ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথ
লুটপাটের প্রকল্পে হারিয়ে যায় ‘কর্ডলাইন’ প্রস্তাব
শিপন হাবীব
প্রকাশ: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:০১ পিএম
ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথ ৩২০ কিলোমিটার
ঢাকা থেকে বৃত্তাকার রেললাইন হয়ে যাত্রীদের চট্টগ্রাম যেতে প্রায় ৬ ঘণ্টা সময় লাগছে। এই সময়সীমা কমিয়ে আনতে এ রুটে গত ১৫ বছরে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হয়। ১২০ থেকে ১৩০ কিলোমিটার গতিসম্পন্ন ট্রেনও যুক্ত করা হয় রেলবহরে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বরং গৃহীত প্রকল্প ও গতিসম্পন্ন ট্রেন ক্রয়ের নামে বেসুমার লুটপাট হয়েছে। পরিকল্পনাহীন প্রকল্প ঘিরে মন্ত্রী, ডিপিসহ সংশ্লিষ্ট অনেকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। প্রকল্প ভাঙা-গড়ায় রেলে দুর্নীতিবাজদের চক্র এখনো রয়েছে। একজন রেলপথমন্ত্রী গ্রেফতার হয়েছেন। পালিয়ে আছেন ওই সরকারের আরও সাবেক তিন মন্ত্রী। নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে এক সচিবের। বাকি সচিবদের লুটপাটের আমলনামার তালিকা হচ্ছে।
টঙ্গী থেকে ভৈরববাজার পর্যন্ত প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ৮২ কিলোমিটার রেলপথ নির্মিত হয় বিদায়ি সরকারের আমলে। রেলের কাজের ধরন অনুযায়ী মিটারগেজ লাইন সচল থাকার কথা অন্তত অর্ধশত বছর। কিন্তু সাত বছর যেতে না যেতেই মিটারগেজ লাইন ভেঙে ফেলতে হচ্ছে। বিদায়ি আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময়ে ওই রুটেই আবার পরিকল্পনা নেওয়া হয় ৩০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন প্রকল্পের। লুটপাটের উদ্দেশ্যে প্রকল্প গৃহীত হওয়ায় যাত্রীর নিরাপত্তা, পরিবহণ সাশ্রয় এবং ২ ঘণ্টায় ঢাকা-চট্টগ্রাম পৌঁছার ‘কর্ডলাইন’ প্রকল্পটি গত তিন যুগেও গ্রহণ করা হয়নি। রেল বিভাগ থেকে বিভিন্ন সময়ে কর্ডলাইনের প্রস্তাব দেওয়া হলেও মন্ত্রণালয় ও দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী-সচিবরা তা আমলে নেননি।
ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথ ৩২০ কিলোমিটার। আওয়ামী লীগ সরকার গত ১৬ বছরে এ পথে নতুন রেলপথ নির্মাণসহ অত্যাধুনিক দ্রুতগতির ট্রেনও চালু করেছে। হিসাব বলছে, সাধারণ কোচ-ইঞ্জিনের (বর্তমানে অধিকাংশ ইঞ্জিন-কোচ চলছে) চেয়ে প্রায় তিনগুণ বেশি দামে ১২০-১৩০ কিলোমিটার গতির কোচ-ইঞ্জিন ক্রয় করা হয় ২০২৬ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত। ওই সব ইঞ্জিন-কোচ দ্বারা ওই রুটে ট্রেন চলছে গড়ে ৫৭ কিলোমিটার গতি নিয়ে। আমেরিকা কিংবা কোরিয়া থেকে আনা ইঞ্জিন-কোচ ক্রয় নিয়ে বড় রকমের দুর্নীতি রয়েছে। দুদকেও চলছে অনুসন্ধান। গত ১৬ বছরে রেলের ছয় মন্ত্রী-সচিব, রেলওয়ের কিছু ডিজি ও প্রকল্প পরিচালকরা সম্পদের পাহাড় গড়েছেন-এমন অভিযোগ রেলে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
রেলওয়ে পরিকল্পনা দপ্তর সূত্রে জানা যায়, ট্রেনে ঢাকা-চট্টগ্রামে যাতায়াত করতে হয় টঙ্গী-ভৈরব-আখাউড়া ঘুরে। ওই পথে দীর্ঘ ১৬ বছরে সিঙ্গেল-ডাবল লাইন নির্মাণ প্রকল্প ঘিরে শত শত কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগ রয়েছে। পরিকল্পনা দপ্তর থেকে অন্তত ৫-৬ বার প্রস্তাব দেওয়া হয়-ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, লাকসাম হয়ে কর্ডলাইন নির্মাণ প্রকল্পের। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে মাত্র ২ থেকে সোয়া ২ ঘণ্টায় ঢাকা-চট্টগ্রাম ট্রেন চালানো সম্ভব ছিল। পরিকল্পনা দপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ভাষ্য, রেলকে লাভজনক করতে ‘কর্ডলাইন’ নির্মাণ জরুরি। চলমান এবং বিগত সময়ে যেসব প্রকল্প সামপ্ত হয়েছে, সেগুলোর যে কোনো প্রকল্পের চেয়ে কর্ডলাইন গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৬৮ সাল থেকে এই রেলপথ নির্মাণের চেষ্টা চলছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পরিকল্পনা দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, কর্ডলাইন হলে ওই রুটে ২৪ ঘণ্টায় অন্তত ৩৪টি ট্রেন চালানো সম্ভব ছিল। বর্তমানে ঢাকা-চট্টগ্রামে ছয় জোড়া আন্তঃনগর ট্রেন চলাচল করছে। কর্ডলাইন নির্মাণ হলে ঢাকা-চট্টগ্রামের দূরত্ব হবে সোয়া ২০০ কিলোমিটার। যাতায়াতে সময় লাগবে ২ থেকে সোয়া ২ ঘণ্টা। কিন্তু, চলমান রুটে (ঢাকা-চট্টগ্রাম) অপরিকল্পিত ও সুদূরপ্রসারবিহীন প্রকল্প পরপর গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হয়। টঙ্গী-ভৈরব রুটে প্রায় সাত হাজার কোটি টাকায় ৮০ কিলোমিটার সিঙ্গেল মিটারগেজ রেলপথ নির্মাণ করা হয়। সাত বছর না যেতেই ওই লাইন ভেঙে ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া হয়।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, কর্ডলাইন নির্মাণে সংশ্লিষ্ট রেলের মন্ত্রী-সচিবরা আগ্রহ দেখাননি। কিন্তু তারাই ওই পথে দ্রুতগতির বৈদ্যুতিক হাইস্পিড লাইন তৈরি করতে উঠেপড়ে লাগেন। ওই রুটে হাইস্পিড লাইন তৈরিতে প্রাথমিক সমীক্ষায় ১১০ কোটি টাকা ব্যয়ও করা হয়েছে। ১১০ কোটি টাকা ব্যয়ে সমীক্ষা করা ওই প্রকল্প ইতোমধ্যে বন্ধ রাখার নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ ১১০ কোটি টাকা ব্যয়ে যে সমীক্ষা করা হয়েছে-সেই অর্থ জলে গেছে। লুটপাট হয়েছে বরাদ্দ অর্থের বেশির ভাগ টাকা। কর্ডলাইন নির্মাণের পক্ষে থাকা রেল ও মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ১১০ কোটি টাকাসহ, টঙ্গী-ভৈরব, আখাউড়া-লাকসাম প্রকল্প ঘিরে দুর্নীতির যে অভিযোগ-তা তদন্তের মাধ্যমে লুটতরাজদের চিহ্নিত করার।
রেলওয়ে অপারেশন ও পরিবহণ দপ্তর সূত্র জানায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে ব্রডগেজ ট্রেন চলে না। পশ্চিমাঞ্চল রেলে ব্রডগেজ ট্রেন চলে। কর্ডলাইন ডুয়েলগেজ লাইন তৈরির প্রস্তাবনা ছিল। ওই লাইন সম্পন্ন হলে পশ্চিমাঞ্চল থেকে সরাসরি ঢাকা হয়ে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার পর্যন্ত যেতে পারত। চলমান ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথ ঘিরে ডুয়েলগেজ-ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন তৈরি হচ্ছে। ওই সব লাইনে কবে নাগাদ ব্রডগেজ ট্রেন চলবে তা নিশ্চিত করে বলতে পারছে না রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, কর্ডলাইন নির্মাণ হলে সর্বোচ্চ যাত্রী পরিবহণের সঙ্গে সর্বোচ্চ আয় বাড়ত। যা চলমান ট্রেন দ্বারা দুই যুগেও সম্ভব নয়। বর্তমানে চলমান রুটে মাত্র ৩ শতাংশ মালামাল ট্রেনে বহণ করা সম্ভব হয়। ৯৭ শতাংশ মালামাল সড়কপথে পরিবহণ হয়। কর্ডলাইন হলে রেলে মালামাল পরিবহণ বাড়ত প্রায় ৩৭ শতাংশ। চট্টগ্রাম থেকে সরাসরি মালামাল যেত পশ্চিমাঞ্চলে। যাত্রী আয়ের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ আয় বাড়ত শুধু মালামাল পরিবহণে।
অপারেশন দপ্তর সূত্র বলছে, বর্তমানে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে একটি ট্রেন একবার থেকে দুবার ট্রিপ দিতে পারে। এজন্য ইঞ্জিন ও রেক (কোচ) ৬ ঘণ্টা থেকে ১৩ ঘণ্টা পর্যন্ত বসিয়ে রাখতে হয়। যদি কর্ডলাইন নির্মাণ হয়-তাহলে টার্নঅ্যারাউন্ড বর্তমানের চেয়ে প্রায় ৫ গুণ বেশি ট্রিপ হবে। প্রতিটি ট্রেন দিয়ে কর্ডলাইনে অন্তত ৬ জোড়া অর্থাৎ ১২টি ট্রিপ বেশি দেওয়া সম্ভব হবে। অর্থাৎ বর্তমানে দুটি ট্রিপে যে পরিমাণ যাত্রী পরিবহণ ও আয় হয়, ১২ ট্রিপে যাত্রী ও আয় বাড়বে প্রায় ১০ গুণ বেশি। রোলিং স্টকও সবসময় চলমান থাকবে।
গত ১৬ বছরে সমাপ্ত হওয়া নতুন রেলপথ ও প্রকল্প ঘিরে এখনো রেল ভবনে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে। প্রায় সোয়া এক লাখ কোটি টাকার বাস্তবায়িত প্রকল্পের মধ্যে প্রায় ৭২ হাজার কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে নতুন রেলপথ নির্মাণের ক্ষেত্রে। নতুন রেলপথ, নতুন ইঞ্জিন-কোচে গতি ওঠেনি। পাবনা-ঢালারচর, কুমিল্লার-লাকসাম-চিনকি আস্তানা, দোহাজারী-কক্সবাজার, আখাউড়া-লাকসাম, খুলনা-মোংলা, আখাউড়া-আগরতলা, পদ্মা রেলসংযোগসহ নতুন আরও অন্তত চারটি রেলপথ নির্মাণ করা হয়েছে। চলমান রয়েছে আরও বেশ কয়েকটি নতুন রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প। নতুন রেলপথ হয়ে উন্নত মানের ট্রেন গতি নিয়ে চলতে পারছে না। নতুন লাইনেও পদে পদে অনিয়ম-দুর্নীতির কঙ্কাল ভেসে উঠছে। অধিকাংশ প্রকল্প রাজনৈতিক ও লুটপাটের চিন্তা করায় ট্রেন চলছে নামেমাত্র। কোটি কোটি টাকার প্রকল্পে সুফল মিলছে না। অর্থাৎ যাত্রীবান্ধন কর্ডলাইনসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প গ্রহণ থেকে দূরে ছিল সংশ্লিষ্টরা।
এ প্রসঙ্গে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুল বাকী যুগান্তরকে বলেন, নতুন রেলপথ নির্মাণ ও রোলিং স্টক ক্রয়ে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। আমরা এসব আমলে নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে কাজ করছি। নতুন করে যাতে গুরুত্বহীন নতুন রেলপথ ও প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন না হয়-সেদিকে আমরা সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থানে থাকব। রাজনৈতিক কিংবা কোনো একটি মহলের-গোষ্ঠীর লাভের জন্য কোনো প্রকল্প গ্রহণ-বাস্তবায়ন হতে পারে না। যে প্রকল্প বাস্তবায়নে সাশ্রয়, নিরাপদ ও যাত্রী সন্তুষ্ট হবে-সেসব প্রকল্প গ্রহণ-বাস্তবায়নে অগ্রাধিকার থাকবে। যেসব প্রকল্পে সুফল আসছে না সেগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা হবে।