সিপিডির সংলাপে বক্তারা
ব্যবসার নীতি সংস্কারে কমিটি গঠনের তাগিদ
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৫১ পিএম
দুর্নীতি, আমলাতন্ত্রের অদক্ষতা, বৈদেশিক মুদ্রার ভারসাম্যহীনতা, অর্থায়ন জটিলতা ও মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি ক্রমশ ব্যবসাকে বাধাগ্রস্ত করছে। তার ওপর ব্যবসাভেদে সনদ গ্রহণ জটিলতা তো আছেই। সিটি করপোরেশন থেকে ট্রেড লাইসেন্স, আমদানি ও রপ্তানি প্রধান নিয়ন্ত্রকের দপ্তর থেকে আমদানি-রপ্তানি সনদ এবং কোম্পানি নিবন্ধন নিতে হয় যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মগুলোর পরিদপ্তর থেকে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে ও প্রতিযোগী সক্ষমতা বাড়াতে ব্যবসা-বাণিজ্যসংক্রান্ত এ ধরনের আইন-কানুন ও নীতি সংস্কার জরুরি। এক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধান, নির্বাচন কমিশন সংস্কারে যেমন সংস্কার কমিটি গঠন করেছে, তেমনি ব্যবসার নীতি সংস্কারে কমিটি গঠন করতে পারে। রোববার রাজধানীর মহাখালীর ব্র্যাক ইন সেন্টার বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত সংলাপে বক্তারা এসব কথা বলেন।
সংলাপে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুনের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি ছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ দূত অধ্যাপক লুৎফে সিদ্দিকী। বিশেষ অতিথি ছিলেন বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন। সম্মানিত অতিথি ছিলেন এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি আব্দুল আউয়াল মিন্টু। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।
২০২৪ সালের ব্যবসা সূচকের জরিপের ফলাফল তুলে ধরে ড. গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বৈশ্বিক প্রতিযোগী সক্ষমতা প্রতিবেদনে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ভারত, শ্রীলংকার চেয়ে পিছিয়ে ছিল, এখন নেপাল থেকেও পিছিয়ে গেছি। দুর্নীতি, অদক্ষ আমলাতন্ত্র, মূল্যস্ফীতি, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, নীতির ধারাবাহিকতার অভাব, উচ্চ করহার ব্যবসা সহজীকরণের বাধা। বর্তমানে তৈরি পোশাক খাতের ব্যবসা শুরু করতে ১৮-২০ ধরনের সনদ গ্রহণ করতে হয়। কিন্তু এসব সনদের প্রকৃতি একই। এই সনদ গ্রহণ প্রক্রিয়া অনলাইনে করা গেলে ব্যবসা খরচ ও সময় দুটোই বাঁচবে। তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সদস্যদের আর্থিক বিবরণী জনসমক্ষে প্রকাশ করা উচিত। একইসঙ্গে রাজনীতিবিদ ও আমলারা যেন শুল্কমুক্ত সুবিধায় গাড়ি আমদানি এবং বাড়ি বরাদ্দ বা কেনার ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা না পান সে সংক্রান্ত বিধিবিধান সংস্কার করা উচিত। ধুঁকতে থাকা ১-২টি ব্যাংক বন্ধ করে দেওয়ার মাধ্যমে ব্যাংকিং খাতে সুশাসন ফেরানো যেতে পারে।
মূল প্রবন্ধের ওপর আলোচনায় বক্তারা বলেন, সদ্য অনুষ্ঠেয় মার্কিন নির্বাচনে দেশটির শীর্ষ উদ্যোক্তা ইলন মাস্ককে সরকারি দরের দক্ষতা বাড়ানোর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আর বাংলাদেশে ব্যবসাসংক্রান্ত নীতি প্রণয়ন করেন আমলারা। ব্যবসা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না থাকায় ব্যবসাসংক্রান্ত নীতিগুলো প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। যেমন বাংলাদেশে একটি ব্যবসা শুরু করতে একজন উদ্যোক্তার ১৮-২০ ধরনের সনদ নিতে হয়। পক্ষান্তরে সিঙ্গাপুরের মতো উন্নত রাষ্ট্রে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ আয়ের পূর্বে উদ্যোক্তাদের কোন ধরনের রেগুলেশন মানতে হয় না। সনদ গ্রহণগত জটিলতা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা টেকনোলজি ট্রান্সফার করে। এক্ষেত্রে মেধাস্বত্ব আইন, কপিরাইট আইনের বাস্তবায়ন জরুরি। একইসঙ্গে বিদেশিদের আস্থা অর্জনে বাংলাদেশে ব্যবসারত বিদেশি কোম্পানিগুলোকে সেবা দেওয়ার দিকেও মনোযোগী হতে হবে।
আলোচনায় অংশ নেন বিডিজবসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহিম মাশরুর, পিকার্ড বাংলাদেশের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক অমৃতা ইসলাম, ঢাকা চেম্বারের সভাপতি আশরাফ আহমেদ, বিকেএমইএ নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান ও ফরেন চেম্বারের সভাপতি জাভেদ আকতার।
এফবিসিসিআই’র সাবেক সভাপতি আব্দুল আউয়াল মিন্টু বলেন, সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। যেমন ৮ হাজার বছর সময় লেগেছিল কৃষি যুগ থেকে শিল্প যুগে প্রবেশ করতে। এর ৩০০ বছর পর দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লব হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশে সংস্কারটা করবে কে, কীভাবে করবে? এমন মেকানিজম তৈরি করতে হবে যাতে এটি চলমান থাকে। তিনি আরও বলেন, দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির কাছে সংস্কার আশা করাটা অপ্রত্যাশিত। তারা যা করতে পারে তা আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি গত ২০-৩০ বছরে। এই দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতি নিজের স্বার্থে একটি গোষ্ঠী তৈরি করে, যারা জ্বালানি, ব্যাংকিংসহ সব খাতকে ধ্বংস করে। যদি বাংলাদেশে উন্নতির জন্য সংস্কার প্রয়োজন হয়, তবে সবার আগে রাজনীতির সংস্কার করতে হবে। রাজনীতিবিদরা দুর্বৃত্তায়িত তারা দেশের জন্য ও ব্যবসার জন্য সঠিক নীতি প্রণয়ন করতে পারবে না।
মিন্টু বলেন, মুদ্রানীতির কাজ কী শুধু মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা। এটার কাজ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা, মুদ্রা বিনিময় হারে ভারসাম্য রাখা। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রানীতি প্রণয়ন করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে। এখন বাংলাদেশে একটিই স্বৈরাচারি প্রতিষ্ঠান আছে, সেটা হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই কেন্দ্রীয় ব্যাংক সব বেসরকারি ব্যাংককে ধ্বংস করে দিচ্ছে। কিছু ব্যাংককে ইচ্ছাকৃতভাবে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। স্বৈরাচারি মনোভাব থেকে বেরিয়ে আসতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পুনর্গঠন করা জরুরি।
বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বলেন, বিনিয়োগকারীদের জন্য প্রকৃত অর্থে অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোকে প্রস্তুত করা হচ্ছে। ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের বদলে ১০টির কম অর্থনৈতিক অঞ্চল নিয়ে কাজ করছি। একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রতিটি অঞ্চলে পানি, বিদ্যুৎ ইউটিলিটিসহ সব সুবিধা এসব স্থানে সরবরাহ করা হবে। ব্যবসায়ীরা সেসব বিবেচনায় নিয়ে বিনিয়োগ করবে। তিনি আরও বলেন, ডিজিটাইজেশনের মাধ্যমে দুর্নীতি অনিয়ম বন্ধ করা যাবে-এটা সবাই ভাবেন। তাত্তি¡কভাবেও এটি ঠিক আছে। তবে সরকারের ভেতরে থেকে এটি করা মুশকিল।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ দূত অধ্যাপক লুৎফে সিদ্দিকী বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত নীতি সংস্কারে সংস্কার কমিটি করার প্রয়োজন হলে সরকার সেটা বিবেচনা করতে পারে। ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রস্তাব পেলে সেটা উপদেষ্টা পরিষদে আলোচনা করা হবে।