৫৮ হাজার টাকা বেতনের পাউবোর রেজাউলের সম্পদের পাহাড়
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:১১ পিএম
সারা দেশে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) অধিগ্রহণকৃত প্রায় ৩৫ হাজার একর জমির পসরা সাজিয়ে বসেছেন ভূমি রাজস্ব পরিচালক মো. রেজাউল করিম। এখান থেকে শত শত একর জমি নামে-বেনামে, লিখিত ও মৌখিকভাবে লিজ দিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তিনি। কী পরিমাণ জমি বরাদ্দ বা লিজ দেওয়া হয়েছে, অবশিষ্ট জমির পরিমাণই বা কত-এসবের কোনো হিসাব মিলছে না। সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী এবং গোপালগঞ্জের নাম ব্যবহার করে কর্মস্থলে নিজের ক্ষমতার বলয় প্রসারিত করেছেন। এভাবেই ৩৫ হাজার একর জমির অলিখিত মালিক সেজে বসেন।
চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী এস আলম গ্রুপের প্রতিষ্ঠিত এসএস পাওয়ার প্ল্যান্টেই আছে পাউবোর একশ একর জমি। একই প্রতিষ্ঠানকে নতুন করে ৪০ একর জমির ৫ বছরের জন্য লিজ নবায়নের মাধ্যমে পকেটে তুলেছেন মোটা অঙ্কের অর্থ। এভাবে প্রতিমাসে পাউবোর অধিগ্রহণকৃত জমি লিখিত ও মৌখিক লিজের নামে লাখ লাখ টাকা মাসোহারা আদায় করে এসেছেন তিনি।
অধিগ্রহণকৃত জমি লিজ বা বরাদ্দের ক্ষেত্রে কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা করতেন না রেজাউল। আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবে নিজেকে ক্ষমতাবান বলে জাহির করায় এতদিন কেউ কিছু বলার সাহস পাননি। কিন্তু ৫ আগস্টের পর থেকে তার অপকর্মের খতিয়ান প্রকাশ্যে আসা শুরু করেছে। ৫ বছরে তিনি এ অবৈধ আয়ে শুধু বনানীতেই কিনেছেন বিলাসবহুল দুটি ফ্ল্যাট। লাখ লাখ টাকার এফডিআরসহ দামি গাড়ি এবং নিজ গ্রামে দৃষ্টিনন্দন বাড়িও করেছেন। যুগান্তরের দীর্ঘ অনুসন্ধানে এ কর্মকর্তার দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র পাওয়া যায়।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, মো. রেজাউল করি পাউবোর বঙ্গবন্ধু পরিষদের সহসভাপতির দায়িত্ব নিয়ে যেন দুর্নীতি করার সনদ হাতে পান।
আয়বহির্ভূত সম্পদের চিত্র : রেজাউল করিম বাসা ভাড়া ও অন্যান্য আর্থিক সুযোগ-সুবিধা বাদ দিয়ে প্রতিমাসে বেতন পান ৫৮ হাজার টাকা। অথচ ২০১৯ সালে ভূমি ও রাজস্ব পরিদপ্তরে যোগদানের পর তার সম্পদের পরিমাণ বাড়তে থাকে। গত কয়েক বছরে তিনি কোটি কোটি টাকার স্থাবর সম্পদের মালিক হয়েছেন। শুধু বনানীতেই তিনি আলিশান দুটি ফ্ল্যাট কিনে ভাড়া দিয়েছেন। ফ্ল্যাট ২টির বাজারমূল্য অন্তত ৮ কোটি টাকা। বনানী আই ব্লকে ১নং রোডে ২১নং প্লটে আধুনিক ডিজাইনে নির্মিত ভবনে তার বি-৩নং ফ্ল্যাট রয়েছে। ২০২৩ সালের ১৭ জুলাই ৫৯০৮নং দলিলে ২৭১৫ বর্গফুটের ফ্ল্যাটের মালিক রেজাউল করিম। স্ত্রী হোসনে আরা বেগমের নামে আরেকটি ফ্ল্যাট কিনেছেন বনানীর কে-ব্লকে। ২০২১ সালে ১০ অক্টোবর ১৫৬০ বর্গফুটের ফ্ল্যাটটি রেজিস্ট্রি হয় গ্যারেজসহ। ফ্ল্যাটের ঠিকানা: ব্লক-কে, রোড-২০, প্লট-৩০, ফ্লাট-বি/৪। গুলশান সাবরেজিস্ট্রি অফিসের দলিল নং ৬৮১২। এছাড়াও ঢাকার উত্তরায় রয়েছে ২৬০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট। ঠিকানা: বাড়ি নং-২১, রোড নং-০২, সেক্টর-১৩, উত্তরা মডেল টাউন। মিরপুরে ১টি ১৮০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট, উত্তরায় ৫ কাঠার প্লট এবং কক্সবাজারে স্যুট ক্রয় করেন। জামালপুর সদরের বেলটিয়ায় ডুপ্লেক্স বাড়ি, লেটেস্ট মডেলের একাধিক গাড়ি আছে তার। এর মধ্যে যুগান্তরের তথ্যানুসন্ধানে ঢাকায় এলিয়ন গাড়ির সন্ধান পাওয়া গেছে। এছাড়াও ফাইন্যান্স কোম্পানি আইপিডিসি, জাতীয় সঞ্চয়পত্রসহ বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তার নামে, স্ত্রী ও সন্তানদের নামে-বেনামে রয়েছে কোটি কোটি টাকার এফডিআর, সঞ্চয়পত্র।
জমি লিজের চিত্র : ঢাকা উত্তরার আব্দুল্লাহপুরে পাউবোর ১০ একর জমির ওপর মাছবাজার, ৮ একর জমির ওপর সবজি বাজার, শতশত একর জমিতে বালুমহাল, দোকান ভিটি, বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। এসব লিজের কোনোটি কাগজে, কোনোটি আবার মৌখিক নির্দেশনায় চলছে বছরের পর বছর। আওয়ামী লীগের নামে নীল দল করে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা লোপাটের সিঁড়ি তৈরি করেন রেজাউল। ঢাকার মিরপুর ও মোহাম্মদপুরে ৫০ একরের বেশি জমি বিভিন্ন ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। চাঁদপুরের মেঘনা ধনাগোদা এলাকায় মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে পানি উন্নয়ন বিভাগের ৩০ একর জমি আলোছায়া পর্যটনকেন্দ্রকে লিজ না দিয়ে মৌখিকভাবে জমি বুঝিয়ে দিয়েছেন। সরকারি রাজস্ব আদায় না করে নিজের পকেটে নিচ্ছেন টাকা। মতলব উত্তর-চাঁদপুরের মোহনপুর পর্যটনকেন্দ্রকেও একইভাবে পাউবোর জমি দিয়ে ঘুস বাণিজ্য করেছেন। ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৩০/৪০ একর জমি নিজস্ব সিন্ডিকেটের হাতে তুলে দিয়েছেন রেজাউল। এভাবে সারা দেশে তার একক আধিপত্যের নৈরাজ্য গড়ে তুলেছেন। এছাড়াও চট্টগ্রামের এস আলমের নামে ৪০ একর জমির লিজ নবায়ন করে বিপুল টাকা ঘুস নিয়েছেন। সিলেটের মৌলভীবাজারে ড্রিমল্যান্ড পর্যটন কেন্দ্রকে ৪০ একর জমি লিজ দিয়ে নগদ অর্থ গুনে নিয়েছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে পাউবোর একজন সিবিএ নেতা যুগান্তরকে বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৬৪ জেলার সব বিভাগে রেজাউল করিমের ইজারা সংক্রান্ত দালাল রয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে তিনি পাউবোর সব জমি গিলে ফেলেছেন। তাকে গ্রেফতার করে দুর্নীতির তদন্ত করতে হবে।
অভিযোগের বিষয়ে পাউবোর ভূমি রাজস্ব কর্মকর্তা রেজাউল করিম মঙ্গলবার বলেন, ‘অভিযোগ থাকতেই পারে। কিন্তু ভূমি রাজস্ব কর্মকর্তার পাউবোর জমি লিজ দেওয়ার কোনো ক্ষমতা নেই। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে এ সংক্রান্ত কমিটি জমি লিজের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়। বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়ার বিষয়ে রেজাউল করিম বলেন, মিরপুরে আমার একটি ফ্ল্যাট ছাড়া কোনো সম্পদ নেই। কেউ দেখাতে পারবে না। বনানীর ফ্ল্যাট সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, হ্যাঁ, বনানীতে স্ত্রীর নামে একটি ফ্ল্যাট আছে। নিজের নামে থাকা বনানীর অপর ফ্ল্যাটের কথা তিনি অস্বীকার করেন। গাড়ি আছে স্ত্রীর নামে, পরে তাও স্বীকার করেন।