‘মাইনাস-টু ফর্মুলার’ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে সতর্ক করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
৫ আগস্টের পর বর্তমান পরিস্থিতিতে ‘বিএনপি বা এর শীর্ষ নেতৃত্বকে’ রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেওয়ার কোনো ইঙ্গিত দলটি পাচ্ছে কি না সেই প্রশ্নও আলোচিত হচ্ছে।
বিষয়টি রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা সৃষ্টি করেছে। সরকারের একজন উপদেষ্টা বলেছেন, মাইনাস-টু নিয়ে তাদের কোনো চিন্তা নেই। এদিকে, ছাত্র আন্দোলন নেতা আব্দুল হান্নান মাসউদ বলেছেন, তারা বিএনপিকে রাজনীতি থেকে বাদ দিতে চান না, তবে বিএনপি কেন এমন ধারণা করছে, তা তাদের জানা নেই।
মাইনাস-টু ফর্মুলা প্রথম উঠে আসে ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়; যখন খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে সরানোর চেষ্টা করা হচ্ছিল বলে অভিযোগ উঠেছিল। এখন আবার, আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর বিএনপি দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানালেও সরকার সংস্কারের ওপর জোর দিচ্ছে, যার মধ্যে নির্বাচন কমিশন, সংবিধান, পুলিশ ও প্রশাসন সংস্কারের কমিশন গঠন করা হয়েছে।
মাইনাস-টু বিষয়ে কী বলেছেন বিএনপি মহাসচিব
সোমবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ২০০৭ সালে ১/১১-এর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সময় বিরাজনীতিকরণে এবং মাইনাস-টু ফর্মুলা বাস্তবায়নের ব্যর্থ চেষ্টা হয়েছিল।
তিনি বলেন, সেই পথ অনুসরণ করার কথা চিন্তাও করা উচিত নয়। আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, বিএনপিকে কোনো ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে বাদ দেওয়ার চেষ্টা করবেন না। কারণ বাংলাদেশের জনগণ কখনোই তা মেনে নেবে না। আওয়ামী লীগ বিএনপিকে নানাভাবে ভাঙার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে, ভবিষ্যতেও পারবে না।
মির্জা ফখরুল বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একজন উপদেষ্টা অপ্রত্যাশিত ও অযাচিত মন্তব্য করে বলেছেন, রাজনীতিবিদরা ক্ষমতায় যেতে অস্থির। ‘এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। তার মতো কোনো ব্যক্তি এ ধরনের মন্তব্য করবেন তা আমরা আশা করি না’।
তিনি বলেন, ‘আমরা আশা করিনি, এ মাপের মানুষ এ ধরনের কথা বলবেন। আমরা রাজনীতিবিদরা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য উসখুস করি না। আমরা বাংলাদেশকে হাসিনামুক্ত করার জন্য কাজ করেছি। জীবন দিয়েছি, প্রাণ দিয়েছি, এখন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা দ্রুত নির্বাচন দাবি করছি।’
দেশে অতি দ্রুত নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহবান জানিয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘দ্রুত নির্বাচনে যত দেরি করবেন, তত হাসিনারা আবার ফিরে আসবেন। তাই এখনো বলছি, আবারও বলছি, অতি দ্রুত নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করুন। জঞ্জাল যা আছে, তা সাফ করে ফেলুন।’
সোমবার সরকারের একজন উপদেষ্টা সচিবালয়ে এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘আমাদের হাতে সময় খুবই কম। কম সময়ে কতটুকু কাজ করতে পারব জানি না। রাজনীতিবিদরা ক্ষমতায় যেতে উসখুস করছেন। আমিও আমার শিক্ষকতা পেশায় ফিরে যেতে চাই।’
সরকারের দিক থেকে যা বলা হচ্ছে
বিএনপির মহাসচিবের বক্তব্য গণমাধ্যমে আসার পর আজ সরকারের দুজন উপদেষ্টা বিষয়টি নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে দিয়েছেন।
উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সাংবাদিকদের বলেছেন, নির্বাচনকে বিএনপি অগ্রাধিকার দেবে সেটাই স্বাভাবিক এবং সরকারেরও চূড়ান্ত লক্ষ্য সেটি। তবে নির্বাচনের আগে কোথাও কতটুকু সংস্কার দরকার সেদিকেও সরকারকে মনোযোগ দিতে হচ্ছে।
আরেকজন উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেছেন, মাইনাস-টু কোনভাবেই বর্তমান সরকারের কোনো এজেন্ডা না। এ ধরনের কথা বলা অহেতুক তর্ক, অহেতুক সমস্যা ও জনমনে আশঙ্কা সৃষ্টি করা হয়। অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো চিন্তায় এমন কিছু নেই।
মাইনাস টু প্রসঙ্গ এলো কেন
মাইনাস-টু বিষয়ে নিজের বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, আমরা আসলে বিরাজনীতিকরণের বিষয়ে সবাইকে সতর্ক করছি। আমরা সবসময় বলে আসছি সংস্কারের পাশাপাশি নির্বাচনের জন্য যাতে দ্রুত জনপ্রত্যাশা অনুযায়ী গণতন্ত্রে উত্তরণে সম্ভব হয়।
তিনি বলেন, ‘অনেকে নানা ধরনের কথা বলছেন বলে আমরা শুনছি। সংবিধান সংস্কারসহ আর কিছু বিষয়ে আমরা বলেছি যে এগুলো জনগণের নির্বাচিত সংসদ বা জনপ্রতিনিধিদের কাজ। সে কারণেই আমরা জরুরি সংস্কারের পাশাপাশি নির্বাচনের কথা বলছি।’
কিন্তু মাইনাস টু অর্থাৎ বিএনপি চেয়ারপার্সন বা শীর্ষ নেতৃত্বকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে নেওয়ার কোনো আশঙ্কা বিএনপি করছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘না, আমরা সেটি বলছি না। আমরা বিরাজনীতিকরণের বিষয়ে সবাইকে সতর্ক করার কথা বলছি। বিরাজনীতিকরণের চিন্তা জাতির জন্য ভালো ফল আগেও আনেনি, ভবিষ্যতেও আনবে না।’
ক্ষমতা থেকে উৎখাত হওয়ার পর থেকে গত তিন মাস ধরে আওয়ামী লীগের কোন কার্যক্রম দেখা যাচ্ছে না। দলটির প্রধান শেখ হাসিনা, সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ বেশিরভাগ নেতাই বিভিন্ন দেশে পালিয়ে গেছেন বা লুকিয়ে রয়েছেন। এর মধ্যেই ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
শেখ হাসিনাসহ দলটির অনেক নেতার বিরুদ্ধে এর মধ্যেই শতাধিক মামলা হয়েছে। সাবেক মন্ত্রী-এমপিসহ অনেক নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মানবতা বিরোধী অপরাধে দলের প্রধান শেখ হাসিনার বিচারের প্রক্রিয়া চলছে।
গত মাসে শেষের দিকে আওয়ামী লীগকে ‘একটি ফ্যাসিস্ট দল’ বর্ণনা করে তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ‘যদি আওয়ামী লীগ ফিরে আসে, তাহলে গণ–অভ্যুত্থান ও শহীদদের সঙ্গে প্রতারণা করা হবে। আমাদের জীবন থাকতে তা হতে দেওয়া হবে না।’
ফলে কার্যত এখন বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে আওয়ামী লীগ ও দলটির সভানেত্রী শেখ হাসিনা বাইরে চলে গেছেন।
এখন বিএনপির মধ্যেও আশঙ্কা তৈরি হয়েছে যে, তাদেরকেও রাজনীতির মাঠ থেকে বাইরে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা হতে পারে।
বিএনপির একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সংসদ নির্বাচনের কার্যক্রম দ্রুতগতিতে শুরু না করে রাষ্ট্রপতি পরিবর্তনের চেষ্টা, সরকার ঘনিষ্ঠদের কিংস পার্টি গঠনের তৎপরতা, সংবিধান সংস্কার নিয়ে অতিমাত্রায় আগ্রহ এবং তারেক রহমানের দেশে ফেরার ক্ষেত্রে থাকা আইনি বাধা অপসারণে ধীরগতিসহ কিছু বিষয় নিয়ে দলটির নেতৃত্ব কিছুটা অসন্তুষ্ট।
এছাড়া বিএনপিকে ইঙ্গিত করে সরকারের কিছু উপদেষ্টা ও সরকার ঘনিষ্ঠ ছাত্রনেতাদের কয়েকজনের বক্তব্যও দলটির নেতাকর্মীদের ক্ষুব্ধ করেছে। তাদের কেউ কেউ মনে করছেন ‘বিএনপিকে উপেক্ষা করার একটা’ ইঙ্গিত ক্রমশ দৃশ্যমান হচ্ছে।
দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, তারা মনে করেন বাংলাদেশের বাস্তবতায় বিএনপি সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল এবং সে কারণে যা কিছু করার সেটা বিএনপিকে আস্থায় নিয়েই করতে হবে- এটাই বিএনপি মহাসচিব বোঝাতে চেয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘কিন্তু কারও কারও মন্তব্য বা কোন কোন মহল এমন কিছুর আভাস দিচ্ছেন যে মনে হচ্ছে তারা বিএনপিকে উপেক্ষা করতে চাইছেন। মনে রাখতে হবে শেখ হাসিনা অনেক চেষ্টা করেও খালেদা জিয়াকে মাইনাস করতে পারেনি। সেখানে বড় দল হিসেবে এখনও বিএনপিকে উপেক্ষা করা যাবে না।’
কিন্তু খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে রাখা বা তারেক রহমানকে দেশে ফেরতে দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা তৈরি করা – এমন কোনো বিষয় আছে কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এমন দুরভিসন্ধি কেউ পোষণ করতে পারেন। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হবে না। বরং আমরা পরিষ্কার করে বলে দিতে পারি বাংলাদেশে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে বাইপাস করে কিছু হবে না।’