইইউ) সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে এসব লেনদেনের তথ্য জানতে পারবে। বেনামি প্রতিষ্ঠান গড়ে এস আলম কয়েকটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বেনামি কোম্পানির তথ্য প্রকাশ করা হয় না উল্লেখ করে সংস্কার কমিশন বলেছে, তারা মনে করে, বেনামি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে দেশের মানুষ জানে না। তাই বেনামি প্রতিষ্ঠানের মালিকানার তথ্য একটা জাতীয় রেজিস্ট্রারে উল্লেখ থাকা উচিত।
দুদক সংস্কার কমিশন বলেছে, কমিশনার নিয়োগের ক্ষেত্রে শুধু সংখ্যা বাড়ালে হবে না। যেসব পেশা দুদকের কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বা যুক্ত, সেখান থেকে দুদকের বিভিন্ন পদে নিয়োগ দিতে হবে। শুধু আমলাদের নিয়োগে যে প্রধান্য দেওয়া হয়, তা থেকে সরে আসতে হবে। সংস্কার কমিশন চায় দুদক স্বাধীন ও কার্যকর হোক। তবে দুদকের কোনো স্বাধীনতা সীমাহীন নয়। দুদক যে কাজ করবে, তার জবাবদিহি থাকবে। ভালো কাজের যেমন প্রশংসা থাকবে, তেমন কাজ করতে না পারলে জবাবদিহি করতে হবে।
দুদকের চেয়ারম্যান ও কমিশনার নিয়োগে যে সার্চ কমিটি রয়েছে, সেটিকে সার্চ ও পর্যবেক্ষণ কমিটি করার সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন। সার্চ কমিটির দুটি দায়িত্বের সুপারিশ করা হয়েছে। এর একটি, নিয়োগে যাচাই-বাছাই করা। অন্যটি কমিশন কী কাজ করছে, সেটি পর্যবেক্ষণ করে ছয় মাস পরপর প্রতিবেদন দেওয়া। রাজনৈতিক বিবেচনায় দুদকে নিয়োগ বন্ধে সাত সদস্যের বাছাই কমিটি করার সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন। দুদককে আমলাতন্ত্রমুক্ত করতে সচিব, মহাপরিচালক ও পরিচালক পদগুলোয় প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। যারা দুদকের কাজের জন্য নিজেদের যোগ্য মনে করবেন, তারা এসব পদের জন্য আবেদন করতে পারবেন। এছাড়া নিজস্ব প্রসিকিউশন বিভাগ ও প্রশিক্ষণ একাডেমি করা, ৫৪-এর ৩ ধারা বাতিল এবং বেতন দ্বিগুণ করার সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত ২১ নভেম্বর দৈনিক যুগান্তর ‘দুদকের সাংবিধানিক মর্যাদা জরুরি’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনে কমিশনার নিয়োগ পদ্ধতি স্বচ্ছ ও বাছাই কমিটি গঠনে নতুন বিধিমালার প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনে ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনের বরাতে জানানো হয়, ‘বিশ্বের সব দেশেই দুর্নীতি দমনে স্বাধীন সংস্থা থাকে। সরকারের কোনো মন্ত্রী দুর্নীতি করলেও ধরে। কিন্তু আমাদের দেশে তা করা হয় না।’ সংস্কার কমিশন দুদককে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে স্বীকৃতি প্রদানের সুপারিশ করায় যুগান্তরের প্রধান শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনটিও স্বীকৃতি পেল। ওই প্রতিবেদনে দুদকের জন্য নিজস্ব প্রসিকিউশন ইউনিট, কমিশনের সদস্য তিনজন থেকে বাড়িয়ে পাঁচজন করা, কমিশনার নিয়োগে বিদ্যমান আইনে সংশোধনী আনা, মামলা বিচারের জন্য পৃথক আদালত গঠন, দুদক কর্মকর্তারা আতঙ্কিত থাকেন-এমন একটি ধারা (৫৪) বাতিল, কমিশনার বাচাই কমিটিসহ দুদকের বিভিন্ন পদে দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধ বিষয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের নিয়োগ প্রদানসহ গুরুত্বপূর্ণ আরও কিছু প্রস্তাবনা তুলে ধরা হয়। কমিশনপ্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামানকে প্রধান করে গঠিত দুদক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে উল্লিখিত বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়।