Logo
Logo
×

জাতীয়

নির্বাচন, দুদক ও সংবিধান সংস্কার নিয়ে কী ভাবছেন কমিশন প্রধানরা

Icon

যুগান্তর ডেস্ক

প্রকাশ: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০:২০ এএম

নির্বাচন, দুদক ও সংবিধান সংস্কার নিয়ে কী ভাবছেন কমিশন প্রধানরা

ফাইল ছবি

বাংলাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর রাষ্ট্র সংস্কারের দাবি ক্রমশ জোরালো হয়ে ওঠে। সেই প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকারের এক মাসের মাথায় গুরুত্বপূর্ণ ছয়টি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার সংস্কারে ছয় বিশিষ্ট নাগরিককে দায়িত্ব দেওয়ার ঘোষণা দিলেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। 

এ সরকারের একমাস পূর্তি উপলক্ষ্যে বুধবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে এ ঘোষণা দেন প্রধান উপদেষ্টা। 

সংস্কারের জন্য প্রস্তাবিত কমিশনগুলোতে যাদের দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে তাদের প্রায় সবাইকেই সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রগুলোর নানা ইস্যুতে আগে থেকেই সরব দেখা গেছে। সংস্কার এবং স্ব-স্ব ক্ষেত্রের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাদের সঙ্গে কথা হয় বিবিসি বাংলার। 

যদিও এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। ফলে তাদের কর্মপরিধি ও প্রক্রিয়া কী হবে তাও এখনো স্পষ্ট নয়। তবে সংস্কারের ব্যাপারে নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন তারা। 

জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা সংস্কারের জন্য ছয়টি কমিশনের প্রধান হিসেবে যাদের দায়িত্ব দেওয়ার কথা বলেছেন তারা হলেন- 

নির্বাচন ব্যবস্থা - বদিউল আলম মজুমদার 

পুলিশ প্রশাসন - সফর রাজ হোসেন 

বিচার বিভাগ - বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমান 

দুর্নীতি দমন কমিশন- ইফতেখারুজ্জামান 

জনপ্রশাসন - আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী 

সংবিধান - শাহদীন মালিক 

কমিশন প্রধানরা আগামী ১ অক্টোবর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করবেন। 

নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক 

আমাদের দেশের অন্যতম বিতর্কিত বিষয় নির্বাচন ব্যবস্থা। বিগত তিনটি জাতীয় নির্বাচন নিয়েই বিতর্ক ছিল তুঙ্গে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও ঘুরেফিরে এসেছে বিভিন্ন অভিযোগ। নির্বাচনের আয়োজক নির্বাচন কমিশনগুলোর ভূমিকা নিয়েও তাই সমালোচনা আছে। দেশের নির্বাচনি ব্যবস্থা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন সুশাসনের জন্য নাগরিক বা সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। 

এবার সেই নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে বদিউল মজুমদারকে। 

সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে তেমন সংস্কারের পথ বের করা সম্ভব হবে কিনা? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সর্বজন গ্রহণযোগ্য কোনোদিনই সম্ভব নয়। এটা ইউটোপিয়ান (কাল্পনিক)। কিন্তু সবার মতামতের ভিত্তিতে একটা কনসেনসাস(মতৈক্য) যদি দাঁড় করান যায়, সেটিই হবে কাঙ্ক্ষিত। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলসহ, ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবার মতামত নেবেন বলে জানান তিনি। সবার মতামত নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার কাছে রিপোর্ট দেবে কমিশন। 

তিনি বলেন, দীর্ঘদিন রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের আওতায় নির্বাচন কমিশন গঠনের পর ২০২২ সালে কমিশন গঠনে একটি আইন করে আওয়ামী লীগ সরকার। তবে সেই আইনের সমালোচনা করে, নিরপেক্ষ কমিশন গঠন করে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে সেটি কতটা ভূমিকা রাখবে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন অনেকে। 

দেশে একটা নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে যার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কার্যকর হয়, সবাই এখন তেমন প্রত্যাশা করছেন বলে মত বদিউল আলম মজুমদারের। 

তার মতে, নিরপেক্ষ নির্বাচন করার ব্যবস্থা করা না গেলে কোনো সংস্কারই স্থায়ী হবে না। মানুষের সম্মতির শাসন যদি প্রতিষ্ঠিত না হয় তাহলে যত ক্ষেত্রে যত সংস্কারই করা হোক না কেন, কোনোটাই টেকসই হবে না। 

দুদক সংস্কার হবে কীভাবে? 

গণতন্ত্রের মতই সুশাসনের সূচকেও বাংলাদেশের অবস্থান বরাবরই তলানিতে। উল্টো দিক থেকে বললে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় ওপরের দিকেই দেশটির অবস্থান। 

গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে সার্বিকভাবে দুর্নীতি বেড়েছে বলে জানাচ্ছে দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই)। 

বার্লিন-ভিত্তিক সংস্থাটি ২০২৩ সালে দুর্নীতির যে ধারণাসূচক প্রকাশ করেছে, সেখানে আগের বছরের তুলনায় দুই ধাপ নিচে নেমে গেছে বাংলাদেশ। সূচক অনুযায়ী, বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান এখন দশম। 

দুর্নীতি প্রতিরোধে কাজ করা প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ ইফতেখারুজ্জামানকে মনোনীত করা হয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে। 

দুর্নীতির ব্যাপকতার কথা উল্লেখ করে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, যেহেতু দুদকের সংস্কারের কথা বলা হয়েছে, প্রথমে কমিশনের নিজস্ব আইন এবং এর সঙ্গে যে সম্পূরক আইনগুলো আছে সেদিকে নজর দিতে হবে। 

তিনি বলছেন, আইনগুলো রিভিউ করে দেখতে হবে এগুলোতে কোথায় প্রতিবন্ধকতা আছে বা কোথায় সুযোগ আছে। এরপর প্রতিষ্ঠানটির কাঠামো ও জনবলকে অগ্রাধিকার তালিকায় রাখতে চান তিনি। 

তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠান হিসেবে যে দুর্বলতা ও ঘাটতি আছে; তাছাড়া, নেতৃত্ব, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, পেশাগত উৎকর্ষ নিয়েও ভাবতে হবে। বিভিন্ন সময়ে দুদকের কর্মকর্তাদেরই দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ার নজির আছে। 

অর্থপাচারের মামলা তদন্ত করতে গিয়ে সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মিজানুর রহমানের কাছ থেকে দুদকের পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছিরের ৪০ লাখ টাকা ঘুস নেওয়ার ঘটনা রীতিমতো উদ্বেগ সৃষ্টি করেছিল। 

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, উচ্চ পর্যায়ে যারা নেতৃত্বে থাকেন তাদের সৎসাহস দৃঢ়তা নিয়ে সবসময়ই উদ্বেগ ছিল দেশবাসীর। নিয়োগ প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে প্রতিষ্ঠানটির আইনি এবং প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে সক্ষমতা আছে সক্ষমতার জায়গায় নিয়ে যাওয়া চেষ্টা করতে হবে। 

দুর্নীতির সঙ্গে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সম্পৃক্ততা থাকে উল্লেখ করে তিনি বলেন, শুধু দুদককে সংস্কার করলে হবে না। রাজনৈতিক সংস্কৃতির নেতিবাচক দিক এবং দুদকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার প্রয়োজন বলেও মনে করেন টিআইবি'র নির্বাহী পরিচালক। 

উদাহরণ হিসেবে অর্থ পাচারের প্রসঙ্গ টেনে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এক্ষেত্রে রাজস্ব বোর্ড, সিআইডি, ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এর মত প্রতিষ্ঠানে সংস্কার এনে সক্ষমতা কীভাবে বৃদ্ধি করা যায় সেই চেষ্টাও রাখতে হবে।

সংবিধান নিয়ে ভাবনা কী? 

সংস্কারের যে-সব দাবি উঠছে সেগুলোর অন্যতম সংবিধানের সংস্কার। এই সংস্কারের জন্য জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিকের নাম ঘোষণা করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। বাংলাদেশে সংবিধান বিশেষজ্ঞ হিসেবে সুপরিচিত এই আইনজীবী। 

মালিক বলেন, বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গঠনে যা যা দরকার তা বর্তমান সংবিধানেই আছে। বিদ্যমান সংবিধান দিয়েই চাইলেই সংকটের সমাধান সম্ভব। 

এই বিশেষজ্ঞ বলেন, বাংলাদেশের সংবিধানে ১৫৩টি অনুচ্ছেদ আছে। এখন অনেকে সংস্কারের কথা বলে। কিন্তু আমার প্রশ্ন এই সংবিধানের যে ধারাগুলো আছে সেটাতে আসলে অসুবিধা কোথায় সেটা তো জানতে হবে। যারা সংস্কারের কথা বলছে তারা কোনটা সংস্কার চায় সেটা স্পষ্ট করে বলেনি। 

জনপ্রশাসন ও বিচার বিভাগের কী হবে? 

পুলিশ বাহিনীতে অনিয়ম, দুর্নীতি, দলীয়করণের অভিযোগ যেমন আছে তাদের হাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগও কম নয়। 

জুলাই-আগস্টের ঘটনা পরম্পরায় এক পর্যায়ে রীতিমতো স্থবির হয়ে পড়ে পুলিশি কার্যক্রম। পুলিশ প্রশাসনেও সংস্কার আনতে চায় সরকার। এজন্য দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে সাবেক জনপ্রশাসন সচিব সফর রাজ হোসেনকে। 

সরকারের পক্ষ থেকে কাজের যে পরিধি নির্ধারণ করে দেওয়া হবে তার ভিত্তিতে কাজ করতে চান সাবেক এই সচিব। 

তিনি বলেন, ওনারা যেইটা চিন্তা ভাবনা করবেন, সেটার আলোকেই কাজ করবো। সরকার ও আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলাপ করে তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী সুপারিশ প্রস্তুত করা হবে। 

এছাড়াও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধানের দায়িত্ব পেতে যাওয়া আবদুল মুয়ীদ চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তার কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। 

এদিকে বিচার বিভাগ সংস্কারের জন্য মনোনীত বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমানের সঙ্গে চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। 

বুধবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা কমিশনগুলোর কাজ তিন মাসের মধ্যে সম্পন্ন হবে বলে আশা প্রকাশ করেন। 

কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে সরকার পরবর্তী পর্যায়ে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পরামর্শসভার আয়োজন করবে। 

চূড়ান্ত পর্যায়ে ছাত্র সমাজ, নাগরিক সমাজ, রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি, সরকারের প্রতিনিধি নিয়ে ব্যাপকভিত্তিক তিন থেকে সাত দিনব্যাপী একটি পরামর্শসভার ভিত্তিতে সংস্কার ভাবনার রূপরেখা চূড়ান্ত করা হবে বলেও ভাষণে জানান প্রধান উপদেষ্টা। 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম