Logo
Logo
×

জাতীয়

কেন ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে আগ্রহী নন মোদি?

আবদুল মজিদ চৌধুরী

আবদুল মজিদ চৌধুরী

প্রকাশ: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৪:৩১ পিএম

কেন ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে আগ্রহী নন মোদি?

ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং নরেন্দ্র মোদি। কোলাজ: যুগান্তর

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সাইডলাইন বৈঠকে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও নরেন্দ্র মোদির মধ্যে আনুষ্ঠানিক আলোচনার অনুরোধ করেছে ঢাকা। গত ৭ সেপ্টেম্বর এক প্রতিবেদনে এমনটাই দাবি করে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম হিন্দুস্তান টাইমস।

মুহুর্তেই তা ঢাকার সংবাদমাধ্যমগুলোর কাছে বড় খবরে পরিণত হয়। পরদিন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের ব্রিফিংয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, পদ্ধতি মেনে এই অনুরোধ করেছে ঢাকা। আলাদা করে বিশেষ কিছু নয়। তার ভাষ্য হলো, ঢাকা অনুরোধ করেছে, ভারত যদি চায় বৈঠক হবে। আর যদি না চায়, এতে ‘জোরাজুরির’ কিছু নেই। 

গত ১৮ সেপ্টেম্বর হিন্দুস্তান টাইমস আবার আরেক প্রতিবেদনে জানায়, নিউইয়র্কে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মাঝে কোনো বৈঠক হবে না। এতে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রে মোদির তিন দিনের ব্যস্ত সফরে ড. ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকের এজেন্ডা রাখা হয়নি।

কোনো সন্দেহ নেই, নিউইয়র্কে মোদির সফর যথেষ্ট ঠাঁসা সূচি হতে যাচ্ছে। তৃতীয়বার ক্ষমতায় এসে এটি মোদির প্রথম মার্কিন সফর। এরমধ্যে লোকসভার বিরোধী দলীয় নেতা রাহুল গান্ধী যুক্তরাষ্ট্র সফর করে এসেছেন। এক আলোচনায় ভারত যে বহুত্ববাদী ভাষা, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির দেশ সেটা তুলে ধরেন রাহুল। বর্তমানে ভারতীয় রাজনীতিতে বিজেপির অবস্থান সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, এ কথা প্রচার করেছেন তিনি। পশ্চিমামহলও বিজেপির কট্টরবাদী চিন্তার সমালোচক। তাই মোদি নিজেও যে বেশ স্বস্তি নিয়ে নিউইয়র্কে যাবেন, তা বলা যাচ্ছে না। 

গত দুই মাসে রাশিয়া এবং ইউক্রেন সফর করেছেন নরেন্দ্র মোদি। ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ এবং শান্তি প্রক্রিয়ায় ভারত কূটনৈতিকভাবে দূতিয়ালি করছে। রাশিয়ায় সম্প্রতি ভারতের নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের সফর তারই অংশ। আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ভারতের সংশ্লিষ্টতা এবং অংশগ্রহণ যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি এখন। 

কিন্তু কথা হচ্ছে, প্রতিবেশি বাংলাদেশকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়ার যে বয়ান দিল্লি প্রচার করে আসছে, নিউইয়র্কে মোদির সফরে তা কেনো গুরুত্ব পাচ্ছে না? ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে মোদি বলেছিলেন, ১৪০ কোটি ভারতীয় বাংলাদেশি হিন্দুদের নিয়ে উদ্বিগ্ন। ভারত যদি একান্তই উদ্বেগে থাকতো, তাহলে ইউনূসের সঙ্গে বসে আলোচনা করা কি দিল্লির জন্য স্বাভাবিক ছিল না?

বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অটুট রাখতে প্রতিবেশি ভারতের সহযোগিতা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন এখন ঢাকার। কারণ শেখ হাসিনার পতনের পর, দুদেশের সম্পর্কে অবনতিতে প্রভাব পড়েছে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কে। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে যে টানাপোড়েন দেখা দিয়েছে তা দূর করতে ইউনূস-মোদির বৈঠকের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিল ঢাকা। কিন্তু এটা স্পর্শ করেনি দিল্লিকে। 

অনেক জায়গায় বলা হচ্ছে, ইউনূসের সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারের (পিটিআই) কারণে দিল্লির অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। ভারতে হাসিনাকে চুপ থাকতে বলাসহ ইউনূসের বিভিন্ন মন্তব্য ভালোভাবে নেয়নি মোদি সরকার। শুধু হাসিনার প্রত্যর্পণ ইস্যুই কি ইউনূস-মোদির বৈঠকের সম্ভাবনা নস্যাৎ করে দিল? কারণ কী এই একটাই?

আপাতদৃষ্টিতে এর পেছনে হাসিনার প্রত্যর্পণ ইস্যু মনে করা হলেও, আরো বেশ কিছু দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে পারে ভারতের। যা ইউনূসের সঙ্গে মোদির বৈঠক না হওয়ার পেছনে প্রভাব ফেলেছে। 

সার্কের চেতনা পুনরুজ্জীবিত করতে ইউনূসের চেষ্টা

পিটিআইয়ের সাক্ষাৎকারে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার (সার্ক) চেতনার পুনরুজ্জীবন হওয়া দরকার বলে মন্তব্য করেছিলেন ড. ইউনূস। ইউনূস বলেছেন, দীর্ঘদিন সার্ক শীর্ষ সম্মেলন হয়নি। আমরা যদি একত্র হতে পারি, তবে অনেক সমস্যার সমাধান হবে।

তিনি আরো বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে ইউরোপের দেশগুলো অনেক কিছু অর্জন করেছে। সার্কের কাজ করার বিষয়টি আমাদেরও নিশ্চিত করতে হবে।

ইউনূসের সার্কের চেতনার পুনরুজ্জীবিত করার প্রচেষ্টা খুব একটা পছন্দ করছে না দিল্লি। সার্ক কার্যকর থাকলে আঞ্চলিক বৈঠকগুলোতে অনেক সমস্যা সুরাহা হওয়ার পথ তৈরি হতো। ভারত কোয়াড বা ব্রিকস নিয়ে যত আগ্রহী, সার্ক নিয়ে কোনো তৎপরতা চোখে পড়ে না। 

এছাড়া সার্ক যদি কার্যকর থাকে, এক ফোরামে পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসা হবে। এতে বৈরিতা কমে আসার পথ তৈরি হতে পারে। কিন্তু যেখানে পাকিস্তান আছে, সেখানে ভারত সক্রিয় হতে চায় না।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের আদলে সার্কের মাধ্যমে বিবদমান ইস্যু সুরাহা হোক, এটা দিল্লির মনোভাব নয়। প্রচলিত রাজনীতিতে যারা পুরোনো, তারা হুট করে ‘নবাগত’ ইউনূসের উদ্যোগে কেনো শামিল হবে। এটি ভারতের অহংবোধে প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে।

একটা অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে বহুমুখী চ্যালেঞ্জ নিয়ে সরকারের দায়িত্ব নিয়েছেন ড. ইউনূস। তার চিন্তা প্রতিবেশি অনেক দেশের সরকারপ্রধান থেকে আলাদা। সার্ক নিয়ে ইউনূসের সঙ্গে মতের মিল হবে না ভারতের। আঞ্চলিক রাজনীতিতে সার্কের সংস্কার এবং কার্যকারিতা ভারতের স্বার্থে অতো গুরুতর নয়। মোদির সঙ্গে বৈঠকে হলে সার্ক প্রসঙ্গ তুলতে পারেন ইউনূস। এ আশঙ্কা থাকতে পারে দিল্লির।

ভারতে হাসিনার অবস্থান কিসের ভিত্তিতে

স্বল্প সময়ের নোটিশে ক্ষমতাচ্যুত বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিয়েছে ভারত। এমনটা বলেছিলেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। এরমধ্যে হাসিনার কূটনৈতিক পাসপোর্ট বাতিল করেছে অন্তবর্তীকালীন সরকার। ঠিক কোন ‘স্ট্যাটাসে’ হাসিনা বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছেন, তা ঢাকার কাছে অজানা। শুধু তাই নয়, হাসিনাকে বিচারের মুখোমুখি করার চাপও রয়েছে ড. ইউনূস সরকারের উপর।

যদি ইউনূস-মোদি বৈঠক হয়, এতে হাসিনার ভারতে অবস্থান এবং বাংলাদেশে প্রত্যর্পণ আলোচনা উঠার সম্ভাবনা থাকতই। আপাতত এসব প্রশ্নের জবাব দিতে চায় না দিল্লি। ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক এড়িয়ে যাওয়ার এটাও উল্লেখযোগ্য কারণ হতে পারে।

যুদ্ধাংদেহি মনোভাব

ড. ইউনূস শপথ গ্রহণের পরপরই শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন মোদি। হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করে বাংলাদেশ স্বাভাবিক অবস্থায় দ্রুত ফিরে আসবে বলে আশাবাদ করেন তিনি। কিন্তু ঢাকার সঙ্গে যুদ্ধাংদেহি মনোভাব জিইয়ে রেখে কীভাবে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে বাংলাদেশ? 

গত ১৬ আগস্ট ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মোদিকে ড. ইউনূস নিজেই ফোন করেন। সেখানে তিনি বাংলাদেশে হিন্দু ও সব সংখ্যালঘুর সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা বলেছেন। এই ফোন কলের মাহাত্ম্য অনুধাবন করা খুব সহজ। স্থিতিশীল বাংলাদেশের জন্য ভারতের সঙ্গে স্বাস্থ্যকর সম্পর্ক প্রয়োজন। আর এ কারণে মোদির সঙ্গে সৌজন্য বিনিময় করেছেন তিনি। 

আর এদিকে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং ভবিষ্যৎ যুদ্ধ মোকাবিলার জন্য দেশটির সামরিক বাহিনীর শীর্ষ স্থানীয় কমান্ডারদের বাংলাদেশে চলমান পরিস্থিতির দিকে নজর রাখতে বলেছেন। 

ঢাকার দায়িত্বশীল পর্যায়ে বলা হচ্ছে, এটি ‘জেনেরিক টার্মে’ বলা হয়েছে। যেভাবেই বলা হোক না কেনো, এই মন্তব্য দিল্লির প্রতি অসন্তোষ বাড়িয়েছে। অবশ্য সি রাজা মোহন, স্ম্রুতি পট্টানায়েকের মতো ভারতীয় বিশ্লেষকরা বলেছেন, রাজনাথ সিংয়ের বক্তব্যে দুই দেশের মধ্যে তেমন কোনও প্রভাব ফেলবে না।

অন্যদিকে ভারতের জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত স্বীকার করেছেন, নিকট প্রতিবেশী বাংলাদেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ কিংবা ইসরাইল-হামাসকে এক করে দেখার কোনো সুযোগ নেই।

এছাড়া গত ১১ সেপ্টেম্বর অন্তর্বর্তী সরকারের যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া এক সভায় বাংলাদেশ ইস্যুতে ভারতীয় নীতির কঠোর সমালোচনা করেন। 

হুবহু তার ভাষায়, ‘একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের সঙ্গে এ দেশের মানুষের কথা হবে চোখে চোখ রেখে। কথা হবে মাথা উঁচু করে। বাংলাদেশের মানুষকে কথা বলতে হবে সম্মান দিয়ে। ভারত এত দিন একটি দলের সঙ্গে কথা বলেছে; কিন্তু এখন আর তা হবে না। ভারতকে এখন কথা বলতে হবে এদেশের জনগণের সঙ্গে।’

এরমধ্যে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন ভারতের সাথে বাংলাদেশের প্রতিটি চুক্তি ও সমঝোতা ‘পুনর্বিবেচনা’ করা হবে বলে ইঙ্গিত দেন। এটা সুস্পষ্ট যে, ভারতের সঙ্গে একটা অবনতিকর সম্পর্ক যাচ্ছে বাংলাদেশের। কিন্তু দুই দেশের সরকারপ্রধানের বৈঠক হলে, অনেক বিষয় সুরাহার পথ খুলতো। আর এখানেই এড়িয়ে চললো ভারত।

পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের মেরুকরণ

অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠনের পর সম্পর্ক উন্নয়নে ব্যাপক তোড়জোড় শুরু করেছে পাকিস্তান। ঢাকার পাকিস্তান হাইকমিশন সূত্রের বরাত দিয়ে পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যম বলছে, পাকিস্তান সংক্রান্ত বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে দিল্লির পরামর্শ নিতেন শেখ হাসিনা। সবরকম চেষ্টা করেও হাসিনা সরকারের আমলে সম্পর্ক গভীর করতে পারেনি ইসলামাবাদ। 

আর হাসিনার পতনের পরপরই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ ড. ইউনূসকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন, চিঠি দিয়েছেন, ফোনকলে কথাও বলেছেন।পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের মেরুকরণে নতুন আভাস মিলছে। পাকিস্তান বাণিজ্য এবং নিরাপত্তা ইস্যুতে ঢাকার সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করতে চায়। ঢাকা-ইসলামাবাদ সরাসরি ফ্লাইট চালু করতে চায়। এছাড়া ঢাকায় এই প্রথম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হয়েছে। এসব বিষয় দিল্লির জন্য সুখকর নয়।

তাই অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে মোদির আগ্রহ তৈরি না হওয়ার আরো এক কারণ বলা যায়।

ইসলামপন্থি ইস্যু 

হাসিনার গত শাসনামলে ইসলামপন্থিরা কোনঠাসা ছিল মনে করা হয়। কিন্তু তার পতনের পর বাংলাদেশের গণ আন্দোলনকে ‘ইসলামপন্থিদের আন্দোলন’ বলে বয়ান প্রচার করেছে ভারতের বেশিরভাগ সংবাদমাধ্যম। 

এটা সত্য, সরকার পতন পরবর্তী পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা সংক্রান্ত ইস্যুতে ভারত উদ্বিগ্ন। ঢাকা এখন পর্যন্ত দিল্লিকে এ ব্যাপারে আশ্বস্ত করতে পারেনি, যেভাবে হাসিনা সর্বাত্মকভাবে তার শাসনামলে করেছিলেন।

উল্টো ড. ইউনূস বলেছেন, হাসিনা ব্যতীত বাংলাদেশের সবাই ইসলামপন্থি, ভারতকে এই ধারণা থেকে বের হতে হবে। ক্ষমতা হারানোর চারদিন আগে অনেকটা তড়িঘড়ি করেই সন্ত্রাসবিরোধী আইনে জামায়াত এবং ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করেছিল বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। অন্তবর্তীকালীন সরকার সেটা প্রত্যাহার করে নেয়।। এছাড়া কারাগারে আটক থাকা অনেক ইসলামপন্থি নেতাদের মুক্তি মিলে। শুধু তাই নয়, ঢাকার রাজপথে নিষিদ্ধ ঘোষিত ইসলামপন্থি অনেক সংগঠন প্রকাশ্যে শোডাউন করেছে। এসব পরিস্থিতি দিল্লির উদ্বেগ বাড়িয়েছে। মোদির সঙ্গে ইউনূসের বৈঠক না হওয়ার এটাও অনুষঙ্গ হতে পারে।

ভারতীয় রাজনীতি- ভোটব্যাংক

ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যে আগামী এক বছরের মধ্যে বিধানসভা নির্বাচন হবে। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু পরিস্থিতি বিজেপির জন্য একটা রাজনৈতিক ট্রামকার্ডের মতো কাজ করতে পারে। লোকসভা নির্বাচনেও বাংলাদেশ বিরোধী প্রসঙ্গে উঠে এসেছিল। এবার সবশেষ বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের উল্টো করে ঝুলিয়ে সোজা করার হুমকি দিয়েছেন ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ।  ঝাড়খন্ড রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন সামনে রেখে এক সভায় এমন বক্তব্য দেন তিনি।

বাংলাদেশ পরিস্থিতি উত্তেজনাপূর্ণ থাকলে ভারতে শাসকদলের লাভবান হওয়ার সুযোগ বেশি। এটা উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই যে, হাসিনা সরকার পতনের পর সংখ্যালঘুদের উপর হামলা হয়েছে। একইসঙ্গে বাছবিচারহীন গুজবও তৈরি হয়। যা বেশিরভাগ ছড়ানো হয়েছে ভারত থেকে। 

ড. ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করে খুব দ্রুত পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে চায় কি মোদি সরকার? অগ্রাধিকার জায়গায় ইউনূসের সঙ্গে বৈঠককে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। আর বাংলাদেশ ইস্যুতে দেশটির  বিরোধীদলের সমর্থন পাচ্ছেন মোদি। তাই ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক নিয়ে খুব একটা তাগিদও অনুভবও করছেন না ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী।

সীমান্ত হত্যা এবং বিজিবিকে পিঠ না দেখাতে নির্দেশ

দেশের সীমান্তে ঢুকে মানুষ মারলেও পতাকা বৈঠক করে বলা হতো ‘সব ঠিক হয়ে গেছে’—এমন বক্তব্য দিয়েছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন।  তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন, সেই দিন শেষ হয়ে গেছে।  

এরপর সাখাওয়াতের স্থলাভিষিক্ত হওয়া লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীও বিজিবিকে সীমান্তে পিঠ না দেখাতে নির্দেশ দেন।

হাসিনার বিগত ১৬ বছরের শাসনামলে সীমান্ত হত্যা নিয়ে ভারতের প্রতি এমন কঠোর বক্তব্য শোনা যায়নি।  

এছাড়া ২০ আগস্ট ভারতীয় সংবাদমাধ্যম হিন্দুস্তান টাইমস এক প্রতিবেদনে জানায়, ‘পথ ভুলে’ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়া ৫ ভারতীয় জেলেকে ফেরত দিতে অস্বীকৃতি জানায় বিজিবি।একাধিক পতাকা বৈঠক সত্ত্বেও ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) অনুরোধে সায় দেয়নি বিজিবি। বিএসএফের দক্ষিণবঙ্গ সীমান্তের ডিআইজি একে আর্য যেমনটা বলেছেন, গত কয়েক বছরে এবারই প্রথমবারের মতো আটককৃতদের ফেরত দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে বিজিবি।

এর বাইরে হাসিনা সরকারের পতনের পরও সীমান্ত হত্যার ঘটনা ঘটেছে। বিএসএফের গুলিতে ১৩ বছর বয়সী স্বর্ণা দাস এবং কিশোর শ্রী জয়ন্তের মৃত্যুতে ঢাকায় ব্যাপক নিন্দার ঝড় উঠে।  সবমিলিয়ে দুই দেশের সীমান্ত ইস্যুও ঢাকা-দিল্লির সম্পর্কে প্রভাব ফেলেছে। 

দায়িত্ব নেওয়ার আগে থেকে ইউনূসকে নিয়ে অখুশি ছিল ভারত

অন্তবর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার ঠিক আগে ভারতীয় নীতির সমালোচনা করেছিলেন নোবেল বিজয়ী ইউনূস। এ নিয়ে শুরু থেকেই অসন্তোষ ছিল ভারতের। ইউনূস অভিযোগ করে বলেছিলেন, ভারত শেখ হাসিনার প্রতিটি নির্বাচনে কারচুপি করার পদ্ধতিকে সমর্থন করে এসেছে ভারত। এটা ভারতের মতো বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশের বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ। বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনে ভারতের নীরব ভূমিকারও সমালোচনা করেছিলেন তিনি।

ইউনূস বলেছিলেন, ‘আপনার প্রতিবেশীর বাড়িতে আগুন লাগলে আপনি বলতে পারেন না যে, এটি তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। এতে যদি আমাদের ক্ষতি হয়, তা হলে তা আপনাকেও আঘাত করবে। কারণ বাংলাদেশে যদি বিশৃঙ্খলা ও হিংসা ছড়ায়, তাহলে তা সীমান্ত জুড়ে ছড়িয়ে পড়বে। এটা তখন আটকানো যাবে না’।

এসব মন্তব্যের কারণে ইউনূসকে ঘিরে বেশ নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে দিল্লি শিবিরে। ভারত হয়তো মনে করছে, ঢাকার অন্তবর্তীকালীন সরকার দিল্লি প্রশ্নে তাদের নীতি দ্রুত পাল্টাবে না। তাই নিউইয়র্কে ঠাঁসা ব্যস্ত সূচিতে ইউনূসের সঙ্গে বৈঠককে গুরুত্ব দিয়ে দেখছে না ভারত। বাংলাদেশ ইস্যুতে সঠিক সময়ে ‘উপযুক্ত সিদ্ধান্ত’ নেওয়ার যে অপেক্ষা করছে দিল্লি, তা এখনো আসেনি।

আবদুল মজিদ চৌধুরী: সহ-সম্পাদক, দৈনিক যুগান্তর

amcshahriar@gmail.com


Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম