আইনজীবী হত্যায় কে ও কী বলছে ইসকন, তদন্তে পুলিশ
যুগান্তর ডেস্ক
প্রকাশ: ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:১০ এএম
চট্টগ্রামে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ও যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। পুলিশ জানিয়েছে, সাইফুল ইসলামকে কারা হত্যা করেছে, তা জানার জন্য তদন্ত শুরু হয়েছে।
মঙ্গলবার রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র ও হাটহাজারীর পুণ্ডরিক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাশ ব্রহ্মচারীর জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত। এ আদেশের পর আদালত চত্বরে চিন্ময়ের বিক্ষুব্ধ অনুসারীরা প্রিজনভ্যানের চারদিকে শুয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তাদের সরিয়ে দিতে টিয়ারসেল, সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ ও লাঠিচার্জ করে। এতে উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। সংঘর্ষের এক পর্যায়ে আদালত এলাকা থেকে প্রায় ৩০০ মিটার দূরে রঙ্গম কমিউনিটি সেন্টারের পাশে সহকারী সরকারি কৌঁসুলি (এপিপি) সাইফুল ইসলাম ওরফে আলিফকে (৩৫) কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির সভাপতি নাজিম উদ্দিন চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘বিক্ষোভকারীরা সাইফুল ইসলাম ওরফে আলিফকে চেম্বারের নিচ থেকে ধরে নিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছেন।’ এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে বুধবার কর্মবিরতির ডাক দিয়েছেন তারা।
চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির সভাপতি নাজিম উদ্দিন চৌধুরী আদালত থেকে প্রায় ৩০০ মিটার দূরে আইনজীবী সাইফুল ইসলামকে বিক্ষোভকারীরা কুপিয়ে মেরেছেন বলে দাবি করলেও চট্টগ্রাম ইসকন প্রবর্তক মন্দিরের পরিচালনা কমিটির সদস্য স্বতন্ত্র গৌরাঙ্গ দাস ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। আমাদের কাছে কোনো লাঠিও ছিল না।’
ঢাকায় আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের প্রতিনিধি অ্যাডভোকেট সুমন রায় এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘সাইফুল ইসলামকে দুষ্কৃতকারীরা হিন্দু ভেবে হত্যা করেছে।’
অন্যদিকে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের মুখপাত্র উপ-কমিশনার মো. রইস উদ্দিন জানান, হত্যা কে করেছে তা তদন্তের মাধ্যমে বেরিয়ে আসবে৷ তিনি বলেন, ‘আদালত প্রাঙ্গনে সংঘর্ষের ঘটনায় সাইফুল ইসলাম আলিফ নামে একজন নিহত হয়েছেন। কারা তাকে হত্যা করেছে, সেটি এখনো আমরা নিশ্চিত নই। তদন্ত শুরু হয়েছে, নিশ্চয়ই কারা হত্যা করেছে- সেটি বের হয়ে আসবে। সংঘর্ষে ১৩ জন পুলিশ সদস্য আহত হয়ে এখন পুলিশ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।’
সাইফুল ইসলাম লোহাগাড়ার চুনতি এলাকার জামাল উদ্দিনের ছেলে। বিকাল সাড়ে চারটার দিকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। সংঘর্ষের ঘটনায় আহত অবস্থায় আরও আটজন চমেক হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তারা হলেন- শ্রীবাস দাশ, শারকু দাশ, ছোটন, সুজিত ঘোষ, উৎপল ও এনামুল হক। জেনারেল হাসপাতালে আরও ১৯ জনকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।
দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে চট্টগ্রাম আদালতে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় গ্রেফতার হওয়া চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর জামিন নামঞ্জুর করা হয়। পরে তাকে কারাগারে পাঠানোর জন্য প্রিজনভ্যানে তোলা হয়। তখন চিন্ময়ের বিক্ষুব্ধ অনুসারীরা প্রিজনভ্যান আটকে দেন। প্রিজনভ্যানের চারপাশে শুয়ে অনেকে বিক্ষোভ শুরু করেন। পুলিশ, বিজিবি ও সেনাবাহিনী চেষ্টা করেও প্রিজনভ্যান আদালত প্রাঙ্গণ থেকে বের করে কারাগারে নিতে পারছিলেন না। বিকাল পৌনে তিনটার দিকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ার শেল নিক্ষেপ এবং লাঠিপেটা শুরু করলে বিক্ষোভকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন। এরপর শুরু হয় পুলিশ ও আইনজীবীদের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের ধাওয়া- পালটা ধাওয়া৷ এরই এক পর্যায়ে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
চট্টগ্রাম ইসকন প্রবর্তক মন্দিরের পরিচালনা কমিটির সদস্য স্বতন্ত্র গৌরাঙ্গ দাস বলেন, ‘আমাদের বলা হয়েছিল আজকে চিন্ময় প্রভু জামিনে ছাড়া পাবেন। আমরা তাকে বরণ করতে আদালতে গিয়েছিলাম। কিন্তু যখন জামিন হলো না, প্রভুকে প্রিজনভ্যানে তোলা হলো, তখন আমাদের ছেলে-মেয়েরা প্রিজন ভ্যানের চারপাশে শুয়ে পড়ে। তখন আমাদের কাছে কোনো লাঠিও ছিল না। তাহলে আমরা কিভাবে হত্যা করব? এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। পুলিশ যখন আমাদের বেধড়ক লাঠিপেটা করে, তখন আমরা কোথায় পালাব সেটাই খুঁজে পাচ্ছি না। আমি নিজেও আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছি। আমরাও চাই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের খুঁজে বের করা হোক।’
চমেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক নিবেদিতা ঘোষ জানান, আহত অবস্থায় সাত-আটজনকে নিয়ে আসা হয়েছে। তাদের একজনকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। হামলায় নিহত আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফকে জামায়াতের কর্মী দাবি করে এ ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান।
আদালত চত্বরের সংঘর্ষ কোতোয়ালি মোড় ও লালদিঘী হয়ে আন্দরকিল্লা পর্যন্ত এক কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। আতঙ্কিত লোকজন এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করতে থাকেন। এ সময় আদালত ও লালদীঘি এলাকায় বেশ কয়েকটি যানবাহন ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। আদালত এলাকায় এ ঘটনার পর আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে চট্টগ্রামে বিপুল সংখ্যক পুলিশ এবং ছয় প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের প্রতিনিধি অ্যাডভোকেট সুমন রায় মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রাজধানীর ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে সাংবাদিক সম্মেলন শেষে বলেন, ‘আমাদের অহিংস আন্দোলনে কিছু দুর্বৃত্ত ঢুকে আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করছে। আমাদের আন্দোলন কখনো সহিংস নয়। সোমবার রাতে শাহবাগে আমাদের আন্দোলনের ভেতরে কিছু দুর্বৃত্ত ঢুকে আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। চট্টগ্রামে হিন্দু মনে করে ওই আইনজীবীর ওপর হামলা চালানো হয়েছিল। এখন চট্টগ্রামে অন্য হিন্দু আইনজীবীরাও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন।’
সংবাদ সম্মেলনে বুধবারের মধ্যে চিন্ময় প্রভুকে জামিন দেওয়ার ব্যবস্থা করার আহ্বান জানানো হয়। নইলে তাকে যে কারাগারে রাখা হবে, সেই কারাগারের উদ্দেশে লংমার্চ করার ঘোষণা দেওয়া হয়। বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের প্রতিনিধি অ্যাডভোকেট সুমন রায় বলেন, চিন্ময় প্রভুকে মুক্তি না দিলে সনাতনীরা স্বেচ্ছায় কারাবরণ করতে প্রস্তুত।
চিন্ময় কৃষ্ণ দাশকে গ্রেফতারের প্রতিবাদে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় সনাতনী সম্প্রদায়ের মানুষ বিক্ষোভ করেছেন।
এদিকে চট্টগ্রামে আইনজীবী হত্যার নিন্দা জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ও যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ার নির্দেশ দেওয়ার পাশাপাশি তিনি জনগণকে শান্ত থাকার এবং অপ্রীতিকর কার্যকলাপ থেকে দূরে থাকার আহ্বান জানান। এছাড়া তিনি আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলিকে বন্দর নগরীসহ সমস্ত ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করার নির্দেশও দেন। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার যেকোনো মূল্যে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিশ্চিত করতে ও সমুন্নত রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
সনাতন ধর্মবিশ্বাসীদের সংগঠন আন্তর্জাতিক শ্রীকৃষ্ণ ভাবনামৃত সংঘের (ইসকন) আলোচিত সংগঠক ছিলেন চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী। তবে সম্প্রতি সংগঠনটি তাকে বহিষ্কারের ঘোষণা দেওয়ার পর থেকে তিনি সনাতনী জাগরণ জোটের ব্যানারে নানা কর্মসূচি পালন করে আসছিলেন। গত ২৫ অক্টোবর চট্টগ্রামের লালদীঘি মাঠে জনসভার পর ৩০ অক্টোবর রাতে তাকেসহ ১৯ জনকে আসামি করে চট্টগ্রাম নগরীর কোতোয়ালি থানায় রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করেন বিএনপি নেতা ফিরোজ খান। মামলা করার পর বিএনপি ফিরোজ খানকে বহিষ্কার করে। গত সোমবার ঢাকা থেকে গোয়েন্দা পুলিশ আটক করার পর ওই মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়। তথ্যসূত্র: ডয়চে ভেলে