Logo
Logo
×

জাতীয়

পরীক্ষা ছাড়া উপসচিব ও যুগ্ম-সচিব নয়; ফুঁসে উঠেছেন ডিসিরা

আমিরুল ইসলাম

আমিরুল ইসলাম

প্রকাশ: ২০ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:১৩ পিএম

পরীক্ষা ছাড়া উপসচিব ও যুগ্ম-সচিব নয়; ফুঁসে উঠেছেন ডিসিরা

পদোন্নতির বিষয়ে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের খসড়া প্রস্তাব নিয়ে রীতিমতো ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিসিএস প্রশাসন, স্বাস্থ্য ও সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তারা। তাদের ভাষ্য—কোনো ধরনের আলাপ আলোচনা, সমীক্ষা এবং মতামত ছাড়াই কমিশন একতরফা সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। যা মোটেই কাম্য নয়। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা কমিশনকে খসড়া প্রস্তাব থেকে সরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। একই সঙ্গে কমিশনের সুপারিশের প্রতিবাদ জানিয়েছেন ৬৪ জেলার জেলা প্রশাসক (ডিসি)। 

শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা বলছেন, এই কমিশনের প্রতি তাদের কোনো আস্থা নেই। কারণ কমিশনে তাদের কোনো প্রতিনিধি নেই। তাছাড়া কমিশনের উদ্দেশ্য আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়। এছাড়া বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা বলছেন, আমরা পেশাগত সুযোগ সুবিধা, জনস্বাস্থ্য সেবার মান কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নিতে সরকারের সঙ্গে কথা বলেছি। ক্যাডার থেকে বের করে দিতে তো কখনো বলিনি। আমাদের সঙ্গে কোনো আলোচনাও করা হয়নি। নেওয়া হয়নি কোনো মতামতও। বিষয়টি আমাদের মর্মাহত করেছে।

গত মঙ্গলবার সচিবালয় বিটের সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী বলেছেন, ভবিষ্যতে পরীক্ষা ছাড়া সিভিল সার্ভিসের উপসচিব এবং যুগ্ম-সচিব পর্যায়ে কেউ পদোন্নতি পাবেন না। কমিশন সরকারের কাছে এমন সুপারিশই করবে। একই সঙ্গে উপসচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের জন্য ৫০ এবং প্রশাসন ছাড়া অন্য সব ক্যাডার (আদার্স) থেকে ৫০ শতাংশ কর্মকর্তাদের নেওয়ার সুপারিশ করা হবে। বর্তমানে প্রশাসন ক্যাডারের ৭৫ শতাংশ এবং অন্য ক্যাডারের ২৫ শতাংশ পদোন্নতি পেয়ে থাকেন।

আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী বলেন, এই বিধান বাতিলের সুপারিশও করবে কমিশন। জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের মতো স্বাস্থ্য ও শিক্ষাকে ক্যাডার সার্ভিস থেকে আলাদা করার জন্য সরকারকে সুপারিশ করবে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। একই সঙ্গে অন্য ক্যাডারগুলোকে নিয়ে পাঁচটি গুচ্ছ (ক্লাস্টার) করারও সুপারিশ দেবে কমিশন।

বুধবার জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন প্রধানের বরাত দিয়ে পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন (বিএএসএ)। সংগঠনটির লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, উপসচিব ও যুগ্ম-সচিব পদে পদোন্নতির বিষয়ে কমিশনের প্রস্তাবিত সুপারিশ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মতামত, জরিপ কিংবা সমীক্ষার মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে তার ভিত্তিতে পর্যাপ্ত বিচার-বিশ্লেষণ করে করা হয়নি। ফলে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে মাঠ প্রশাসনসহ সব স্তরে কর্মরত বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ এবং প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে।

অ্যাসোসিয়েশন জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন প্রধানের এই বক্তব্যের প্রতিবাদসহ প্রতিবেদনটি সংশোধনের আহ্বান জানাচ্ছে। বিএএসএ জানায়, আমরা অত্যন্ত যৌক্তিকভাবে রাষ্ট্রের কল্যাণের স্বার্থে মনে করি বিভিন্ন কারণে উপসচিব, যুগ্ম-সচিব, অতিরিক্ত সচিব এবং সচিব পদে শতভাগ প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদায়ন হওয়া উচিত। বিএএসএ মনে করে, কমিশনের একতরফা সিদ্ধান্তের ফলে আন্তঃক্যাডার দ্বন্দ্ব উসকে দিতে পারে। সংস্কারের উদ্যোগকে দুর্বল করতে পারে।

সংগঠনটির সভাপতি জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের সচিব ড. আনোয়ার উল্যাহ যুগান্তরকে বলেন, অযৌক্তিক কোনো মতামত, সুপারিশ ধোপে টিকবে না। আগে ক্যাডার সংগঠনগুলোর সঙ্গে আলাপ আলোচনা না করে সুপারিশ করা হলে তার গ্রহণযোগ্যতা হারাবে। বিএএসএ কমিশনকে একতরফা সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার আহ্বান জানাচ্ছে।

অন্যদিকে বিসিএস সাধারণ শিক্ষাকে ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি প্রফেসর মো. সিরাজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, কমিশন আমাদের সঙ্গে কোনো কথা বলেনি। মতামত নেয়নি। এমনকি কমিশনে আমাদের কোনো প্রতিনিধিও নেই। তাহলে আমরা কীভাবে বিশ্বাস করব এই কমিশন আমাদের স্বার্থ সংরক্ষণ করবে। তিনি আরও বলেন, এই কমিশনের ওপর আমাদের কোনো আস্থা নেই। নিকট অতীতে আমাদের নিয়ে ষড়যন্ত্র হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। আলাপ আলোচনা ছাড়া কমিশনের একতরফা সিদ্ধান্ত আমরা মানি না।

এখতিয়ারবহির্ভূত খসড়া সুপারিশ প্রত্যাখ্যান করে লিখিত প্রতিবাদ জানিয়েছে বিসিএস জেনারেল এডুকেশন অ্যাসোসিয়েশন। সেখানে বলা হয়, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার ও বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারকে কাঠামোর বাইরে রাখার সুপারিশ করতে যাচ্ছে। বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের ১৬ হাজার সদস্যের একক মুখপাত্র বিসিএস জেনারেল এডুকেশন অ্যাসোসিয়েশন এই সুপারিশ সর্বোতভাবে প্রত্যাখ্যান করছে। ২০১২ সালে অনুরূপ একটি প্রচেষ্টা আমরা প্রতিহত করেছি। বিষয়টি মীমাংসিত।

নতুন করে উত্তাপ ছড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। এ সুপারিশ প্রত্যাহার করা না হলে কার্যকর প্রশাসনিক সংস্কার ব্যর্থ হবে। বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সঙ্গে কোনোরূপ আলোচনা না করে কমিশনের এমন প্রস্তাবনা তৈরি এবং গণমাধ্যমে একতরফাভাবে প্রচার করা সুবিবেচনাপ্রসূত নয় বলেও দাবি করে সংগঠনটি। শিক্ষা খাতে অস্থিরতা তৈরি করে সরকারকে অস্থিতিশীল করার এটি কোনো ষড়যন্ত্র কিনা তা খতিয়ে দেখা উচিত। এরূপ সিদ্ধান্তের ফলে শিক্ষা কার্যক্রম, শিক্ষা প্রশাসন এবং সংস্কার কার্যক্রমে স্থবিরতা এলে বিসিএস জেনারেল এডুকেশন অ্যাসোসিয়েশন কোনোরূপ দায় নেবে না। ক্যাডার সংকোচন এবং শিক্ষাকে মেধাশূন্য করার এ অপচেষ্টার আমরা তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। অবিলম্বে এ প্রচেষ্টা বন্ধ করার জোরালো আহ্বান জানান তারা।

জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবকে একতরফা আখ্যা দিয়ে তা প্রত্যাখ্যান করেছে স্বাস্থ্য ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশন। ৩৫ হাজার সদস্যের এই সংগঠনটির আহ্বায়ক মোহাম্মদ নেয়ামত হোসেন ও সদস্য সচিব উম্মে তানিয়া নাসরিন সই করা বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, স্বাস্থ্যের নীতিনির্ধারণী পদগুলোতে পুরোপুরি অনভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের পদায়ন করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য খাতকে বিজ্ঞানভিত্তিক ও যুগোপযোগী না করে বরং উলটোপথে হেঁটে আমলাতান্ত্রিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা কায়েম করেছে।

অথচ এসব পদে স্বাস্থ্য ক্যাডারের উপযুক্ত কর্মকর্তাদের পদায়ন করে বিজ্ঞানভিত্তিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব। কমিশন প্রকৃত সংস্কার বাদ দিয়ে স্বাস্থ্যকে ক্যাডারবহির্ভূত করার যে হঠকারী সুপারিশ করেছে, তা মেধাভিত্তিক জনপ্রশাসন তৈরি এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এটি হলে প্রশাসনিক সংস্কার ব্যর্থ হবে।

সংগঠনটির সদস্য সচিব উম্মে তানিয়া নাসরিন যুগান্তরকে বলেন, আমাদের দাবি ছিল পেশাগত মান উন্নয়ন। জনসেবা নিশ্চিতে সার্বিক সুবিধা বৃদ্ধি করা। আমরা তো ক্যাডারের বাইরে চলে যেতে চাইনি। আমাদের সঙ্গে কোনো ধরনের অনলাইন অফলাইন আলাপ আলোচনা ছাড়া এ ধরনের একটি সিদ্ধান্ত কমিশন নিতে পারে না। আমাদের মতামত নিয়ে যদি কিছু করা হতো তাহলে আমাদের কিছু বলার ছিল না। আমরা কমিশনের সুপারিশ প্রত্যাখ্যান করছি এবং সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার জন্য কমিশনকে আহ্বান জানাচ্ছি।

এদিকে বুধবার উপসচিব পদে পদোন্নতিতে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের কোটা কমাতে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের খসড়া প্রস্তাবের প্রতিবাদ জানিয়েছেন দেশের সব জেলার জেলা প্রশাসকরা (ডিসি)। মন্ত্রিপরিষদ সচিব এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের দপ্তরে বুধবার এ সংক্রান্ত প্রতিবাদলিপি জমা দিয়েছেন তারা।

ডিসিদের প্রতিবাদলিপিতে বলা হয়েছে, উপসচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে সংস্কার কমিশন যে ধরনের সুপারিশ করার চিন্তা করছে, তা বাস্তবতা বিবর্জিত। এ ধরনের উদ্যোগ কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। দেশের সর্বোচ্চ আদালতে মীমাংসিত একটি বিষয় নিয়ে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের আনুষ্ঠানিক লিখিত প্রতিবেদন সরকারের নিকট জমা দেওয়ার আগেই আকস্মিকভাবে এ ধরনের ঘোষণা অনভিপ্রেত, আপত্তিকর ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে দুর্বল করার শামিল বলেও এতে উল্লেখ করা হয়।

প্রতিবাদ লিপিতে আরও বলা হয়, রাষ্ট্রে প্রশাসন ক্যাডারের কার্যপরিধির সঙ্গে নীতিনির্ধারণের নিবিড় সম্পর্ক। প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে অন্য ক্যাডারের বড় পার্থক্য হলো, প্রশাসন ক্যাডারের কাজের ধরন সামগ্রিক বিষয়কে ধারণ করে। যেখানে অন্যান্য ক্যাডারের কাজের ধরন বিশেষায়িত। 

প্রসঙ্গত, গত ৩ অক্টোবর আট সদস্যের জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এ কমিশনের প্রধান সাবেক সচিব ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী। জনমুখী, জবাবদিহিমূলক, দক্ষ ও নিরপেক্ষ জনপ্রশাসন ব্যবস্থা করে তুলতে এ কমিশন গঠন করা হয়েছে বলে প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়। কমিশন ৯০ দিনের (৩ মাস) মধ্যে প্রস্তুত করা প্রতিবেদন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করবে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম