Logo
Logo
×

জাতীয়

ক্ষমা চাওয়ার ইস্যুতে পাকিস্তানের অবস্থান কী ছিল, এখন কী বলছে?

Icon

যুগান্তর ডেস্ক

প্রকাশ: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:৩৪ পিএম

ক্ষমা চাওয়ার ইস্যুতে পাকিস্তানের অবস্থান কী ছিল, এখন কী বলছে?

ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশের মানুষের কাছে পাকিস্তানকে ক্ষমা চাইতে হবে, বহুদিন ধরে এমন দাবি জানিয়ে আসছে বাংলাদেশ। কারণ ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধ চালিয়েছে।

তবে পাকিস্তান ওই অভিযোগ নাকচ করে আসলেও, ১৯৭৪ সালে জুনের শেষ সপ্তাহে বাংলাদেশে সরকারি সফরে এসেছিলেন দেশটির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো। সেই সময় প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের কাছে মৌখিকভাবে ক্ষমা চেয়েছিলেন তিনি।

এরপর ১৯৭৪ সালে সিমলা চুক্তির পর যে আলোচনা শুরু হয়েছিল, তার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। কেননা, এই চুক্তির পরই পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। এছাড়া বাংলাদেশ এবং ভারত পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীদের ফেরত পাঠানো শুরু করে।

একই সময়ে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে আটক যুদ্ধবন্দী এবং সেখানে আটকে পড়া সাধারণ বাঙালিদের ফেরত পাঠানো সমাপ্ত করে পাকিস্তান। তবে বাংলাদেশ ওই সময় যুদ্ধাপরাধীসহ পাকিস্তানের অন্য শীর্ষ সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করার ঘোষণা দিলে পাকিস্তান তাতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে।

এর প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তান দাবি করে, তাদের হাতে গ্রেফতার থাকা ২০০ জন ব্যক্তির বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তান আলাদা করার ষড়যন্ত্র এবং গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাচারের অভিযোগে প্রমাণিত হয়েছে। আর তাই শেষ পর্যন্ত দুই দেশের মধ্যে আলোচনা ও সমঝোতা কেবল নিজেদের বন্দী নাগরিকদের ফেরত দেওয়া-নেওয়ার মধ্যেই সীমিত থাকে।

এই ঘটনার কারণেই পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে এবং এদেশের কাছে দুঃখ প্রকাশ করতে বাধ্য হয়েছিল। অন্যদিকে, বাংলাদেশ তখন ঘোষণা দেয় যে, তারা ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দীর কোনো বিচার করবে না এবং তাদেরকে পাকিস্তানে ফেরত পাঠানো হবে। ভবিষ্যতে সহযোগিতার সম্পর্ক রাখবে এমন চুক্তি স্বাক্ষর করে দুই দেশ।

চুক্তিটি ত্রিপক্ষীয় আলোচনায় সবার সম্মতিতে হয়, তাতে স্বাক্ষর করেন বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা।

চুক্তির বিবরণ অনুযায়ী, পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন যে, দেশটির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো বাংলাদেশের জনগণের কাছে অনুরোধ করেছেন যেন তারা তাদের (পাকিস্তানকে) ক্ষমা করে দেন এবং অতীতের কথা ভুলে গিয়ে সামনে এগিয়ে যান।

দ্বিতীয়বার, পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মুশাররফ বাংলাদেশে সফরকালে স্মৃতিসৌধ পরিদর্শন করেন এবং ওই সময়ের পরিস্থিতির জন্য বাংলাদেশের জনগণের দুঃখ প্রকাশ করেন।

সর্বশেষ পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান একাধিকবার কথা বললেও আনুষ্ঠানিকভাবে সেটা করা হয়নি।

তবে এখন কি সেই ক্ষমা চাওয়া বা স্বীকৃতি দেওয়ার মতো পদক্ষেপ নেওয়া হবে কি না সে প্রসঙ্গে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মুমতাজ জাহরা বেলুচ বিবিসি বাংলাক বলেন, ১৯৭১ সালের ‘বেদনাদায়ক’ ইতিহাস দুই দেশই বহন করে আসছে, কিন্তু সে সমস্যার সমাধান ১৯৭৪ সালেই দুই দেশের নেতারা করেছেন এবং চুক্তিও হয়েছে।

১৯৭১ এর প্রেক্ষাপটে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরে যেতে হয়েছিল (২০ ডিসেম্বর ১৯৭১)। ক্ষমতায় আসেন জুলফিকার আলী ভুট্টো, যিনি ৭০ এর নির্বাচনে পশ্চিম পাকিস্তানে জয়ী হয়েছিলেন, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে শেখ মুজিবুর রহমানের জয় নিয়ে টানাপড়েনে ক্ষমতা হস্তান্তর স্থগিত হয়ে গিয়েছিল। তবে ১৯৭১ সালের তিক্ততা পেছনে ফেলে আন্তর্জাতিক মহলের চেষ্টায় ১৯৭৪ সালে দুই দেশের নেতাই অপর দেশে সফর করেন।

২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪ এ পাকিস্তানের লাহোরে শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত বাজিয়ে, তোপধ্বনি এবং গার্ড অফ অনার দিয়ে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো। এর আগের দিনই বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছিল পাকিস্তান। সে বছর জুন মাসে ভুট্টোও এসেছিলেন বাংলাদেশে।

ঢাকায় এসে ভুট্টো বলেছিলেন, যা হয়েছে তা নিয়ে অন্তর থেকে অনুতপ্ত হতে বা তওবা করতে দেরি হয়ে যায়নি। পাকিস্তানের মানুষ আপনাদের সিদ্ধান্তকে শ্রদ্ধা জানায়। তারা এবং পাকিস্তানের সরকার বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতাকে স্বীকার করে এবং শ্রদ্ধা জানায়।

১৯৭৪ এর এপ্রিলের বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যকার ত্রিপাক্ষিক চুক্তির বিবরণেও রয়েছে যে, জুলফিকার আলী ভুট্টো বাংলাদেশের জনগণের কাছে অনুরোধ করেছেন যেন তারা তাদের (পাকিস্তানকে) ক্ষমা করে দেন এবং অতীতের কথা ভুলে গিয়ে সামনে এগিয়ে যান।

শেখ মুজিবুর রহমানের তরফ থেকেও অতীত ভুলে নতুন সূচনা করার এবং ক্ষমার নিদর্শন হিসেবে বিচার না চালানোর সিদ্ধান্তের কথার উল্লেখ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম নিউ ইয়র্ক টাইমসের একটি আর্কাইভ প্রতিবেদনে।

দুই নেতার সেসময়কার দূরদর্শিতা উন্নতি এবং সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখিয়েছে বলে উল্লেখ করেন মুমতাজ জাহরা বেলুচ।

পাকিস্তানের বর্তমান প্রজন্ম সেই ট্র্যাজেডির পরে জন্ম নিয়েছে এবং বাংলাদেশের মানুষের প্রতি বিশাল শ্রদ্ধা রাখে। ৫০-৬০ বছর পর এসে সে প্রসঙ্গ আবার সামনে আনার প্রয়োজন নেই বলে মনে করেন এই কূটনীতিক। 

২০০২ সালে তৎকালীন সেনা সমর্থিত প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফও ঢাকা সফরে এসে অনুশোচনা প্রকাশ করেন। তবে সেসব দুঃখ প্রকাশকে আনুষ্ঠানিকভাবে বা যেভাবে চাওয়া হয়েছিল তেমনভাবে ক্ষমা চাওয়া হিসেবে দেখা হয়নি বাংলাদেশে।

ক্ষমার বিষয়টিতে জোর দেওয়া বা এই অস্বস্তিকর প্রসঙ্গে পাকিস্তানকে লজ্জা দেওয়ার মতো কঠিন মনোভাবের প্রয়োজন নেই বলে মনে করেন শহিদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর সন্তান আসিফ মুনীরও।

তবে পাকিস্তান এবং ভারতে ১৯৭১ কে ভারতের কাছে পরাজয় হিসেবে দেখার যে দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে সেটা বাংলাদেশের ‘মুক্তির আন্দোলনের’ সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং এই জায়গায় আলাপ আলোচনার মাধ্যমে একটি ঐক্যমত্যে যাওয়ার প্রয়োজন রয়েছে বলে উল্লেখ করেন আসিফ মুনীর।

তিনি বলছেন, অবশ্য পাকিস্তানের মানুষ ৭১ সম্পর্কে ভিন্নভাবে জানলেও তাদের মধ্যে দুঃখবোধ ছিল না তেমনটাও নয়। একাত্তরের সময়েও পাকিস্তানি শিল্পী সাহিত্যিকরা কিন্তু বাংলাদেশের পক্ষে কথা বলার চেষ্টা করেছিল।

বাংলাদেশের সামাজিক মাধ্যমে পরিচিত মুখ, লেখক ফাহাম আবদুস সালাম ১৯৯৮ সালে পাকিস্তানে নিজের একটি অভিজ্ঞতার গল্প জানান বিবিসি বাংলাকে। তিনি জানান, পাকিস্তানের একজন ট্যাক্সিচালক যখন জানতে পারেন সালাম বাংলাদেশি তখন অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে তার কাছে ক্ষমা চান। সে তার হাত ধরে মাফ চেয়েছে ১৯৭১ সালের জন্য। এটা তার হৃদয়কে স্পর্শ করে। যদিও তিনি মানেন যে, পাকিস্তানের সবার মনোভাব একই রকম না; কিন্তু একরকম খারাপ লাগার বোধ সেখানে আছে।

আবদুস সালাম মনে করেন, যে ছেলেটার জন্ম ১৯৭১, ৭২ বা এর পরে সে কি দায়ী? আপনি কি আপনার দাদার অপরাধের জন্য দায়ী হবেন? ১৯৭১ সালের পাকিস্তান ও এখনকার পাকিস্তান বা বাংলাদেশ এক নেই উল্লেখ করে বাংলাদেশিদের 'বড়ত্বের' জায়গা দিয়ে বিবেচনা করার দরকার।

পাকিস্তানের অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা এবং পাকিস্তান সেনা গোয়েন্দা সংস্থার ( আইএসআই) সাবেক প্রধান লে. জে. (অবসরপ্রাপ্ত) আসাদ দুররানি বিবিসি বাংলাকে বলেন, গত ৫০ বছরে সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কোনো স্বীকারোক্তি না এলেও পাকিস্তানের মানুষ এখন অনেকটাই বুঝতে পারছে কোথায় গলদ হয়েছিল।

তিনি বলেন, মানুষের মনে এখন আর কোনো সন্দেহ নেই যে ভুল হয়েছিল। সেনাবাহিনীর ভুল হয়েছিল। নির্বাচনের পর (সত্তরের নির্বাচন) শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব মেনে না নিয়ে জুলফিকার আলী ভুট্টো ভুল করেছিলেন। এখন সাধারণ মানুষের স্তরেও এই বোধ পৌঁছে গেছে।

জেনারেল দুররানি বলেন, ভারত পরিস্থিতির সুযোগ নিয়েছিল তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ঘরের ভেতর সমস্যা থাকলে শত্রু তো সুযোগ নেবেই। তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই।

তবে জেনারেল দুররানি বলেন, এখনও ১৯৭১ নিয়ে তেমন কোনো কথাবার্তা প্রকাশ্যে পাকিস্তানে হয় না। ডিসেম্বর এলে কিছু মানুষ কথা বলেন, লেখেন। কথা তেমন হয় না কারণ গত ৫০ বছরে আরো অনেক কিছু ঘটে গেছে পাকিস্তানে।

পাকিস্তানে সিনিয়র সাংবাদিক নাসিম জেহরা বলেন, আমজনতা হয়তো ১৯৭১ নিয়ে মাথা ঘামায় না, কিন্তু যারা দেশ এবং সমাজ নিয়ে চিন্তা করেন, কথা বলেন, লেখালেখি করেন তারা এখন জানেন পূর্ব পাকিস্তানের ব্যবস্থাপনায় ভুল হয়েছিল।

তিনি বলেন, অন্য অনেক বিষয়ের মত ১৯৭১ নিয়েও আত্মসমালোচনা এবং আত্মউপলব্ধি হচ্ছে। ভারতের ভূমিকা যে ছিল তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু নিজেদের ভুলের পরিণতি নিয়েও অনুশোচনা বা দুঃখবোধ মানুষের রয়েছে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম