সাবেক রাষ্ট্রপতি একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। শুক্রবার দিবাগত রাত সাড়ে ৩টার দিকে রাজধানীর উত্তরার মহিলা মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তিনি মারা যান।
তার প্রথম জানাজা শনিবার সকাল ৮টায় ওই হাসপাতালে অনুষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় জানাজা বাদ জোহর বারিধারা কূটনৈতিক এলাকার ৮ নম্বর সড়কে অবস্থিত বায়তুল আতিক জামে মসজিদে অনুষ্ঠিত হবে।
আগামীকাল রোববার সকাল ১০টায় মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর স্টেডিয়ামে তৃতীয় জানাজা এবং বাদ জোহর গ্রামের বাড়ি মজিদপুর দয়হাটায় চতুর্থ জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে। তার প্রেসসচিব জাহাঙ্গীর আলম এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন। দীর্ঘ জীবনে নানা অর্জনে সমৃদ্ধ এই রাজনীতিক। তিনি একজন স্বনামধন্য চিকিৎসক। এ ছাড়া তিনি একজন লেখক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, উপস্থাপক ও সুবক্তা।
বদরুদ্দোজা চৌধুরী কর্মজীবন শুরু করেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সবচেয়ে নবীন অধ্যাপক হিসেবে। তিনি স্বাস্থ্যসেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং ষাটের দশকের শেষের দিকে জনপ্রিয় টিভি অনুষ্ঠান ‘আপনার ডাক্তার’-এর উপস্থাপক হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।
রাজনীতিতে একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর পরিচিতি শুরু হয়েছিল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে।
কিন্তু ২০০২ সালে সেই দল থেকে বেরিয়ে নতুন দল (বিকল্পধারা বাংলাদেশ) গঠন করেন তিনি। যদিও গত দুই দশকেও তার নতুন দলটি বড় সাড়া জাগাতে পারেনি।
তবে রাজনীতিতে একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী বরাবর ছিলেন আলোচিত এক চরিত্র।
বাংলাদেশের জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়া বলছে— বদরুদ্দোজা চৌধুরী ১৯৭৯ সালে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন, যখন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠন করেন। তিনি ছিলেন দলটির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব। সেই সময় (মানে ১৯৭৯ সালে) তিনি প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মন্ত্রিসভায় উপপ্রধানমন্ত্রী ছিলেন।
জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়া— দুই সরকারের সময়ই বদরুদ্দোজা চৌধুরী মন্ত্রী ছিলেন এবং বিভিন্ন সময় স্বাস্থ্য ও পরিবার-পরিকল্পনা, শিক্ষা এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
রাজনৈতিক ইতিহাসবিদ মহিউদ্দিন আহমদ বলেছেন, বদরুদ্দোজা চৌধুরী ছিলেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য, কিন্তু তিনি হঠাৎ করে রাজনীতিতে এসেছিলেন। তিনি বলেন, রাজনীতি করার ব্যাকগ্রাউন্ড না থাকায় তার মধ্যে প্রচলিত অর্থে রাজনীতিবিদ সুলভ আচরণ কম দেখা যেত। তিনি বিএনপির শীর্ষ নীতিনির্ধারণী পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছিলেন। রাজনীতিতে নিজেকে ব্যতিক্রম হিসেবে উপস্থাপন করতে চেয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর। যদিও সেটি বিএনপি মেনে নেয়নি।
রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার আগে থেকেই চিকিৎসক হিসেবে খ্যাতিমান ছিলেন একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী। এ ছাড়া ভালো ছাত্র ও উপস্থাপক হিসেবেও পরিচিত ছিলেন তিনি।
প্রয়াত সংসদ সদস্য এবং লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী পান্না কায়সার সম্পর্কে বদরুদ্দোজা চৌধুরীর আত্মীয়। মৃত্যুর আগে ২০২৩ সালে বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে পান্না কায়সার বলেছিলেন— বদরুদ্দোজা ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন খুবই প্রাণবন্ত একজন মানুষ। যে কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে আসর জমাতে তার জুড়ি মেলা ভার ছিল। খুব সহজেই হাসি দিয়ে তিনি সবাইকে আপন করে নিতে পারতেন। যে কোনো বিষয় নিয়ে গল্প বলতে পারতেন, ঠাট্টা করতে পারতেন। মানে ভীষণ প্রাণবন্ত একজন মানুষ ছিলেন তিনি।
বদরুদ্দোজা ১৯৩২ সালের ১ নভেম্বর কুমিল্লায় নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকার সেন্ট গ্রেগরি হাইস্কুল, ঢাকা কলেজ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ এবং ব্রিটেনের ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাগ্রহণ করেন।
তিনি এডিনবার্গ, লন্ডন ব্রোম্পটন চেস্ট ইনস্টিটিউট, লন্ডনের হ্যামার স্মিথ পোস্ট গ্র্যাজুয়েট মেডিকেল স্কুল থেকে স্নাতকোত্তর চিকিৎসা শিক্ষাগ্রহণ করেন।
বদরুদ্দোজা চৌধুরী এমবিবিএস পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। পরে তিনি একজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
রাজনীতির বাইরে তিনি চিকিৎসকদের কয়েকটি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ‘টিউবারকিউলোসিস অ্যান্ড চেস্ট ডিজিজ’ নিয়ে বহু আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বাংলাদেশের হয়ে যোগ দিয়েছেন এবং এ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মেও নেতৃত্ব দিয়েছেন। বাংলাদেশে হেলথ অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট নামে তার প্রতিষ্ঠিত একটি ট্রাস্টের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন। এই ট্রাস্টের মাধ্যমে দেশের প্রথম মহিলা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
তিনি নিজের চেম্বারে নিয়মিত রোগী দেখতেন।