Logo
Logo
×

জাতীয়

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ভাষণে ড. মুহাম্মদ ইউনূস

‘মনসুন অভ্যুত্থান’ বিশ্বের প্রেরণা

Icon

যুগান্তর ডেস্ক

প্রকাশ: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০:০১ পিএম

‘মনসুন অভ্যুত্থান’ বিশ্বের প্রেরণা

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ছাত্র-জনতা দেশের জনগণকে স্বৈরাচার মুক্ত করেছে। তারা একনায়কতন্ত্র, নিপীড়ন, বৈষম্য, অবিচার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। তরুণদের এই সাহস ও দৃঢ়তা সবাইকে অভিভূত করেছে। বাংলাদেশের ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানকে ‘মনসুন অভ্যুত্থান’ আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, আগামীতে বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষকে মুক্তি ও ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান নিতে তারুণ্যের এই অভ্যুত্থান প্রেরণা জুগিয়ে যাবে। বাংলাদেশ সময় শুক্রবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে তিনি এসব কথা বলেন। 

জাতিসংঘ সদর দপ্তরের জেনারেল অ্যাসেম্বলি হলে ড. ইউনূস বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রেক্ষাপট এবং এর মাধ্যমে বাংলাদেশে সংঘটিত যুগান্তকারী পরিবর্তনের কথা তুলে ধরেন। এক্ষেত্রে তিনি সশস্ত্র বাহিনীগুলোরও প্রশংসা করেন। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এখন একটি শক্তিশালী অর্থনীতি ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলাই অন্তর্বর্তী সরকারের লক্ষ্য। এজন্য তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন-সহযোগিতা ব্যাপক ও গভীরতর করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, বিশ্বের সব দেশের সঙ্গেই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে চায় বাংলাদেশ। রোহিঙ্গাদের টেকসই প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করা এবং পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতেও তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পর্যাপ্ত সহায়তা আশা করেন। এছাড়া ফিলিস্তিনে গণহত্যা ও জলবায়ু পরিবর্তনসহ বিশ্বের নানা সংকট নিয়েও কথা বলেন ড. ইউনূস। তিনি শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব ও শূন্য নেট কার্বন নিঃসরণ অর্জনে গুরুত্ব দেন। এই নোবেলজয়ী ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’ প্রযুক্তি এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে মানুষের ওপর এর বিরূপ প্রভাব সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। 

ড. ইউনূস তার ভাষণে বলেন, জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশে যে যুগান্তকারী পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতেই আজ আমি বিশ্ব সম্প্রদায়ের এ মহান সংসদে উপস্থিত হতে পেরেছি। আমাদের গণমানুষের, বিশেষ করে তরুণ সমাজের, অফুরান শক্তি আমাদের বিদ্যমান রাষ্ট্র কাঠামো ও প্রতিষ্ঠানগুলোর আমূল রূপান্তরের এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে।

তিনি বলেন, আমাদের ছাত্র ও যুব সমাজের আন্দোলন প্রথমদিকে মূলত ছিল বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন। পর্যায়ক্রমে তা গণআন্দোলনে রূপ নেয়। এরপর সারা পৃথিবী অবাক বিস্ময়ে দেখেছে কীভাবে সমগ্র বাংলাদেশের মানুষ একনায়কতন্ত্র, নিপীড়ন, বৈষম্য, অবিচার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাজপথ এবং সামাজিক- যোগাযোগমাধ্যমে দৃঢ়ভাবে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমাদের ছাত্র-জনতা তাদের অদম্য সংকল্প ও প্রত্যয়ের মাধ্যমে একটি স্বৈরাচারী ও অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা থেকে আমাদের মুক্তি এনে দিয়েছে। তাদের এ সম্মিলিত সংকল্পের মধ্যেই আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ নিহিত, যা এ দেশটিকে বিশ্ব সম্প্রদায়ের মাঝে একটি দায়িত্বশীল জাতির মর্যাদায় উন্নীত করবে বলে আমি বিশ্বাস করি। 

তিনি বলেন, এই গণআন্দোলন রাজনৈতিক অধিকার ও উন্নয়নের সুবিধাবঞ্চিত বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। বাংলাদেশের মানুষ উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অন্তর্ভুক্তিমূলক অংশীদারত্ব চেয়েছিল। আমাদের জনগণ একটি ন্যায্য, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও কার্যকর গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছে, যার জন্য আমাদের নতুন প্রজন্ম জীবন উৎসর্গ করেছিল। আমাদের এই তরুণরা যে প্রজ্ঞা, সাহস ও প্রত্যয় দেখিয়েছে তা আমাদের অভিভূত করেছে। বন্দুকের গুলি উপেক্ষা করে বুক পেতে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল আমাদের এই তরুণরা। আমাদের মায়েরা, দিনমজুরেরা ও শহরের অগণিত মানুষ তাদের সন্তানদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নেমেছিলেন রাজপথে। 

ড. ইউনূস ভাষণে আরও বলেন, ১৯৭১ সালে যে মূল্যবোধকে বুকে ধারণ করে আমাদের গণমানুষ যুদ্ধ করেছিল, সেই মূল্যবোধকে বহু বছর পরে আমাদের ‘জেনারেশন জি’ (প্রজন্ম জি) নতুনভাবে দেখতে শিখিয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের এই ‘মুনসুন অভ্যুত্থান’ আগামী দিনগুলোতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মানুষকে মুক্তি ও ন্যায়বিচারের পক্ষে দাঁড়াতে প্রেরণা জুগিয়ে যাবে। আমাদের মুক্তি ও গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষাকে বাস্তবে রূপ দিতে আমি তাই বিশ্ব সম্প্রদায়কে আমাদের নতুন বাংলাদেশের সঙ্গে নতুনভাবে সম্পৃক্ত হওয়ার উদাত্ত আহ্বান জানাই।

এই নোবেলজয়ী অধ্যাপক বলেন, দেশকে পুনর্গঠন এবং জনগণের কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্রব্যবস্থা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য আমাদের ওপর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। অতীতের ভুলগুলো সংশোধন করে একটি প্রতিযোগিতামূলক ও শক্তিশালী অর্থনীতি এবং ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলাই এই মুহূর্তে আমাদের মূল লক্ষ্য। তিনি বলেন, আমাদের দেশের মানুষ মুক্তভাবে কথা বলবে, ভয়-ভীতি ছাড়া সমাবেশ করবে, তাদের পছন্দের ব্যক্তিকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবে-এটাই আমাদের লক্ষ্য। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংরক্ষণ এবং সাইবার ডোমেনসহ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সুসংহতকরতেও আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

ড. ইউনূস বলেন, বাংলাদেশ যেসব আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক এবং দ্বিপাক্ষিক চুক্তির পক্ষভুক্ত, সেগুলো প্রতিপালনে আমাদের সরকার বদ্ধপরিকর। জাতিসংঘসহ বহুপাক্ষিক বিশ্বকাঠামোতে বাংলাদেশের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও অবদান অব্যাহত থাকবে। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, মর্যাদা ও স্বার্থ সংরক্ষণের ভিত্তিতে বাংলাদেশ বিশ্বের সব রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে আগ্রহী।

তিনি আরও বলেন, গণতন্ত্র, আইনের শাসন, সমতা ও সমৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে একটি ন্যায়ভিত্তিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক সমাজ হিসাবে আত্মপ্রকাশের অভিপ্রায় বাস্তবায়নে আমি বাংলাদেশের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন ও সহযোগিতা ব্যাপক ও গভীরতর করার আহ্বান জানাই।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশ মনে করে যে, শান্তি রক্ষা এবং সংঘাত মোকাবিলা জনগণের সমৃদ্ধি নিশ্চিত করার মূল চালিকাশক্তি। সাম্প্রতিক বিপ্লবকালে আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিনতম সময়ে জনগণের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা পূরণে তাদের পাশে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে আমাদের সাহসী সশস্ত্র বাহিনীগুলো আরও একবার শান্তির প্রতি তাদের অঙ্গীকার প্রমাণ করেছে।

কার্বনমুক্ত পৃথিবী গড়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, এক্ষেত্রে আমি বিশ্বাস করি যে, সমগ্র বিশ্ব একসঙ্গে ‘তিন-শূন্য’র ধারণা বিবেচনা করতে পারে, যার মাধ্যমে আমরা শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব এবং শূন্য নেট কার্বন নিঃসরণ অর্জন করতে পারি। 

ড. ইউনূস ফিলিস্তিনে গণহত্যা বন্ধের আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, বহুমুখী সংকটে জর্জরিত বর্তমান বিশ্বে, যুদ্ধ এবং সংঘাতের ফলে ব্যাপকভিত্তিতে মানুষের অধিকার খর্ব হচ্ছে। বিশ্ববাসীর উদ্বেগ এবং নিন্দা সত্ত্বেও গাজায় গণহত্যা থামছে না। ফিলিস্তিনের জনগণের বিরুদ্ধে যে মানবতাবিরোধী অপরাধ হচ্ছে, তার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে দায়বদ্ধ করতে হবে। ফিলিস্তিনের জনগণের ওপর চলমান নৃশংসতা, বিশেষত নারী এবং শিশুদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যে নিষ্ঠুরতা বিশ্ব দেখছে, তা থেকে নিস্তারের জন্য বাংলাদেশ অনতিবিলম্বে সম্পূর্ণ যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানাচ্ছে। 

তিনি রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তা চেয়ে বলেন, মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের সহায়তা করতে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ। আমরা রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সহায়তা কার্যক্রম চালু রাখা এবং তাদের টেকসই প্রত্যাবাসন নিশ্চিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পর্যাপ্ত সহায়তা অব্যাহত চাই।

ড. ইউনূস বলেন, অবৈধ অর্থের প্রবাহ এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে সম্পদের পাচার বন্ধ করা অত্যাবশ্যক। উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে পাচার হয়ে যাওয়া সম্পদ ফেরত আনার জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জোরদার করতে হবে। আমরা আশা করি, কর ফাঁকি রোধে আন্তর্জাতিক কর কনভেনশন অতি শিগগিরই গৃহীত হবে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম