পুরোনো মোড়কে নতুনভাবে কারসাজি
পাইকারি সিন্ডিকেটের কবলে নিত্যপণ্যের বাজার
ইয়াসিন রহমান
প্রকাশ: ১১ অক্টোবর ২০২৪, ০২:৪০ এএম
ফাইল ছবি
বাজারে ফের অসাধুরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছেন। ভোক্তার পকেট কাটতে তারা পুরোনো মোড়কে নতুন করে কারসাজি করছেন। এতে প্রতি সপ্তাহে কোনো না কোনো পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলেও পাইকারিতে ইচ্ছামতো মূল্য নির্ধারণে খুচরা পর্যায়ে ভোজ্যতেলের দাম লিটারে ১০ টাকা বেড়েছে। ডিমের বাজারে চলছে রীতিমতো নৈরাজ্য। ফার্ম থেকে প্রতি পিস ১১ টাকায় কিনে পাইকারি আড়তেই ১৫ টাকায় বিক্রি করা হয়েছে। এ কারণে ভোক্তা পর্যায়ে এ ডিম ১৬-১৮ টাকার ওপরে বিক্রি হয়েছে। আর এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছেন রাজধানীর ২২ জন ব্যবসায়ী। তাদের কারসাজিতে ২০ দিনে ভোক্তার পকেট থেকে ২৮০ কোটি টাকা লুটে নেওয়া হয়েছে। বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজার ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলার জন্যই মূলত এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। আর বিদ্যমান পরিস্থিতিতে পাইকারিতে সিন্ডিকেটের কারণে খুচরা পর্যায়ে চরম খেসারত দিচ্ছেন ভোক্তা।
এছাড়া খুচরা বাজারে সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিপ্রতি পেঁয়াজ কিনতে ক্রেতাসাধারণের ২০ টাকা বেশি গুণতে হচ্ছে। চাল নিয়ে করা হচ্ছে চালবাজি। সবজি থেকে শুরু করে আদা-রসুন, চিনির দাম বাড়িয়ে ক্রেতাকে জিম্মি করা হয়েছে। কেজিপ্রতি ৬০ টাকার নিচে মিলছে না সবজি। কিছু সবজির দাম ২০০ টাকা ছাড়িয়েছে। আর কাঁচা মরিচের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩০০-৩৫০ টাকায়। বৃহস্পতিবার রাজধানীর একাধিক খুচরা বাজার ঘুরে ক্রেতা ও বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।
এদিকে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার দুই মাস পার হয়েছে। পণ্যমূল্য ক্রেতাসাধারণের নাগালে আনতে এ সরকার ইতোমধ্যে বেশকিছু পদক্ষেপও নিয়েছে। সম্প্রতি কিছু পণ্যের শুল্ক-কর কমানো হয়েছে। কিছু পণ্যের শুল্ক-কর কমানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। আমদানির অনুমোতিও দেওয়া হয়েছে কিছু পণ্যের। এছাড়া বাজারে তদারকি সংস্থাগুলোর অভিযান বাড়ানো হয়েছে। শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে গঠন করা হয়েছে টাস্কফোর্স। তারপরও অসাধুরা থামছেন না। বাজারে অরাজকতা সামলাতে পণ্যমূল্য নির্ধারণ করলেও তা কাগজে-কলমেই থেকে যাচ্ছে। বিক্রেতারা সরকারের সিদ্ধান্তকে একপ্রকার বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছেন। এতে বাজারে ক্রেতাসাধারণ প্রতারিত হচ্ছেন।
বাজার অব্যবস্থাপনা প্রতিকারের উপায় কী-এমন প্রশ্নে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, বাজারব্যবস্থায় বর্তমানে কোনো ধরনের প্রতিযোগিতা নেই। ব্যবসায়ীরা অযৌক্তিক মুনাফার উদ্দেশ্যে সময় ও সুযোগ বুঝে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। সরকার পণ্যের দাম নির্ধারণ করলেও তা কার্যকর করছেন না। এমনকি অসাধুরা পণ্যের দাম বাড়িয়ে ক্রেতার পকেট কাটছেন। মূল্য নির্ধারণ করার পর তা না মেনে বেশি দামে বিক্রি করায় ক্রেতার বাড়তি দরেই কিনতে হচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন পর্যায়ে ফের সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। যার চরম খেসারত দিচ্ছেন ভোক্তা।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর খুচরা বাজার ঘুরে বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুই-তিনদিন আগেও খুচরা পর্যায়ে প্রতি ডজন ফার্মের ডিম ১৮০-১৯০ টাকায় বিক্রি হলেও আমদানির খবরে প্রতি ডজন ১৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এতে এক হালির দাম দাঁড়ায় ৫৭ টাকা। ফলে এক পিস ডিমের দাম দাঁড়ায় ১৪ টাকা ১৬ পয়সা। কিন্তু এক পিস ডিম খুচরা পর্যায়ে ১৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা মাসখানেক আগেও ১২ টাকা ছিল। এদিকে গত মাসে প্রতি ডজন ডিমের দাম ১৪২ টাকা ৪৪ পয়সা নির্ধারণ করে সরকার। সে হিসাবে খুচরা পর্যায়ে ৩৮ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। পাশাপাশি বাজারে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকা, যা কিছুদিন আগেও ছিল ১৭০ টাকা। তবে সরকার ১৭৯ টাকা ৫৯ পয়সা মূল্য নির্ধারণ করে দেয়। সে হিসাবে খুচরা বাজারে কেজিপ্রতি ২০ টাকা বাড়তি দরে বিক্রি হচ্ছে।
এদিকে বাজারে এমন অস্থিরতার নেপথ্যে ২২ ব্যবসায়ীকে দায়ী করেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। তারা পাইকারি আড়তদার। অনুসন্ধানের ভিত্তিতে রাজধানীর এ ২২ ব্যবসায়ীকে চিহ্নিত করা হয়েছে। যারা ফার্ম থেকে ১১ টাকায় ডিম কিনে এনে ১৫ টাকায় আড়ত পর্যায়ে বিক্রি করেছেন। যে কারণে হঠাৎ ডিমের বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। ভোক্তার খুচরা পর্যায়ে ১৬-১৮ টাকায় প্রতি পিস ডিম কিনতে হয়েছে। তাছাড়া তেজগাঁও ডিম আড়তদার সমিতির পক্ষ থেকে এসএমএম-এর মাধ্যমে ডিমের দাম নির্ধারণ করেছে। সেই দামে পাইকাররা ডিম কিনতে বাধ্য হয়েছেন।
এছাড়া বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএ) জানায়, বহুজাতিক কোম্পানি এবং রাজধানীর তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী সমিতি ২০ দিনে অযৌক্তিকভাবে ডিম ও মুরগির বাচ্চার দাম বাড়িয়ে ২৮০ কোটি টাকা লুটপাট করেছেন। সংগঠনটির সভাপতি মো. সুমন হাওলাদার বলেন, প্রান্তিক পর্যায়ে একটি ডিমের উৎপাদন খরচ ১০ টাকা ২৯ পয়সা। সে অনুযায়ী ১২ থেকে সাড়ে ১২ টাকা যদি ভোক্তা পর্যায়ের দাম থাকে তবে সেটি যৌক্তিক। কিন্তু সেই ডিমের দাম পৌঁছেছে ১৫ টাকায়। এমন অবস্থায় ডিম আর মুরগির বাজারে স্বস্তি রাখতে পোলট্রি ফিড ও মুরগির বাচ্চার সিন্ডিকেট ভেঙে ডিম-মুরগির উৎপাদন খরচ কমাতে পারলে শিগ্গিরই বাজার সহনীয় পর্যায়ে আসবে।
অন্যদিকে ভোজ্যতেলের বাজারেও একই চিত্র। খুচরা বাজারে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১৫০-১৫৫ টাকায়, যা এক মাস আগে ছিল ১৪৫-১৫০ টাকা। খোলা পাম তেল বিক্রি হয়েছে ১৪৬ টাকা। এক মাস আগে ছিল ১৩৫ টাকা। মূলত বাজারে তেলের কোনো সংকট নেই। পাইকারি বিক্রেতারা কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে দাম বাড়ানোর কারণেই খুচরা বাজারে বেড়েছে। অনুসন্ধানে দেখা যায়, পাইকারি বিক্রেতারা মিল পর্যায় থেকে কম দামে ভোজ্যতেল কিনলেও বিক্রি করছেন বাড়তি ধরে। এমন চিত্র ভোক্তা অধিদপ্তরের অভিযানেও প্রমাণিত হয়েছে। অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা অভিযান শেষে জানিয়েছেন, পাইকারি পর্যায়ে দাম বাড়ানোর কারণে খুচরা বাজারে বেড়েছে। মিল থেকে কী দামে তেল কিনেছেন, সেই কাগজ দেখাচ্ছেন না। মৌখিকভাবে তারা ইচ্ছামতো দাম নির্ধারণ করে বিক্রি করছেন। যে কারণে ভোক্তাপর্যায়ে দাম বেড়েছে।
এছাড়া খুচরা বাজারে প্রতি কেজি ছোট দানার মসুর ডাল বিক্রি হচ্ছে ১৩৫-১৪০ টাকা। খুচরা বাজারে গত সপ্তাহেও প্রতি কেজি কাঁচা মরিচ ১৮০-২২০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, যা তিনদিন আগে বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা। তবে দাম কিছুটা কমলেও বৃহস্পতিবার প্রতি কেজি ৩০০-৩৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। পাশাপাশি খুচরা বাজারে অন্যান্য সবজির দামও বেড়েছে। এক সপ্তাহ আগে প্রতি কেজি বরবটি বিক্রি হয়েছে ৮০-১২০ টাকা, যা বৃহস্পতিবার বাজারভেদে বিক্রি হয়েছে ১৪০-১৫০ টাকা। সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি কেজি বেগুনের দাম ৬০ টাকা বেড়ে ১৬০-১৮০ টাকা হয়েছে। ধনেপাতার কেজি বিক্রি হচ্ছে ৬০০ টাকা। প্রতি কেজি আলু ৬০ টাকা। প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ১২০ টাকা, যা সাতদিন আগেও ১১০ টাকা ছিল। প্রতি কেজি আমদানি করা পেঁয়াজ ১১০, যা সাতদিন আগে ছিল ১০০ টাকা। প্রতি কেজি রসুন ২২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দেশি হলুদ বিক্রি হচ্ছে ৪৪০ এবং আমদানি করা হলুদ ৩৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। আমদানি করা আদার কেজি ২৮০ টাকা হলেও দেশি আদা সর্বোচ্চ ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
কাওরান বাজারের সবজি বিক্রেতা আমিনুল বলেন, পাইকারি বাজারে সবজির কোনো সংকট নেই। এখন রাস্তায় চাঁদা দেওয়া লাগছে না। কিন্তু দাম কমার পরিবর্তে উলটো বাড়িয়ে আড়তদাররা বলছেন, বন্যার কারণে দাম বাড়তি। তিনি জানান, বন্যার কারণে এমনটা হলে আড়তে সবজির সংকট থাকত। সব তাদের কারসাজি।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. আব্দুল জব্বার মন্ডল বলেন, আড়তদাররাই মূলত ডিমের বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। এমন ২২ জন ব্যবসায়ীকে আমরা চিহ্নিত করেছি। সে অনুযায়ী পাইকারি পর্যায়ে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। আমাদের দেখে আড়ত বন্ধ করে পালিয়েছে। তবে সেই আড়ত আমরা সিলগালা করেছি। প্রত্যেককে আমরা জবাবদিহির মধ্যে আনছি। কঠোর ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে। যে কারণে ডিমের দাম কমতে শুরু করেছে। তিনি জানান, একই চিত্র ভোজ্যতেলের বাজারেও। পাইকারি পর্যায়ে অযৌক্তিক মুনাফা করায় খুচরায় দাম বেড়েছে। এছাড়া নানা অজুুহাতে ব্রয়লার মুরগির দামও বাড়ানো হয়েছে। আমরা এমন অনিয়মে কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করছি। কাউকেই ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। আশা করা যাচ্ছে, পণ্যমূল্য কয়েকদিনের মধ্যে সহনীয় হয়ে উঠবে।