Logo
Logo
×

জাতীয়

৫ দিনের ছুটিতে না গিয়েই চির ছুটিতে গেলেন সোয়ানুর

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৪:৩৯ এএম

৫ দিনের ছুটিতে না গিয়েই চির ছুটিতে গেলেন সোয়ানুর

সোয়ানুর রহমান নয়ন। ছবি: সংগৃহীত

সোয়ানুর রহমান নয়ন (২৪) ছিলেন মা-বাবার একমাত্র ছেলে। বোনের একমাত্র ভাই। পরিবারের একমাত্র অবলম্বন। বছরের শেষদিকে পাঁচদিনের ছুটি পেয়েছেন। ছুটি পাওয়ার খবরে বাড়িতে বয়ে গিয়েছিল আনন্দের ঢেউ। শীতের পিঠা বানাতে মা-বোনের ব্যস্ততা শেষও হয়ে এসেছিল। রাত পেরোলে সকালেই সোয়ানুর রওয়ানা দেবেন বাড়ির পথে। বাড়িতে বসবে চাঁদের হাট।

আনন্দময় সকালের অপেক্ষায় সবাই। সেই সকাল যে আজীবনের জন্য বিষাদময় হয়ে উঠবে, তা ঘুণাক্ষরেও চিন্তা করেননি সোয়ানুর ও পরিবারের সদস্যরা। পাঁচদিনের ছুটিতে যাওয়ার আগেই সোয়ানুর চিরদিনের জন্য জীবন থেকে ছুটি পেয়ে কফিনে মোড়ানো লাশ হয়ে গেলেন বাড়িতে। বুধবার মধ্যরাতে সচিবালয়ে আগুন লাগার খবর পেয়ে প্রথমেই ফায়ার সার্ভিসের তেজগাঁও স্টেশনের একটি ইউনিট পৌঁছায় ঘটনাস্থলে। অল্পবয়সি চৌকশ ফায়ার ফাইটার সোয়ানুরও কর্তব্যের টানে ছুটে যান সেখানে। রাত সোয়া ২টার দিকে সড়ক থেকে পানির পাইপের সংযোগ নিয়ে যখন কাজ করছিলেন, দ্রুতগতির এক ট্রাক ধাক্কা দেয় সোয়ানুর ও তার আরেক সহকর্মী মো. হাবিবুর রহমানকে (২৫)। দ্রুত দুর্ঘটনাস্থল থেকে দুজনকে নেওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে। চিকিৎসা পেয়ে হাবিবুর বেঁচে গেছেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি সোয়ানুরের। ভোর পৌনে ৪টার দিকে চিকিৎসকরা সোয়ানুরকে মৃত ঘোষণা করেন।

মৃত্যুর খবর শুনে রংপুর জেলার মিঠাপুকুর থানার আটপনিয়া গ্রামে সোয়ানুরের বাড়িতে আনন্দের অপেক্ষায় থাকা সকাল এসেছে বিষাদের বার্তা নিয়ে। মা নার্গিস বেগম বিলাপ করছিলেন আর বারবার অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলেন। বলছিলেন, ‘আমার ছেলের বিএ পরীক্ষার রেজাল্ট হইলে আরও উপরের পদে যাইত। তারপর ছেলেকে বিয়ে দিতাম। আমার সেই আশা পূরণ হইল না।’ নির্বাক হয়ে বসে আছেন বাবা। একমাত্র ভাইকে হারানোর খবরে বোনও শোকস্তব্ধ। আত্মীয়স্বজন আর পাড়া-প্রতিবেশীরা ভিড় জমিয়েছেন বাড়িতে। সবার আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে চারপাশ।

ঢামেক মর্গে সোয়ানুরের মরদেহ নিতে এসেছিলেন চাচাতো ভাই রাকিবুল ইসলাম। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, বৃহস্পতিবার সকালে সোয়ানের (সোয়ানুর) বাড়ি যাওয়ার কথা ছিল। চাচা-চাচি সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন ওর জন্য। সব আনন্দ আয়োজন পরিণত হয়েছে শোকের মাতমে। এ শোক তারা কীভাবে কাটিয়ে উঠবেন? তিনি বলেন, দুই বছর আগে ফায়ার সার্ভিসে যোগ দিয়েছিলেন সোয়ানুর। সিলেটের বিশ্বনাথ ফায়ার স্টেশনে কর্মজীবন শুরু তার। দক্ষতা ও বিচক্ষণতার প্রমাণ দিয়ে চৌকশ ফায়ার ফাইটার হিসাবে সুপরিচিত হয়ে ওঠেন। বদলি হয়ে আসেন তেজগাঁও ফায়ার স্টেশনে। সাহসী, দায়িত্বশীল ও পরিশ্রমী হিসাবে কর্মক্ষেত্রে পরিচিত তিনি। কৃষক বাবা আক্তারুজ্জামানের একমাত্র আশা-ভরসা ছিল তাকে ঘিরেই। অনেক স্বপ্ন ছিল ছেলের চাকরি দিয়ে অনাগত দিনগুলো একটু সুখে-শান্তিতে কাটাবেন। কিন্তু সে আশা পূরণ হওয়ার আগেই ঘাতক ট্রাক কেড়ে নিল সবকিছু।

সোয়ানের সহকর্মী জাকির হোসেন বলেন, রাতে আগুন লাগার খবর পেয়ে আমরাই প্রথম তেজগাঁও স্টেশন থেকে সচিবালয়ে যাই। সবাই তখন আগুন নেভাতে ব্যস্ত। সোয়ান পানির পাইপ নিয়ে রাস্তায় যায়। হঠাৎ একটি দ্রুতগতির ট্রাক ওকে ধাক্কা দেয়। সোয়ান রাস্তায় পড়ে গেলে ট্রাকটি অনেকটা রাস্তা ওকে টেনে নিয়ে যায়। পরে ওকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেলে নিলেও বাঁচানো যায়নি। জাকির বলেন, ফায়ার ফাইটার হিসাবে সোয়ান অত্যন্ত দক্ষ ও পরিশ্রমী। সবাই ওকে পছন্দ করত। বুধবার ওর পাঁচদিনের ছুটি মঞ্জুর হয়েছিল। বৃহস্পতিবার সকালে সিসি নিয়ে গ্রামে যাওয়ার কথা ছিল। কে জানত, সবকিছু ফেলে চিরজীবনের মতো ছুটি পেয়ে যাবে।

শাহবাগ থানার এসআই আমিরুল ইসলাম বলেন, সোয়ান নিহতের ঘটনায় ঘাতক চালক ও হেলপারের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে। বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ৩টার দিকে শাহবাগ থানায় ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে মামলাটি করা হয়। ওই মামলায় ট্রাকটি জব্দ ও এর চালককে গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি বলেন, মরদেহের সুরতহালের সময় দেখা যায়, সোয়ানের মাথার এক পাশের হাড় ভাঙা ছিল। এছাড়া শরীরের অনেক জায়গায় জখম ছিল। মাথার আঘাতের কারণে তার মৃত্যু হয়েছে বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

সোয়ানুরের প্রশংসা করে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের ফায়ার ফাইটার যে ছেলেটি মারা গেছে, মাত্র ২৪ বছর বয়স ছিল। এত অল্প বয়সেই খুব দক্ষতার ছাপ রেখেছিল। এ কারণে তাকে সিলেট থেকে তেজগাঁওয়ে বদলি করে নিয়ে আসা হয়। তার এ মৃত্যু শুধু পরিবার নয়, আমাদের ফায়ার সার্ভিসের জন্যও অপূরণীয় ক্ষতি। তিনি বলেন, সোয়ানুরের মৃত্যুর ঘটনা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আগুন নেভানোর সময় সেখানে কেন সড়ক বন্ধ করা হয়নি বা অন্য যেসব প্রশ্ন উঠেছে, সেগুলো নিয়েও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করছে। সোয়ানুরের মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী, তাদের বিচারের আওতায় আনা হবে।

সোয়ানুরের গ্রামের বাড়ির স্থানীয় ইউপি সদস্য জিয়াউল হক জুয়েল বলেন, পড়ালেখা শেষ হওয়ার আগেই চাকরিতে প্রবেশ করেছিলেন সোয়ানুর। চাকরিরত অবস্থাতে পড়ালেখা চালাচ্ছিলেন তিনি। তার ডিগ্রি পরীক্ষা শেষ হয়েছে। তবে রেজাল্ট এখনো হয়নি। তিনি বলেন, সেয়ানুরের পরিবার নদীভাঙনের শিকার। নিজস্ব জমিজমা বলতে তেমন কিছু নেই। অনেক কষ্টে একমাত্র ছেলেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত লেখাপড়া করিয়েছেন। ২০২২ সালে তার চাকরি হয়। ছেলের চাকরিতে পরিবারে একটু সচ্ছলতা ফিরতে শুরু করেছিল। কিন্তু সেই সুখ বেশি দিন টিকল না। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে এখন পরিবারটি দিশেহারা হয়ে পড়েছে। ছেলেকে হারিয়ে বাক্রুদ্ধ বাবা আক্তারুজ্জামান বলেন, বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ অনেক ভারী। আমার অনেক স্বপ্ন ছিল তাকে ঘিরে। সবকিছু শেষ হয়ে গেল।

তেজগাঁও ফায়ার স্টেশনের ফায়ার ফাইটার রাজিব বলেন, আমরা বুধবার রাতে একসঙ্গে খাবার খেয়েছি। একসঙ্গে ভলিবলও খেলেছি। সম্ভবত রাত ২টা ৪০ মিনিটে সাইরেন বেজে ওঠে। তাৎক্ষণিক ১০ জন সদস্য নিয়ে মিনিবাসে করে ঘটনাস্থলে আসেন সোয়ানুর। আমরা ১০ মিনিট পরে আসি।

এদিকে বৃহস্পতিবার দুপুরে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর প্রাঙ্গণে সোয়ানুর রহমান নয়নের জানাজা সম্পন্ন হয়। জানাজায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মো. খোদা বখস চৌধুরী, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামালসহ মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের বিভিন্ন পদমর্যাদার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অংশগ্রহণ করেন। জানাজার আগে তার কফিনে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। এ সময় অগ্নিসেনাদের একটি চৌকশ দল গার্ড অব অনার প্রদান করে। এরপর ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পক্ষ থেকে প্রয়াত ফায়ারফাইটারের সংক্ষিপ্ত বৃত্তান্ত পাঠ করে শোনানো হয়। এরপর ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে সোয়ানুরের গ্রামের বাড়ি রংপুরের মিঠাপুকুর থানার আটপনিয়া গ্রামের উদ্দেশে রওয়ানা দেন।

চালক ও হেলপার কারাগারে : ফায়ার ফাইটার সোয়ানুর জামান নয়নের মৃত্যুর ঘটনায় করা মামলায় গ্রেফতার হওয়া ট্রাকচালক বেলাল হোসেন ওরফে সুমন ও হেলপার মো. ফরহাদকে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত। বৃহস্পতিবার শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মিনহাজুর রহমান আসামিদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম