গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে পলাতক ঢাকা ওয়াসার সদ্য পদত্যাগ করা ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী তাকসিম এ খান। গত ১৪ আগস্ট তিনি ই-মেইলের মাধ্যমে পদত্যাগ করেছেন। গত ২০ আগস্ট বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। নিষেধাজ্ঞার পরও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন তিনি। নিষেধাজ্ঞা দিলেও তাকে গ্রেফতারের ব্যাপারে দায়িত্ব পাওয়া সংস্থাগুলোর কার্যকর তৎপরতা নেই বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা : ঢাকা ওয়াসার আলোচিত সদ্য পদত্যাগ করা ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী তাকসিম এ খানের বিদেশ যাত্রায় ২০ আগস্ট নিষেধাজ্ঞা দিয়ে চিঠি দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে কমিশনের অনুমোদনক্রমে অনুসন্ধান কর্মকর্তা সৈয়দ নজরুল ইসলাম এ সংক্রান্ত চিঠি আদালত ও পুলিশের বিশেষ শাখায় পাঠান। দুদক গত বছরের ২৩ মে ঢাকা ওয়াসার অবৈধ নিয়োগের অভিযোগ অনুসন্ধান শেষে মামলা অনুমোদনের জন্য সুপারিশ চেয়ে প্রতিবেদন দাখিল করে।
দুদক সূত্র জানায়, অনুসন্ধানে পরিচালক (উন্নয়ন) ও পরিচালক (কারিগর) এই দুটি পদ ওয়াসার অর্গানোগ্রামে না থাকা সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠানটির এমডি প্রভাব খাটিয়ে দুজনকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের প্রমাণ পাওয়া যায়। আর ৪ বছরের বেশি সময় ধরে তাদের বেতন বাবদ ১ কোটি ৯৮ লাখ ৬৫ হাজার ৯৮০ টাকা দেওয়া হয়েছে। নিয়মবহির্ভূতভাবে নিয়োগ হওয়ায় এই পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে অভিযোগ আনা হয়েছে।
অবৈধ নিয়োগ দিয়ে তারা দুর্নীতি আইন ১৯৪৭ এর ৫(২) ধারা ও দণ্ডবিধির ১০৯ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন উল্লেখ করে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী তাকসিম এ খান ও পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যানসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার সুপারিশ করে কমিশনে অনুসন্ধান প্রতিবেদন দাখিল করেছিল, যদিও অদৃশ্য কারণে ওই মামলা হয়নি। এখন নতুন করে বিভিন্ন প্রকল্প ও রাজস্ব খাত এবং নিয়োগের অনিয়ম ও দুর্নীতির তদন্ত করছে দুদক।
কর্তৃপক্ষের বক্তব্য : ঢাকা ওয়াসার বর্তমান এমডি ও সরকারের অতিরিক্ত সচিব ফজলুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, প্রকৌশলী তাকসিম এ খানের সময়ে ঢাকা ওয়াসায় অনেক অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে বলে যোগদানের পর জানতে পেরেছি। ইতোমধ্যে দুদক ওই সময়ের প্রকল্প, রাজস্ব খাত এবং নিয়োগের অনিয়ম ও দুর্নীতির তদন্ত শুরু করেছে। ঢাকা ওয়াসার পক্ষ থেকে সেসব তথ্য সরবরাহ করতে কর্মকর্তা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। ওই কর্মকর্তা দুদকের চাহিদাকৃত তথ্য সরবরাহ করছে এবং একটি কপি আমার দপ্তরে রাখছে। দুর্নীতি তদন্তে সব ধরনের সহায়তা অব্যাহত থাকবে।
তাকসিমের দুর্নীতি: ঢাকা ওয়াসা কর্মকর্তা ও কর্মচারী ঐক্য পরিষদের নেতারা সরকারকে লেখা চিঠিতে অভিযোগ করেন, পদ্মা (যশলদিয়া) পানি শোধনগার প্রকল্পের সঞ্চালন লাইন নির্মাণে দুর্নীতি হয়েছে ৬০০ কোটি টাকা, দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগারের নিন্মমানের যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ৬০০ কোটি টাকা, পানি ও পয়ঃবিলের ৩ হাজার ২২১ কোটি টাকা, ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের ৬২১ কোটি টাকা। তাদের অভিযোগ, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে বিতাড়িত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আত্মীয় বলে তিনি আইনের তোয়াক্কা না করে যা খুশি তাই করেছেন। অন্যায়ভাবে অনেককে চাকরিচ্যুত করেছেন। উচ্চ আদালতের নির্দেশনার পরও অনেককে স্বাভাবিক কার্যক্রম করতে দেননি। ৫ আগস্টের পর ঢাকা ওয়াসার কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা তাকে গ্রেফতারের দাবিতে আন্দোলন করেছেন। এর কিছুদিন পর তিনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা ওয়াসা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী ড. গোলাম মোস্তফা জানান, প্রকৌশলী তাকসিম ছিলেন বেপরোয়া। অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে ঢাকা ওয়াসাকে রুগ্ণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছেন। তার সময়ে চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থেকেও অতিষ্ঠ হয়ে ২০২৩ সালের ১৭ মে স্থানীয় সরকার বিভাগে প্রকৌশলী তাকসিমের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে চিঠি লিখেছিলেন। মন্ত্রণালয় তার তদন্ত না করে উপরন্তু অভিযোগ দেওয়ার ৪ দিনের মাথায় তাকে সরিয়ে দেয়। দুর্নীতির টাকার জোরে তিনি ধরাকে সরা জ্ঞান করেছেন। এসব অনিয়মের কোনো তদন্ত বা শাস্তি হয়নি, উপরন্তু তাকে রাজনৈতিকভাবে সহযোগিতা করা হয়েছে।
তিনি আরও জানান, ঢাকা ওয়াসায় তাকসিমের সময়ে ভয়াবহ অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে; তা খুবই পরিষ্কার। পদ্মা (যশলদিয়া), দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার প্রকল্পে সঠিক তদন্ত করলে তা পরিষ্কার হয়ে যাবে। এছাড়া আরও যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে, সেগুলোও সরকার তদন্ত করতে পারে। দুদক একবার তদন্ত শুরু করে রহস্যজনক কারণে থেমে যায়। মন্ত্রণালয়কে তিনি নিজ হাতের পুতুলে পরিণত করেন। এখন নতুন করে দুদক তদন্ত শুরু করেছে। আশা করছি, এর মাধ্যমে প্রকৌশলী তাকসিমের সময়ে অনিয়ম ও দুর্নীতির সঠিক চিত্র বেরিয়ে আসবে।
ঢাকা ওয়াসা কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের হিসাব বলছে, প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার প্রকল্প নির্মাণে নিুমানের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে কমপক্ষে ৬০০ কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে। এছাড়া এই প্রকল্পের নেটওয়ার্ক না করে মূল প্রকল্প বাস্তবায়ন করায় সেখান থেকে কোনো সুফল মিলছে না। এতে সেখানে কোনো বাসাবাড়ির বর্জ্য যেমন শোধন করা যাচ্ছে না, তেমনি কোনো রাজস্বও আদায় হচ্ছে না। শোধনাগারের প্ল্যান্ট চালু রাখতে হাতিরঝিলের ময়লা পানি সেখানে নিয়ে শোধন করা হচ্ছে। এতে ঢাকা ওয়াসার বছরে গচ্চা যাচ্ছে ৫১২ কোটি টাকা; ২০২৭ সালে ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হলে বছরে ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ৮২৫ কোটি টাকা। ২ বছর আগে প্রকল্প চালু হলেও এখন পর্যন্ত কোনো সঞ্চালন লাইন (নেটওয়ার্ক) প্রকল্প প্রস্তাব করেনি। এই মুহূর্তে সঞ্চালন লাইনের প্রক্রিয়া শুরু করলেও বাস্তবায়নে অন্তত ১০ বছর সময় লাগবে। ততদিনে পয়ঃশোধনাগারের যন্ত্রপাতি অকেজো হয়ে পড়বে। একই চিত্র, পদ্মা-যশলদিয়া পানি শোধনাগার প্রকল্পেও। মূল সঞ্চালন লাইন নির্মাণে নিুমানের পানি ও যন্ত্রপাতি ব্যবহারে আত্মসাৎ হয়েছে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। এ প্রকল্পে সরবরাহ লাইন তৈরি না করে প্রকল্প চালু করায় দৈনিক ৪৫ কোটি লিটার পানি উৎপাদন হওয়ার কথা থাকলেও অর্ধেকেরও কম উৎপাদন হচ্ছে। এর ফলে ২০১৯-২০ অর্থবছর থেকে ঢাকা ওয়াসার গচ্চা গেছে ১৪২ কোটি টাকা। আর ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হওয়ায় চলতি অর্থবছর থেকে গচ্চা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৫০ কোটি টাকা। এ প্রকল্পের পদে পদে দুর্নীতি হয়েছে; ওয়ারেন্টি পিরিয়ডের মধ্যেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে ১০৫ কোটি টাকা। ঢাকা ওয়াসার ফান্ডে টাকা থাকলেও রহস্যজনক কারণে এই প্রকল্পের সরবরাহ লাইন তৈরির কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
ঐক্য পরিষদের হিসাবে আরও দেখানো হয়েছে, ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত সময়ে ঢাকা ওয়াসার ৩ হাজার ২২১ কোটি টাকা খোয়া গেছে। পানির দাম ও গ্রাহক সংখ্যা বৃদ্ধি, বিলিং পদ্ধতি ডিজিটাইজেশন হওয়ার পরও সংস্থার দায়িত্বপ্রাপ্তদের চুরি, অবহেলা ও অদক্ষতার কারণে এ বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায় থেকে সংস্থা বঞ্চিত হচ্ছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে সংস্থার সিস্টেম লস ছিল ৩৪ দশমিক ৮২ শতাংশ এবং বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৪ দশমিক ৮২ শতাংশ; অথচ ঢাকা ওয়াসার বর্তমান প্রশাসন দাবি করছে ঢাকা ওয়াসার সিস্টেম লস ২০ শতাংশ।
এছাড়া সমবায় আইন অমান্য করে ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতি থেকে ৬২১ কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে। একইভাবে সমিতির নিজস্ব মালামালও বিক্রি করা হয়েছে। তার আনুমানিক মূল্যও প্রায় শত কোটি টাকার বেশি। ২০১০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে সমবায় অধিদপ্তরের তদন্ত প্রতিবেদনে ৩৩২ কোটি ৫২ কোটি টাকা লোপাটের চিত্র উঠে এসেছে। এরপরে বাকি টাকা লোপাট হয়েছে। প্রকৌশলী তাকসিম এ খানের ছত্রছায়ায় দুর্নীতি হওয়ায় তাদের কারও বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রকৌশলী তাকসিম এ খানের ১৫ বছরে রাজধানীবাসীকে ন্যূনতম সেবা না দিয়ে অর্থ আদায়েরও নানা উদাহরণ রয়েছে। নগরীতে পয়ঃসেবা না থাকলেও বছরে এ খাতে নগরবাসীর কাছ থেকে ৪০০ কোটি টাকা আদায় করা হয়েছে। ঢাকা ওয়াসার এমডির প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ২০২৪ সালে ভূ-উপরিস্থ উৎস থেকে ৭০ শতাংশ এবং ভূ-গর্ভস্থ উৎস থেকে ৩০ শতাংশ পানি উৎপাদনের ঘোষণা ছিল। বাস্তবে তার ধারে কাছেও যেতে পারেনি। এখনো ঢাকা ওয়াসার মোটর পানির ৭৬ শতাংশ ভূ-গর্ভস্থ উৎস থেকে উত্তোলন করা হচ্ছে। আর ভূ-উপরিস্থ উৎস থেকে নেওয়া হচ্ছে ২৪ শতাংশ।
আরও জানা যায়, ঢাকা ওয়াসায় পদোন্নতিতে তার সময়ে জ্যেষ্ঠতা মানা হয়নি। অবৈধ অর্থের লেনদেন পাকাপোক্ত করতে সিনিয়রদের ডিঙিয়ে জুনিয়রদের পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। তার কাজে যারা সহায়তা করেছেন, তাদের আর্থিকভাবে লাভবান করার পাশাপাশি বিদেশ ভ্রমণেরও সুযোগ করে দিয়েছেন। তার সময়ে অর্ধশত কর্মকর্তা-কর্মচারীর সমন্বয়ে সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। লোপাট নির্বিঘ্ন করতে তাদের ইস্পাত কঠিন পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন।