ফাইল ছবি
দেশে মোট ৩ হাজার ১১১টি লেভেলক্রসিং রয়েছে। এর মধ্যে দুই হাজারের বেশি অবৈধ। নারায়ণগঞ্জ থেকে কমলাপুর-কমলাপুর থেকে টঙ্গী পর্যন্ত মোট লেভেলক্রসিয়ের মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশই অবৈধ। রাজধানী ঢাকাতে যানজটের অন্যতম কারণ লেভেলক্রসিং। প্রতিবার গড়ে ৫ মিনিট (৪ থেকে ৭ মিনিট) করে লেভেল ক্রসিংয়ের বন্ধ থাকে। এতে একটি লেভেল ক্রসিংয়ের ওপর দিয়ে প্রতিদিন ৮২০ মিনিট বা ১৩ ঘণ্টা ৪০ মিনিট করে যান চলাচল বন্ধ থাকে। যদি তৃতীয় ও চতুর্থ রেললেন হয় তবে রাজধানীর সড়কে যানজট বাড়বে দ্বিগুণের বেশি।
নারায়ণগঞ্জ থেকে কমলাপুর-কমলাপুর থেকে টঙ্গী অংশে রেল খাতায় বৈধ ৩৯টি এবং অবৈধ ২২টি লেভেলক্রসিংয়ের তথ্য রয়েছে। কিন্তু এ পথেই ছোট-বড় প্রায় ৩১টি অবৈধ লেভেলক্রসিং আছে। হিসাব বলছে, নারায়ণগঞ্জ-টঙ্গী লাইনে ৭৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ লেভেলক্রসিং সম্পূর্ণ অবৈধ। বৈধ এবং অবৈধ ক্রসিং ঘিরে যানজট চরমে ওঠে।
রেলওয়ে সূত্র বলছে, এসব ক্রসিং হয়ে প্রতিদিন ৮৬টি আন্তঃনগর এবং ৭৮টি মেইল-লোকাল ও কমিউটার ট্রেন চলাচল করছে। এতে করে সারা দিন ১৬৪ বার প্রতিটি লেভেল ক্রসিংয়ের প্রতিবন্ধকগুলো ফেলা হয়। প্রতিবার গড়ে ৫ মিনিট (৪ থেকে ৭ মিনিট) করে লেভেল ক্রসিংয়ের বন্ধ থাকে। এতে একটি লেভেল ক্রসিংয়ের ওপর দিয়ে প্রতিদিন ৮২০ মিনিট বা ১৩ ঘণ্টা ৪০ মিনিট করে যান চলাচল বন্ধ থাকে। একই সঙ্গে সারা বাংলাদেশই বৈধ-অবৈধ ক্রসিংগুলো যানজট সৃষ্টির সহায়ক হচ্ছে। দেশে মোট তিন হাজার ১১১টি লেভেল ক্রসিং রয়েছে। এর মধ্যে দুই হাজারের বেশি অবৈধ (অননুমোদিত)। অর্থাৎ প্রায় ৭০ শতাংশ লেভেল ক্রসিং সম্পূর্ণ অবৈধ। এক হাজারের বেশি অনুমোদিত হলেও এর অর্ধেকের বেশি ক্রসিংয়ে গেটম্যানই নেই। আর অননুমোদিত ক্রসিংগুলো একেবারেই ‘বেওয়ারিশ’ অবস্থায় পড়ে থাকে।
এ প্রসঙ্গে রোববার বিকালে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান যুগান্তরকে বলেন, ‘অবৈধভাবে লেভেলক্রসিং তৈরি-এটা খুবই ভয়ানক। বছরের পর বছর এটা চলছে। শুধু রাজধানীতে নয়, সারা দেশেই অননুমোদিত ক্রসিং ভরে আছে। আমরা উদ্যোগ নিচ্ছি-অবৈধ ক্রসিং বন্ধ করার পাশাপাশি বৈধ ক্রসিংগুলোতে গেট-লোকবল নিশ্চিত করার। নারায়ণগঞ্জ থেকে টঙ্গী পর্যন্ত বৈধ কিংবা অবৈধ উভয় ক্রসিংয়ের জন্য যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। দুর্ঘটনা ঘটছে। সাধারণ মানুষসহ ট্রেনযাত্রী হতাহতের সঙ্গে ক্ষয়ক্ষতিও হচ্ছে। ৩য়-৪র্থ লেন স্থাপন সম্পন্ন হলে ট্রেনের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হবে-তখন? ‘তখন নিশ্চয় প্রতিবন্ধক বারও বেশি ফেলতে হবে, যানজটও বাড়বে। ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক করা-যানজটমুক্ত এবং হতাহত কমিয়ে আনতে আন্ডার-ওভারপাস স্থাপনের কোনো বিকল্প নেই।’ যোগ করেন রেলের এ উপদেষ্টা।
নারায়ণগঞ্জ-টঙ্গী রেলপথে সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, কিছুক্ষণ পরপরই লেভেলক্রসিং। রাস্তা ভেদে রেললাইনের ওপর দিয়ে যত্রতত্র পারাপারের পথ তৈরি করা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ থেকে কমলাপুর স্টেশন পর্যন্ত ১১টি অবৈধ লেভেলক্রসিংয়ের তথ্য রয়েছে রেল খাতায়। কিন্তু ওই পথে অন্তত ১৬টি অননুমোদিত ক্রসিং রয়েছে। এছাড়া লাইনের ওপর দিয়ে আড়াআড়িভাবে হাঁটা যায় (রিকশা-সাইকেল-ভ্যান পাড় করা যায়) এমন রাস্তা রয়েছে প্রায় ছয়টি। একই অবস্থা কমলাপুর থেকে টঙ্গী পর্যন্ত। রেলের খাতায় আছে ১১টি অননুমোদিত লেভেলক্রসিংয়ের কথা। বাস্তবে এ রুটে ১৬-১৭টি অবৈধ ক্রসিং রয়েছে। হাঁটা যায়-এমন রয়েছে প্রায় সাতটি। আবার বৈধ-অবৈধ ক্রসিংগুলো ঘিরে গড়ে উঠেছে অবৈধ স্থাপনা। গড়ে তোলা হয়েছে মাছ-সবজির বাজার এবং ঝুপড়ি ঘর। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভোক্তভোগীদের অনেকে বলেছেন, সবই রাজনৈতিক প্রভাবে গড়ে উঠেছে।
এদিকে গত ১৫ বছর বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অবৈধ লেভেলক্রসিং বন্ধ এবং বৈধ ক্রসিংগুলোতে গেট তৈরি এবং লোকবল দেওয়ার নামে ভাঁওতাবাজির অভিযোগ উঠেছে।
রেলওয়ে অবকাঠামো দপ্তর সূত্রে জানা যায়, গত ১৫ বছরে এক লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হলেও লেভেলক্রসিং উন্নয়নে মাত্র ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। অস্থায়ীভাবে গেটম্যান নিয়োগ দেওয়া হলেও মাসের পর মাস তাদের বেতন দেওয়া হয়নি। প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও স্থায়ী করা হয়নি চাকরি। টঙ্গী থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত অসংখ্যবার উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা হলেও সবই ছিল লোক দেখানো। ভূ-সম্পদ দপ্তরের এক কর্তার ভাষ্য-উচ্ছেদ অভিযান ছিল ‘রাজনৈতিক’ আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মীদের সুযোগ সুবিধা বাড়ানো, দখল পাকাপোক্ত করতেই।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, নারায়ণগঞ্জ-টঙ্গীসহ সারা দেশে দুই হাজার লেভেলক্রসিংয়ের নিরাপত্তা বাড়ানোসহ ৪৭টি লেভেলক্রসিংয়ে ওভারপাস বা আন্ডারপাস নির্মাণ এবং গেটম্যান না থাকা ১৯৪টি ক্রসিংয়ে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা চালু করার সুপারিশ করা হয় রেল ও এলজিইডির যৌথ সমীক্ষায়। সমীক্ষাটি ২০২৩ সালে করা হলেও শুধু রাজনৈতিক কারণে আওয়ামী লীগ সরকার তা এগিয়ে নেয়নি। ফলে দিন যত যাচ্ছে, বৈধ-অবৈধ ক্রসিং ঘিরে যানজট বাড়ছে। এদিকে বিশেষ করে নারায়ণগঞ্জ থেকে টঙ্গী পর্যন্ত সাতটি আন্ডার-ওভারপাস তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া হয় ২০১২ সালের দিকে। ওই সময় থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময় পর্যন্ত দায়িত্বরত রেলপথ মন্ত্রী-সচিবরা এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে একেবারেই নজর দেয়নি। অবৈধ লেভেলক্রসিং বন্ধে কোনো সাদৃশ্য উদ্যোগ নেয়নি।
কাওরানবাজার এলাকায় পরপর চারটি লেভেলক্রসিং। সাতরাস্তা হয়ে একটি সড়ক রেলপথ অতিক্রম করে প্রবেশ করেছে কাওরানবাজারে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গেটের কর্মচারী বলেন, ‘ভয়ানক অবস্থা, কতক্ষণ পরপর ট্রেন আসে। মানুষকে আটকে রাখা যায় না। প্রতি মাসেই দুর্ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ৩য়-৪র্থ লাইন তৈরি হচ্ছে। এতে সমস্যা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। কখনো কখনো ৫ থেকে ১০ মিনিট পর্যন্ত গেট ফেলে রাখতে হয়। তখন সাধারণ পথচারী-যানচালকরা অস্থির হয়ে ওঠে। গেটবার উঁচু করে পারাপারের সময় দুর্ঘটনা ঘটে। শুধু যান নয়, রোগীদের নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সেরও একই দশা। আন্ডার-ওভারপাস থাকলে এমন সমস্যা হতো না।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. এম শামসুল হক যুগান্তরকে বলেন, রেলের উন্নয়ন ঘিরে ছিল ব্যাপক লুটপাট। সুদূরপ্রসারী কোনো উন্নয়ন নেই। রাজধানীর ভেতর দিয়ে চলাচলকারী একেকটি ট্রেন যেন মরণফাঁদ। এর কারণ নারায়ণগঞ্জ থেকে টঙ্গী পর্যন্ত অসংখ্য লেভেলক্রসিং রয়েছে। এসব বৈধ-অবৈধ ক্রসিং ঘিরে দুর্ঘটনা লেগেই আছে। আর যানজট তো বাড়ছেই। এ পথে সবচেয়ে জরুরি ছিল আন্ডার-ওভারপাস তৈরি করা। কিন্তু কোনো রেলপথমন্ত্রী, সচিব এমনকি সরকার এ গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করেনি। এখন ৩য়-৪র্থ লেন সম্পন্ন হলে ক্রসিংগুলো ঘিরে দুর্ঘটনার সঙ্গে যানজট চরমে উঠবে।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ফাহিমুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ‘গুরুত্বপূর্ণ এ রুট নিয়ে আমরা ভাবছি। শহরের যানজট বাড়বে, এমন উন্নয়ন প্রকল্প নিশ্চয় কাম্য নয়। আমরা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলছি কী করে অবৈধ ক্রসিংগুলো বন্ধ এবং বৈধ ক্রসিংগুলো আরও উন্নয়ন করা যায়। যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক রাখতে টেকসই উন্নয়নের বিকল্প নেই। আমরা এ বিষয়গুলো সামনে রেখে কাজ করছি।’