উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ মিলে প্রায় ৪০ শতাংশ কমিশন
গণপূর্তে কমিশন বাণিজ্য ‘ওপেন সিক্রেট’
প্রকাশ: ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ১০:১০ এএম
ফাইল ছবি
উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ কাজে গণপূর্ত অধিদপ্তরের কমিশন বাণিজ্য ‘ওপেন সিক্রেট’। ঠিকাদারদের কাছ থেকে মন্ত্রী, সচিব, প্রকৌশলী, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিভিন্ন ধাপে উন্নয়ন কাজে বিলের প্রায় ৮ শতাংশ এবং রক্ষণাবেক্ষণ কাজে বিলের ৩২ শতাংশ কমিশন গুনতে হয়। ২০১৮-২০১৯ অর্থবছর থেকে ২০২৩-২০২৪ অর্থাৎ ৬ অর্থবছরে এই হারে কমিশনে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা হাওয়া হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
তারা বলেন, বিগত ছয় অর্থবছরে গণপূর্ত অধিদপ্তরে উন্নয়ন এবং রক্ষণাবেক্ষণ খাতে খরচ হয়েছে ৫৫ হাজার ২৬৯ কোটি টাকা। গণপূর্তের নিজস্ব উন্নয়ন কাজের পাশাপাশি ডিপোজিট ওয়ার্ক হিসাবে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণলায়, দপ্তর ও সংস্থার কাজ বাস্তবায়ন করেছে। এছাড়া সরকারি অফিস ও মন্ত্রী-সচিব এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কোয়ার্টারের রক্ষণাবেক্ষণ এবং সেবা নিশ্চিতেও বিপুল অর্থ খরচ হয়েছে। মাঠ পর্যায়ের প্রকৌশলী, কর্মকর্তা-কর্মচারী, অধিদপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলী-কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী এবং সচিবরাও নিয়েছে কমিশন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গণপূর্তের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজে প্রায় ৮ শতাংশ কমিশন দিতে হয় ১১ জায়গায়; সেই ভাগ্যবানদের তালিকায় রয়েছে-দরপত্র আহ্বানকারী নির্বাহী প্রকৌশলী ১ শতাংশ, প্রধান প্রকৌশলী ১ শতাংশ, মন্ত্রণালয়ের সচিব ১ শতাংশ, মন্ত্রী ১ শতাংশ এবং নির্বাহী প্রকৌশলীর দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্তদের ১ শতাংশ। এছাড়া তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী, উপসহকারী প্রকৌশলী, উপবিভাগীয় প্রকৌশলী, কার্যসহকারী ও হিসাব সহকারী এবং অন্যান্য খাতে আধা শতাংশ করে প্রায় ৩ শতাংশ কমিশন গুনতে হয়।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, গণপূর্তের মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজে ১১ জায়গায় কমিশন বাণিজ্যে চলে যাচ্ছে প্রায় ৩২ শতাংশ টাকা।
ওই ভাগ্যবানদের তালিকায় রয়েছেন-কার্যসহকারী ১ শতাংশ, উপসহকারী প্রকৌশলী ৫ শতাংশ, উপবিভাগীয় প্রকৌশলী ৫ শতাংশ, নির্বাহী প্রকৌশলী ১০ শতাংশ, সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ৩ শতাংশ, সার্কেলের স্টাফ অফিসার ২ শতাংশ, জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ২ শতাংশ এবং জোনের অন্যান্য কর্মচারী ২ শতাংশ, জোনের উপহিসাবরক্ষক (ডিএ) ১ শতাংশ, হিসাব সহকারী এবং অন্যান্য খাতে ১ শতাংশ। অর্থাৎ গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রকল্প ও রক্ষণাবেক্ষণ দুটি কাজের মোট কমিশন বাণিজ্যের যোগফল দাঁড়ায় প্রায় ৪০ শতাংশ; যার গড় পরিমাণ প্রায় ২০ শতাংশ। গণপূর্তের ঠিকাদার, বিভিন্ন পর্যায়ের প্রকৌশলী এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্য থেকে প্রায় ২৫ জনের সঙ্গে কথা বলে কমিশন বাণিজ্যের চাঞ্চল্যকর এমন চিত্র বেরিয়ে এসেছে। তাদের দৃঢ় অভিমত, অনিয়ম-দুর্নীতি ও লুটপাটের চিত্র এর চেয়ে বেশি ছাড়া কোনো অংশে কম নয়। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআইবি) মতো সংস্থাগুলোকে এই সংস্থার দুর্নীতির চিত্রগুলো খতিয়ে দেখা উচত বলে মনে করেন তারা।
কয়েকজন প্রকৌশলী যুগান্তরকে জানান, গণপূর্তের নির্মাণকাজের মানের সুনাম রয়েছে। কেননা কাজগুলোর যথাযথ মান নিশ্চিত করা হয়ে থাকে। তাছাড়া গণপূর্তের প্রকৌশলীরা দেশের সেরা। এজন্য প্রকল্পের কাজে লোপাট রক্ষণাবেক্ষণ কাজের চেয়ে কিছুটা কম। তবে এটাও সত্য যে, প্রকল্পের আকারও অনেক বেশি হয়ে থাকে। আর মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ কাজের কমিশনও বেশি। কেননা এখানে কাজের প্রাক্কলন করা হয় বাস্তব মূল্যের চেয়ে দ্বিগুণ বেশি। এর মধ্যে এক অংশ দিয়ে কাজ হয়। বাকি একাংশ কমিশনে চলে যায় এবং অবশিষ্ট অংশ ঠিকাদারের লাভ এবং ভ্যাট-ট্যাক্স বাবদ খরচ হয়।
তারা বলেন, অর্থবছরের শুরুতে গণপূর্ত থেকে ভবন ও স্থাপনার মূল্যের ২ শতাংশ হারে মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় প্রস্তাব করা হয়। যার আকার দাঁড়ায় প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা। তবে সরকার বছরভেদে ১ থেকে দেড় হাজার কোটি টাকা মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ খাতে বরাদ্দ দেয়। সেটারও দুই ভাগ হাওয়া করে দেয় প্রকৌশলী, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ঠিকারদারচক্র।
গণপূর্ত অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে ৩৭টি মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ ৭ হাজার ৪২৩ কোটি টাকা খরচ করেছে গণপূর্ত অধিদপ্তর। একইভাবে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের ৩৬টি মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের কাজে খরচ হয়েছে ৭ হাজার ৯৫ কোটি টাকা, ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ৩৭টি মন্ত্রণালয়, দপ্তর ও বিভাগে খরচ হয়েছে ৬ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা, ২০২১-২০২২ অর্থবছরে ৩৮টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কাজে খরচ হয়েছে ৮ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা, ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে ৩৭টি মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও দপ্তরের কাজে খরচ হয়েছে ৯ হাজার ২৪১ কোটি টাকা এবং ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ৩২টি মন্ত্রণালয়, দপ্তর ও বিভাগের কাজে ব্যয় হয়েছে ৬ হাজার ৯৯৯ কোটি টাকা।
আরও জানা যায়, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সংস্থা বিভিন্ন সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়ন করে থাকে। অন্যতম কাজের মধ্যে রয়েছে-ভবন নির্মাণ, পার্ক বা উদ্যান নির্মাণ, অ্যাপ্রোচ সড়ক নির্মাণ, অফিস বা ভবনের সব ধরনের রক্ষণাবেক্ষণ এবং সৌন্দর্যবর্ধনমূলক কাজ। এছাড়া সরকারি প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণ, ভূমি সার্ভে, সয়েল টেস্ট, স্ট্রাকচারাল ডিজাইনসহ প্রভৃতি কাজ করে থাকে। এসব কাজ বাবদ সরকার গণপূর্তকে অর্থ বরাদ্দ দিয়ে থাকে। প্রায় ২০০ বছর ধরে গণপূর্ত অধিদপ্তর এ অঞ্চলের উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ কাজে ভূমিকা রেখে চলেছে। শুরু থেকেই কমিশন বাণিজ্যের রীতি ছিল; যা সময়ের ব্যবধানে রূপ বদল করে পরিমাণে বেড়েছে।
গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সাবেক এক সচিব জানান, গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলীর মাঠ পর্যায়ের কাজের তেমন অভিজ্ঞতা নেই। বিভিন্ন ধরনের অফিশিয়াল কাজ করেছেন। এজন্য গণপূর্তের মতো গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার প্রধান প্রকৌশলীর দায়িত্ব পেলেও তা যথাযথভাবে পালন করতে পারছেন না। প্রকল্প বাস্তবায়ন, কাজের মান সংরক্ষণ এবং অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধে কার্যত কোনো ভূমিকা রাখতে পারছেন না। তবে নিজে ঘুস বা দুর্নীতি করেন না বলে দাবি করে থাকেন। সেটা সত্য ধরে নিলেও তিনি চরমভাবে ব্যর্থ। গণপূর্তের চরম বিশৃঙ্খলা এবং ভয়াবহ অনিয়ম ও দুর্নীতির দায় তিনি কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না।
অভিযোগ প্রসঙ্গে গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামীম আখতার যুগান্তরকে বলেন, কমিশন বাণিজ্যের কোনো প্রমাণ আপনার কাছে আছে? জবাবে গণপূর্তে কমিশন বাণিজ্য হয় না এমন কথা বলতে চাচ্ছেন কিনা-জানতে চাইলে বলেন, গণপূর্তে কমিশন বাণিজ্য নেই, এটা বলতে পারি না। তবে কোনো প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়ে থাকে।
তিনি বলেন, ঠিকাদার-প্রকৌশলীরা গোপনে আঁতাত করে কিছু করলে সেটা তো কর্তৃপক্ষ বুঝতে পারবে না। আর কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ বা প্রমাণ ছাড়াত প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করারও সুযোগ নেই।