তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের গুণগান করে বিদায় আউয়াল কমিশনের
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬:১৫ পিএম
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের এক মাসের মাথায় পদত্যাগ করলেন তার সরকারের নিয়োগ দেওয়া নির্বাচন কমিশন। বিদায় বেলায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোর গুণগান করেছেন। সেই সঙ্গে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সামনের নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরামর্শ দিয়েছেন।
বিরোধী দলবিহিন বিতর্কিত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন আয়োজন করা আউয়াল কমিশন মেয়াদ শেষ হওয়ার আড়াই বছর বাকি থাকতেই সাংবিধানিক পদ থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দিল।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল পদত্যাগের ঘোষণা দেন। এ সময় তিনি বিদায়ী বিফ্রিং দেন।
বলেন, আমিসহ মাননীয় কমিশনাররা দেশের পরিবর্তিত বিরাজিত অবস্থায় পদত্যাগ করতে মনস্থির করেছি। আমরা অদ্যই পদত্যাগপত্র মহামান্য রাষ্ট্রপতির সমীপে উপস্থাপনের নিমিত্তে কমিশনের সচিব মহোদয়ের কাছে দেব।
হাবিবুল আউয়াল বলেন, ১৯৯১ এর নির্বাচন সম্মত রাজনৈতিক রূপরেখার ভিত্তিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হয়েছিল। ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচন সাংবিধানিক নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে, সুক্ষ্ম বা স্থূল কারচুপির সীমিত সমালোচনা সত্ত্বেও, সার্বিকভাবে গ্রহণযোগ্য হয়েছিল।
২০০৮ সালের নির্বাচন সেনাসমর্থিত নির্দলীয় তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেই নির্বাচনে বিএনপি সংসদে মাত্র ২৭ টি এবং আওয়ামী লীগ ২৩০ টি আসন পেয়েছিল। নির্বাচন বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিলনা। নিরাপদ প্রস্থান (Safe Exit) বিষয়ে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের সঙ্গে সেনাসমর্থিত অসামরিক তত্বাবধায়ক সরকারের দরকষাকষির বিষয়টি প্রকাশ্য ছিল। সে প্রশ্নে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের অবস্থানও গোপন ছিল না। ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচন সংবিধানমতে দলীয় সরকারের অধীনে হয়েছে।
২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপিসহ অনেক দলই অংশ নেয়নি। ফলে সেই নির্বাচনও ২০২৪ সালের অনুরূপ অন্তর্ভুক্তিমূলক (Inclusive) ছিল না। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়। আসন পেয়েছিল মাত্র ৬ টি। পক্ষান্তরে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ২৫৮ টি। মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে বর্তমান কমিশনের অধীনে। ৪৪ টি নিবন্ধিত দলের মধ্যে ২৮ টি দল নির্বাচনে অংশ নিলেও প্রধানতম বিরোধ দল বিএনপি ও সমমনা দলগুলো সেই নির্বাচন প্রত্যাখান করে। নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়নি।
সিইসি বলেন, কমিশন বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য একাধিকবার আহ্বান করা সত্বেও তারা নির্বাচনে অংশ নেয়নি। নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার বিষয়টি দলের নিজস্ব সিদ্ধান্তের বিষয়।
তিনি বলেন, ১৯৭৩ থেকে হওয়া অতীতের অন্যান্য সব নির্বাচন ছাড়াও ২০০৮, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনের বিতর্কিত বা সন্দিপ্ত বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে কমিশন পরবর্তী সব নির্বাচনগুলো সতর্কতার সঙ্গে আয়োজনের চেষ্টা করেছে। জাতীয় এবং স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন স্তরের নির্বাচনে দিনের বেলায় ব্যালট পেপার প্রেরণ, কতিপয় উপনির্বাচনে ভিডিও পর্যবেক্ষণ, ইভিএম ব্যবহার, দেশের সকল জেলায় একই দিনে তবে প্রতিটি জেলার প্রশাসনিক সীমানার মধ্যে মাঝে ৩/৫ দিন বিরতি দিয়ে ৫/৬ টি ধাপে নির্বাচন অনুষ্ঠান, সরকারি কর্মকর্তাদের ব্যাপকভাবে রদবদল, ইত্যাদি গৃহীত ব্যবস্থা নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুশৃঙ্খল করতে অনেকটাই সহায়ক হয়েছিল। নির্বাচন মূলতঃ একদলীয় হওয়ার কারণে কারচুপি বা সরকারিভাবে প্রভাবিত করার প্রয়োজনও ছিল না। নির্বাচন দলের ভেতরেই হয়েছে। মধ্যে হয়নি। Within হয়েছে Not Between।
তিনি বলেন, কমিশন দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে দু'বছর সময়ে ইউনিয়ন পরিষদের ৯৯২ টি, উপজেলা পরিষদের ৪৯৬ টি, জেলা পরিষদের ৭১ টি, পৌরসভার ৯০টি এবং সিটি কর্পোরেশনের ১৬টি নির্বাচন করেছে। নির্বাচনগুলোর সততা, সিদ্ধতা, নিরপেক্ষতা অবাধ-হওয়া নিয়ে অতীতের ন্যায় ব্যাপক বিতর্ক বা সমালোচনা হয়নি। উপ-নির্বাচনসহ জাতীয় সংসদের মোট ৩১৮ টি আসনে কমিশন নির্বাচন করেছে। দলীয়ভাবে ইনক্লুসিভ না হওয়ার কারণে নির্বাচন বিতর্কিত হয়েছে। এটি সঠিক ও যৗক্তিক। কিন্তু বাংলাদেশের ৫৩ বছরের ইতিহাসে কোনো নির্বাচন কমিশন সংবিধান উপেক্ষা করে সেচ্ছায় নির্বাচন বাতিল করে দিয়ে পদত্যাগ করেছে এবং সেই কারণে নির্বাচন হয়নি এমন উদাহরণ নেই। সরকার বারবার বলছেন ব্যাপক সংস্কারের মাধ্যমে নির্বাচন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। নির্বাচন বারংবার ব্যর্থ হওয়ার প্রকৃত সত্য ও কারণ এই কথাটির মধ্যেই নিহিত।