দেশের সড়ক নির্মাণ ব্যয় প্রতিবেশী দেশগুলোর চেয়ে ৯ গুণ বেশি
মতিন আব্দুল্লাহ
প্রকাশ: ১১ অক্টোবর ২০২৪, ১০:৫৩ এএম
দরপত্র প্রক্রিয়ার ত্রুটির কারণে সড়ক ও জনপদ (সওজ) অধিদপ্তরের সড়ক ও মহাসড়ক উন্নয়ন প্রকল্পে বড় দুর্নীতির ঘটনা ঘটছে। পদ্ধতিগত ত্রুটির সুযোগ নিয়ে রাজনীতিক, আমলা ও ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করে নিচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের সড়ক নির্মাণ ব্যয় প্রতিবেশী দেশগুলোর চেয়ে ২ থেকে ৯ গুণ বেশি। আর ইউরোপের চেয়েও ২ গুণ বেশি; খোদ এমন চিত্র তুলে ধরেছে বিশ্বব্যাংক। বিদ্যমান অবস্থার উত্তরণ ঘটাতে দরপত্র প্রক্রিয়ায় সংশোধন আনতে মতামত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাদের মতে, প্রকল্পের প্রাক্কলন প্রণয়ন থেকে দুর্নীতির শুরু হয়। যেনতেন প্রাক্কলন করে ধাপে ধাপে ব্যয় ও মেয়াদ বাড়ানো হয়। এখানে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে রাজনীতিক ও আমলাদের যোগসাজশে বড় লেনদেন হয়। এছাড়া বেশি কাজ করলে দরপত্র মূল্যায়নে বেশি নম্বর দেওয়ার পদ্ধতির কারণে একই ঠিকাদার বেশি কাজ পান। ওই ঠিকাদারের লাইসেন্সে দরপত্রে অংশ নিলে অন্যরা কাজ পান না। এসব বদল করতে হবে।
তারা জানান, একাধিক কাজ চলমান থাকাবস্থায় তাদের কাজ দেওয়া যাবে না। পাশাপাশি প্রাক্কলন ও দরপত্রে ত্রুটি পেলে প্রকল্প পরিচালক বদলি এবং ত্রুটি ও অনিয়ম বারবার হলে সংস্থার প্রধানকে বদলিসহ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে ধাপে ধাপে পরিস্থিতির উন্নতি হবে। সবচেয়ে বড় কথা-রাজনীতিক, আমলা ও ব্যবসায়ীদের মানসিকতারও পরিবর্তন ঘটাতে হবে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ড. মো. হাদীউজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মেলবন্ধন ভেঙে দিতে হবে। দরপত্রের শর্তে একই প্রতিষ্ঠানের বারবার কাজ পাওয়ার সুযোগ বন্ধ করতে হবে। বর্তমান পদ্ধতিতে বেশি কাজ করলে বেশি নম্বর পেয়ে থাকে ওই প্রতিষ্ঠান; এই দুর্বলতাগুলো দূর করতে হবে। পাশাপাশি নতুন ঠিকাদারদের কাজে যোগদানের সুযোগ সৃষ্টিতে শর্তগুলো সহজ করতে হবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক এবং যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ড. মু. মুসলেহ উদ্দীন হাসান যুগান্তরকে বলেন, প্রকল্পের শুরু হয় প্রাক্কলন দিয়ে। শুরুতে দুর্নীতির সুযোগ তৈরি করে রাখা হচ্ছে। বারবার ব্যয় ও মেয়াদ বাড়িয়ে দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি করা হচ্ছে। এভাবে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করছে অসাধু চক্র। তিনি বলেন, প্রাক্কলন তৈরির ক্ষেত্রে প্রাক-সমীক্ষা ও সমীক্ষার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয় না। যদিও বাংলাদেশের কোনো সমীক্ষায় কোনো প্রকল্প অযৌক্তিক বিবেচনা করা হয় না। যেসব বিশেষজ্ঞ অযৌক্তিক প্রকল্পকে গ্রহণযোগ্য হিসাবে প্রতিবেদন দিয়ে থাকেন; তাদেরও জবাবদিহি ও শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
তিনি জানান, বর্তমান সংস্কৃতি হলো-সরকার যাদের কাজ দিতে চায়, তাদের বলে দেয়। গোপন দর ফাঁস করে দেয়। এ কারণে দরপত্রে অংশগ্রহণকারীরা কাছাকাছি দর দেয়। দরপত্রের দুর্নীতি নিরসনে পদ্ধতিগত সংস্কারের পাশাপাশি অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ পেলে তাদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
জানতে চাইলে সড়ক পরিবহণ ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান যুগান্তরকে বলেন, সওজের ব্যাপারে টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদন আমরা নিখুঁতভাবে দেখেছি। সড়ক সচিব ও সওজের প্রধান প্রকৌশলীর সঙ্গে আমরা সভা করেছি। দরপত্রের দুর্বলতাগুলো নিরসনে পরিকল্পনা উপদেষ্টার সঙ্গেও কথা হয়েছে। আগামী সপ্তাহে এভাবে করণীয় নির্ধারণে সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের নিয়ে সভা করে পরবর্তী কার্যক্রম নেওয়া হবে।
তিনি জানান, সওজের সব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নাম ও কাজের তালিকা করা হয়েছে। দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলো চিহ্নিত করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে সওজের যারা যে পদে ৩ বছরের বেশি দায়িত্ব পালন করেছেন, সবাইকে বদলির নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধে যা যা করা দরকার, সে বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হবে।
টিআইবির গবেষণা : বিগত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের আওতাধীন প্রকল্প বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ অর্থ লোপাটের ঘটনা ঘটেছে। যার পরিমাণ ২৯-৫১ হাজার কোটি টাকা। তিন শ্রেণির সমন্বিত একটি চক্র এসব অর্থ লোপাট করেছে। এর মধ্যে আছেন মন্ত্রী, সংসদ-সদস্য ও প্রভাবশালী রাজনীতিক; আমলা ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।