Logo
Logo
×

জাতীয়

নাগরিক প্ল্যাটফর্মের সম্মেলনে বক্তারা

আন্দোলনের পক্ষের কেউ কেউ বৈষম্য ধরে রাখতে চায়

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ০৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:০২ পিএম

আন্দোলনের পক্ষের কেউ কেউ বৈষম্য ধরে রাখতে চায়

জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে যারা নিজেদের বিজয়ী ভাবছেন, মনে করছেন ক্ষমতায় এসে গেছেন, তাদের মধ্যে বৈষম্যবিরোধী মূল চেতনা ধারণ করার কোনো ইঙ্গিত মিলছে না। উলটো তারা এমন এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছেন, যা আন্দোলনের চেতনার সম্পূর্ণ পরিপন্থি। 

ইতোমধ্যে দলবাজি দখলবাজি এবং চাঁদাবাজি চলছে। দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ও দুদক সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামান সোমবার এক সম্মেলনে এসব কথা বলেন। তার মতে, অন্তর্বর্তী সরকারকে জনগণ রাষ্ট্র সংস্কারের অভূতপূর্ব ম্যান্ডেড দিয়েছে। 

একই অনুষ্ঠানে এসডিজি বাস্তবায়ন বিষয়ক নাগরিক ফ্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘আমরা লক্ষ্য করছি, বৈষম্যবিরোধী চেতনার পক্ষের শক্তিদের ভেতরে কেউ কেউ বিভিন্ন বৈষম্যকে টিকিয়ে রাখতে কাজ করছে। ফলে তারা আন্দোলনের মূল তাৎপর্যকে ক্ষুণ্ন করছে। 

রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ‘এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক ফ্ল্যাটফর্ম’ এই আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন ‘নির্বাচন কমিশন’ সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার। তার মতে, নির্বাচনে অন্যতম সমস্যা মনোনয়ন বাণিজ্য। এ ছাড়া বক্তব্য দেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান এবং সভাপতিত্ব করেন সিপিডির আরেকজন বিশেষ ফেলো ড. রওনক জাহান। 

বেশিরভাগ বক্তার সম্মিলিত বক্তব্যের সার কথা ছিল: বৈষম্যবিরোধী চেতনার পক্ষের শক্তির কেউ কেউ বৈষম্যের পক্ষে কাজ করছেন, বৈষম্য ধরে রাখতে চাচ্ছেন, যা দুঃখজনক। তবে সম্মেলনে অংশ নেওয়া যুব সমাজের তৃণমূল প্রতিনিধিদের দাবি দুটি। প্রথমত জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন এবং দ্বিতীয়ত এই নির্বাচনে দলীয় প্রতীক থাকতে পারবে না। 

ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ৫ আগস্ট  দেশে শুধু একটি মাইলফলক হয়েছে। একটা কর্তৃত্ববাদের পতন হয়েছে। আন্দোলনের ভিশনের সঙ্গে সবাই একমত। ভিশনগুলো হলো-নতুন বাংলাদেশ, রাষ্ট্র সংস্কার এবং নতুন রাজনৈতিক সমঝোতা। কিন্তু আমরা যারা এই ভিশনের ব্যানার ধরে আছি, তাদের সবার এজেন্ডা, চাহিদা এক রকম নয়। আমি যেটা চাই সেটা আপনার ওপর চাপিয়ে দিচ্ছি। 

তিনি বলেন, জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে যারা নিজেদের বিজয়ী ভাবছেন, মনে করছেন ক্ষমতায় এসে গেছেন, তাদের মধ্যে বৈষম্যবিরোধী মূল চেতনা ধারণ করার কোনো ইঙ্গিত আমরা দেখতে পাই না। বরং তারা এমন এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছেন, যার মূল ধারণা ও পদ্ধতি সম্পূর্ণ বৈষম্যমূলক। অর্থাৎ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের চেতনা সম্পূর্ণ পরিপন্থি। যার দৃষ্টান্ত আমরা দেখছি, দখলবাজি, চাঁদাবাজি চলছে। সামনে নির্বাচনের পর এটি ব্যাপকভাবে হবে, তারই ইঙ্গিত বহন করে। এটি দুভার্গ্যজনক। কিন্তু তাই বলে আমরা পিছপা হব না। 

অনেকে মনে করেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নির্বাচিত নয়। তাদের ক্ষমতার ভিত্তি নেই। কিন্তু এটি ঠিক নয়। কারণ অন্তর্বর্তী সরকারের রায় জনগণ দিয়েছে। এই সরকারকে যে ম্যান্ডেড দেওয়া হয়েছে, তা অভূতপূর্ব। আমি মনে করি কোনো নির্বাচিত সরকারেরও এই ম্যান্ডেড নেই। সেই সরকার কেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের চেতনাবিরোধী সব শক্তিকে পরাজিত করবে না, সেই দাবি আমাদের তুলতে হবে।  

তিনি বলেন, রাষ্ট্র কাঠামো সংস্কারের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রতিষ্ঠান দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কিন্তু দুদকের পূর্ণাঙ্গ সংস্কার হলেও এই প্রতিষ্ঠান একা দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। সবাইকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। তিনি বলেন, দেশের সাধারণ মানুষ কোনোভাবেই দুর্নীতিগ্রস্ত নয়। সরকার রাজনৈতিক শক্তি এবং আমলাতন্ত্র মিলে তাদের দুর্নীতিগ্রস্ত করে ফেলেছে। দেশের সম্পদ লুট হয়, মানুষ সেবা বঞ্চিত হয়, কিন্তু যারা এসব করেন, তারা বিচার পায় না। 

তিনি বলেন, রাজনৈতিক শক্তি ও আমলাদের ক্ষমতার প্রভাব না কমলে, দুর্নীতি কমবে না। আগে ধারণা করতাম মানুষ দুর্নীতিবাজদের ঘৃণা করে। কিন্তু এখন দেখছি মানুষ দুর্নীতিবাজকে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি করে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রধান করা হয়। অর্থাৎ মানুষ দুর্নীতিকে মেনে নিয়েছে। এই কালচার থেকে বের হয়ে আসতে না পারলে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ কঠিন। ইফতেখারুজ্জামান বলেন, জুলাই আগস্টে আমাদের তরুণ প্রজন্ম দুর্নীতির বিরুদ্ধে কর্তৃত্ববাদের পতন ঘটিয়েছে। ৫ আগস্টের বিপ্লবে তরুণদের ভিশন ছিল নতুন বাংলাদেশ, রাষ্ট্র সংস্কার এবং নতুন রাজনৈতিক সমঝোতা। কিন্তু এই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য যে পরিক্রমা প্রয়োজন, সেটি তরুণদের পক্ষে কঠিন। সেখানে পুরো সমাজের করণীয় আছে। 

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, বাংলাদেশে কর্তৃত্ববাদের বিকাশ যুগ যুগ ধরে হবে। এর অন্যতম কারণ দুর্নীতি। আমাদের নতুন সংস্কার ধারণার ক্ষেত্রেও ডাইভারসিটি বা বৈচিত্র্যের সংস্কার হচ্ছে না। সবাই কর্তৃত্ববাদের বিপক্ষে বলছে, কিন্তু কর্তৃত্ববাদের চর্চা বন্ধ করছে না। বর্তমানে দেশে আদিবাসী শব্দটি ব্যবহার করা যায় না। এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল শিক্ষা। কিন্তু বর্তমান সরকার সেখানে হাত দেয়নি। তবে একটি শিক্ষাক্রম পর্যালোচনা কমিটি হয়েছিল। সেই কমিটি বাতিল হয়েছে। কারণ সেখানে একজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে, তিনি বৈচিত্র্যের অধিকার নিয়ে উদ্বিগ্ন। অথচ তিনি শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে জোরালো ভূমিকা রেখেছেন। সবচেয়ে দুঃখজনক হলেও অন্তর্বর্তী সরকার দাবির মুখে সেই কমিটি বাতিল করেছে। শেইম (লজ্জাজনক)। টিআইবি প্রতিবাদ করে হুমকির মুখোমুখি হয়েছে। 

ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ৫ আগস্ট সবাই একত্রিত হয়ে আগের সরকারকে ফেলে দিলাম। সেই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের চেতনার মূল মন্ত্র আমাদেরকে ধারণ করতে হবে। আমরা লক্ষ্য করছি, বৈষম্যবিরোধী চেতনার পক্ষের শক্তিদের ভেতরে কেউ কেউ বিভিন্নভাবে বৈষম্যকে টিকিয়ে রাখার জন্য কাজ করছে। ফলে তারা আন্দোলনের মূল তাৎপর্যকে ক্ষুণ্ন করছে। 

দ্বিতীয় বিষয় হলো-এই আন্দোলনের মাধ্যমে যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, সেই সুযোগ কাজে লাগাতে আমাদের সবাইকে অংশ নিতে হবে। আমরা সংস্কারে অংশ না নিয়ে যদি মনে করি, আমার মনের মতো পরিবর্তন হয়ে যাবে, তবে বলতে হবে আমরা বোকার স্বর্গে বাস করছি। আন্দোলনের চেতনার পক্ষে আমাদের একতাবদ্ধ এবং সক্রিয় থাকতে হবে। তৎপরতা চালিয়ে যেতে হবে। 

ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আমাদের সংসদ ভবন লুই-আইকানের নকশায় করা অত্যন্ত সুন্দর ভবন। কিন্তু সেখানে যাতে সুন্দর মানুষগুলো যেতে পারে, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। 

তিনি বলেন, আমাদের নির্বাচনে সবচেয়ে বড় সমস্যা মনোনয়ন বাণিজ্য। এই বাণিজ্য কমাতে রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন দরকার। এজন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার সেই চরণ মনে পড়ে, আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে। রওনক জাহান বলেন, দেশে আমলা, রাজনীতিবিদ এবং ব্যবসায়ী সবই থাকবে। তাদেরকে বাদ দেওয়া যাবে না। কিন্তু তারাও যাতে ভালো কাজ করতে পারে, সেই উদ্যোগ নিতে হবে। 

ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ১৯৯০ সালে ড. রেহমান সোবহান ২৯টি টাস্কফোর্সের মাধ্যমে রাষ্ট্র সংস্কারের ধারণা দিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তী রাজনৈতিক সরকার এসে সেটি বাস্তবায়ন করেনি। এরপরেও অনেক কমিশন হয়েছে, রিপোর্ট দিয়েছে, কিন্তু বাস্তবায়ন হয়নি। গত সরকারের আমলে উন্নয়নের বিশাল বয়ান ছিল। কিন্তু এর বিপরীতে আরেকটি বয়ান আছে, যা হলো বৈষম্য। এখানে আয়, সম্পদ ও ভোগের বৈষম্য আছে। সেটি ক্রমেই বাড়ছে। 

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে তার প্রতিফলন ঘটেছে। তিনি বলেন, এই আন্দোলনে যারা জীবন দিয়েছেন, তাদের মূল লক্ষ্য অতীতের অবস্থা ভবিষ্যতে আর যাতে ফিরে না আসে। এজন্য আমাদের সবাইকে যার যার জায়গা থেকে কাজ করতে হবে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম