Logo
Logo
×

জাতীয়

অন্তর্বর্তী সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ হাসিনা আমলের দায়দেনা পরিশোধ

Icon

হামিদ বিশ্বাস

প্রকাশ: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:৫২ পিএম

অন্তর্বর্তী সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ হাসিনা আমলের দায়দেনা পরিশোধ

ফাইল ছবি

দেশের ডলার সংকট তীব্রতর হচ্ছে। বিশেষ করে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের বিপুল দায়দেনা এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে ওইসব দায় থেকে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার পরিশোধের চাপ রয়েছে। এছাড়া সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিভিন্ন এলসির দায় মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে পড়েছে। ওই দায়ের পরিমাণ ১২ বিলিয়ন ডলারের বেশি। পাশাপাশি বিদেশি ঋণে পরিশোধের চাপ তো রয়েছেই। এক কথায় আওয়ামী লীগ আমলের করে যাওয়া দেনা পরিশোধ করতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে নতুন সরকারকে। মূলত বিগত সরকারের আমলে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ, ব্যাপকহারে লুটপাট ও অর্থ পাচার নতুন সরকারের ঘাড়ে বোঝা হয়ে চেপে বসেছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে রাজনৈতিক মাঠ উত্তপ্ত হয়ে উঠে। এরপর সরকার পতন হলেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো নিয়ন্ত্রণে আসেনি। এ কারণে দেশের রপ্তানি খাত বড় ধরনের সমস্যায় পড়েছে। বিশেষ করে সম্প্রতি পোশাক শ্রমিকদের আন্দোলনের কারণে হুমকির মুখে রয়েছে দেশের রপ্তানি খাত। এ খাতের পরিস্থিতির উন্নয়ন না ঘটলে বড় ধরনের ডলার সংকটে পড়বে দেশ। যদিও সরকার পতনের পর বিদেশি বিনিয়োগ, ঋণ ও প্রবাসী আয়ে ব্যাপক উন্নতি ঘটেছে।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গত ৩ অর্থবছরে অর্থাৎ আগের সরকারের আমলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশের ডলার বাজার ঠিক রাখতে রিজার্ভ থেকে প্রায় ৩৩ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে। এমনকি বিদায়ি অর্থবছরেও ১২ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন বা ১ হাজার ২৬৯ কোটি ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু ঋণ পরিশোধের চাপ ও রিজার্ভ তলানিতে নেমে যাওয়ায় ডলার বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছেন নতুন গভর্নর। এজন্য ডলার বাজারে কিছুটা সংকট দেখা দিয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর এলসির দায় মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে পড়ায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সরকারি শীর্ষ ২০ প্রতিষ্ঠানের বিদেশি এলসির দায় দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১৩৬ কোটি (১১ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন) ডলার। বাংলাদেশি টাকায় যার পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। তবে ওই সব দায় এখন বেড়ে ১২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। এছাড়া বেসরকারি খাতের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের দায় দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭ কোটি ডলার। এসব দায়ের সবগুলো এখন মেয়াদোত্তীর্ণ। যদিও আগামী ৬ মাসের মধ্যে সরকারকে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হবে। না হয় প্রথমবারের মতো খেলাপি হয়ে পড়বে দেশ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা যুগান্তরকে বলেন, আগের দায় পরিশোধের চাপ রয়েছে। তবে বাংলাদেশ কখনো খেলাপি হয়নি। ভবিষ্যতেও হবে না। এসব দায় পরিশোধের বিষয়ে কাজ করছি। এ ক্ষেত্রে বিদেশি ঋণ, বিনিয়োগ, রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বাড়ানোর বিকল্প নেই। ইতোমধ্যে রেমিট্যান্স গত অর্থবছরের তুলনায় ৬০ শতাংশ বেড়েছে। অন্য খাতগুলোতেও ইতিবাচক ধারা রয়েছে। কিন্তু দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক না থাকায় রপ্তানি খাত কিছুটা টালমাটাল। এটাকে ঠিক করা গেলে সংকট কেটে যাবে। এছাড়া দেশ যাতে খেলাপি না হয় সে জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছে দায় পরিশোধে সহায়তা চাওয়া হয়েছে।

ডলার সংকট কাটতে কত সময় লাগবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই মুহূর্তে তা বলা কঠিন। তবে ঠিকভাব কাজ করতে পারলে সংকট ধীরে ধীরে কমে আসবে। আমরা ডলার বাজারকে স্থিতিশীল রাখতে কাজ করছি। এখন ব্যাংক আর খোলা বাজারের পার্থক্য মাত্র ১ টাকা। এটা ইতিবাচক। এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, বর্তমান সরকার ডলারের সংকট কাটাতে আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ বিভিন্ন সংস্থা ও দেশ থেকে ৬ বিলিয়ন ডলারের ঋণ সহায়তা চেয়েছে। এসব ঋণ পাওয়া যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে। ঋণগুলো এলে সংকট কিছুটা কেটে যাবে। কিন্তু বিগত সরকারের আমলে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প নিয়ে দেশের দায় অনেক বাড়িয়েছে। এই দায় পরিশোধের চাপ ২০২৯-৩০ সাল পর্যন্ত থাকবে।

তিনি বলেন, দেশের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ এখন ১৮ লাখ কোটি টাকার বেশি। এসব ঋণের সাড়ে ১৫ লাখ কোটি টাকাই নিয়েছে বিগত সরকার। মূলত অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প তৈরি, সেখান থেকে ব্যাপক হারের লুটপাট ও আর্থিক খাত থেকে অর্থ বের করে পাচারের কারণেই দেশে ডলারের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।

দেশের ডলার সংকট কাটতে কত সময় লাগবে তা জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা না প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এটা এখন বলা কঠিন। তবে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ না থাকলে ও বিদেশি ঋণ ও বিনিয়োগগুলো ঠিকভাবে আসলে ২ বছরের মধ্যে সংকট কিছুটা কমে যাবে। তিনি বলেন, বিগত সরকারের আমলে সরকারি আমলা, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদরা অনিয়মের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করে তা পাচার করেছেন। দেশে রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের যেসব ডলার আসার কথা ছিল সেগুলো বিদেশেই থেকে গেছে। এজন্য ডলারের সংকট তৈরি হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ এলসির সবচেয়ে বেশি দায় বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি)। প্রতিষ্ঠানটির দায়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৩৬ কোটি বা (৯ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন) ডলার। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এলসির দায় ৫২ কোটি ডলার। বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলা) ৪৪ কোটি ডলার। ডিরেক্টর জেনারেল ডিফেন্স পারচেজের (ডিজিডিপি) প্রায় ৩৪ কোটি ডলার। নৌবাহিনীর ২৯ কোটি ডলার। এছাড়া সশস্ত্র বাহিনীর প্রায় ১২ কোটি ডলার, কমান্ডেন্ট বাংলাদেশ অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিজের ৯ কোটি ডলারের বেশি, পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের ৪ কোটি ডলারের বেশি, খাদ্য মন্ত্রণালয়ের প্রায় ৪ কোটি ডলারসহ সরকারি ২০টি প্রতিষ্ঠানের প্রায় সাড়ে ১১ বিলিয়ন ডলার।

এদিকে দেশের রিজার্ভ সংকট কাটাতে ডলার বিক্রি বন্ধ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বর্তমানে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি অনুযায়ী রিজার্ভ প্রায় ২০ বিলিয়নে দাঁড়িয়েছে। বাজারের ডলার সংকট কাটাতে আন্তঃব্যাংক ডলার বাজারকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এমনকি সরকারি দায় পরিশোধে বেসরকারি ব্যাংকগুলো থেকে ডলার ক্রয় করে সোনালী ব্যাংককে সহায়তা করা হচ্ছে বলেও জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম