রাইট টু ফ্রিডমের ওয়েবিনার
রাষ্ট্র সংস্কারে যেসব বিষয়ে অগ্রাধিকার দেওয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের
যুগান্তর ডেস্ক
প্রকাশ: ৩১ আগস্ট ২০২৪, ১১:৩৪ এএম
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বাংলাদেশে গঠিত হয়েছে, সে সরকার তাকে বিপ্লবী সরকার বলা যায়। সরকারকে জনআকাঙ্ক্ষার কথা মাথায় রেখে দেশে প্রয়োজনীয় সংস্কারের পাশাপাশি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। বিপ্লবী এ সরকারের প্রতি দেশের সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি। ভেঙেপড়া সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে সংস্কারে অনতিবিলম্বে কাজ শুরু করতে হবে। গুম, খুন ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের আনতে হবে সুষ্ঠু বিচারের আওতায়। সরকারের সংস্কার এজেন্ডা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি 'ন্যাশনাল চার্টার' স্বাক্ষরের উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অধিকার সংগঠন— রাইট টু ফ্রিডমের (আরটুএফ) 'বাংলাদেশ: দ্য ওয়ে ফরওয়ার্ড' শীর্ষক ওয়েবিনারে আলোচকরা এসব কথা বলেন।
শুরুতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন আরটুএফের প্রেসিডেন্ট অ্যাম্বাসেডর উইলিয়াম বি মাইলাম। সংস্থাটির বোর্ড মেম্বার ও ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ডেপুটি মিশনপ্রধান জনএফ ড্যানিলোয়িচের সঞ্চালনায় ওয়েবিনারে বক্তব্য রাখেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন এবং উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান। ওয়েবিনারে আলোচকদের পরিচিতি তুলে ধরেন রাইট টু ফ্রিডমের নির্বাহী পরিচালক মুশফিকুল ফজল আনসারী।
বাংলাদেশের ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে এটি আরটুএফের প্রথম প্যানেল আলোচনা অনুষ্ঠান। বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার জন্য সাংবাদিক মুশফিককে আলোচনার শুরুর দিকে ধন্যবাদ জানান জন ড্যানিলোয়িচ।
মাইলাম তার স্বাগত বক্তব্যে বলেন, আমি ছোট একটা ইতিহাস বলে আজকের এই সেশনের সূচনা করতে চাই। কারণ যদিও আমি প্রবীণ কিন্তু অনেক কিছু দেখেছি। ’৯০ সালের দশকে ঢাকায় রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করা এরশাদ পতনের কথা উল্লেখ করে বলেন, আমি ঢাকায় অবস্থানকালে তখন এই দৃশ্য এর আগে দেখেছি। এটা হাসির কোনো বিষয় নয়। দুবার নয়, তিন বার; বিগত ৩৫ বছরে এই তিনবার বাংলাদেশকে নতুন করে যাত্রা শুরু করতে হয়েছে। আমরা এক অর্থে একই জায়গাতে ফিরে এসেছি আবার। আপনাদের সরকারকে এক জায়গায় রাখতে হয়েছে, আবার জনগণকে আরেক জায়গায় ফিরে যেতে হয়েছে। বাংলাদেশে যা ঘটেছে তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশকে জানতে হলে বাংলাদেশের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে হবে। দেশটিকে তিনবার নতুন করে যাত্রা শুরু করতে হয়েছে।
তিনি নোবেলজয়ী ড. ইউনূস সরকারের সাফল্য কামনা করেন।
সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম তার বক্তব্যে বলেন, বাংলাদেশে যে অভ্যুত্থান ঘটেছে, সেটি ইতিহাসের সবচাইতে বড় অভ্যুত্থান। শুধু তরুণরাই নয়, গ্রাম-শহর-নগর সব জায়গা থেকে, ধনী, গরিব, মধ্যবিত্ত সবাই এতে অংশ নিয়েছে। এটা ছিল সত্যিকারের একটা গণঅভ্যুত্থান। এই গণঅভ্যুত্থান আমাদের কী বার্তা দিল? হাসিনা সরকার সন্ত্রাসীদের একটা সাম্রাজ্য বানিয়ে বসেছিল। যারা এই সন্ত্রাসে জড়িত, তাদের অবশ্যই সাজা দিতে হবে। এর জন্য কখনো পুনরাবৃত্তি না হয়। ৫ আগস্টের আগে হাসিনা যে দুঃশাসন চালিয়েছে, তা যেন আর না ফিরে আসে।
তিনি বলেন, তারা (শেখ হাসিনা সরকার) আট থেকে ৯ শতাধিক মানুষকে হত্যা করে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে। ধারণা করা হচ্ছে, সংখ্যাটা হাজারের বেশি হবে। শিশু-তরুণ-বৃদ্ধসহ সব শ্রেণির মানুষ এই গণঅভ্যুত্থানে নিহত হয়েছেন। কারণ এতে সব শ্রেণির মানুষ অংশ নিয়েছিল। এটা হলো এক ধরনের অপরাধ।
দ্বিতীয় অপরাধ হলো— বিগত ১৫ বছর ধরে তারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়েছে। সহিংসতা, গ্রেফতার, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, আয়নাঘর তৈরি, তারা এসব অকল্পনীয় কাণ্ড ঘটিয়েছে। এগুলো গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ। এগুলোর অবশ্যই বিচার হতে হবে।
সুজন সম্পাদক আরও বলেন, তাদের অন্য অপরাধটা ছিল অর্থনৈতিক অপরাধ। লুটপাট, চুরি এবং টাকা পাচার করা— এসব অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। দেশ থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন টাকা পাচার করা হয়েছে। এই পাচারকারীদের শাস্তি দিতে হবে। এদের শাস্তিটা হলো একটা গুরুত্বপূর্ণ দাবি। আরেকটা দাবি উঠেছে রাষ্ট্র সংস্কারের। নিরাপদ সড়কের আন্দোলন থেকে এ দাবি তুলেছিল তরুণরা। স্কুলের ছোট ছেলেমেয়েরা এ দাবি তুলেছিলে। যারা এ দাবি তুলেছিল, তারা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে।
অন্তর্বর্তী সরকারকে তিনটি কাজ করতে হবে উল্লেখ হাঙ্গর প্রজেক্ট পরিচালনা পরিষদের এ সদস্য বলেন, আমাদেরকে তিনটি কাজ করতে হবে। যেসব প্রতিষ্ঠান ভেঙে পড়েছে, সেগুলো পুনরায় সুসংগঠিত করতে হবে। হাসিনা পুলিশকে তার ব্যক্তিগত বাহিনী বানিয়ে বসেছিল। দল ও নিজের স্বার্থে সে পুলিশকে ব্যবহার করেছে। পুলিশ রাষ্ট্রীয় বাহিনীর ভূমিকা পালন করেনি। এ প্রতিষ্ঠানটির অধঃপতন হয়েছে। আমলাতন্ত্রের অবস্থাও খুব বাজে। যারা অপরাধ করেছে, তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে এবং শাস্তি দিতে হবে।
দ্বিতীয় এসব প্রতিষ্ঠানকে নতুন করে সাজাতে হবে। এগুলোকে কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হবে। এগুলো না করে এই অন্তর্বর্তী সরকার সঠিকভাবে কোনো কাজ করতে পারবে না।
তৃতীয়ত, বিভিন্ন জায়গায় বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন। এখন কথা হচ্ছে— সংস্কারের পরিধি নিয়ে। এ অন্তর্বর্তী সরকার কতটুকু সংস্কার করার সুযোগ পাবে সেটি হচ্ছে কথা। কেউ কেউ বলছেন, বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পর সংবিধান অকার্যকর হয়ে পড়েছে। এর আর কোনো কার্যকারিতা নেই, নতুন করে শুরু করতে হবে। অপর পক্ষ বলছে, অন্তর্বর্তী সরকার এই সংবিধানের অধীনে শপথ নিয়েছে। এটা পুরোপুরি সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় হয়নি, আমাদের এই সংবিধান সংশোধন করতে হবে। বড় ধরনের কিছু সংস্কার প্রয়োজন, যাতে করে সেই পুরোনো সরকার আবার ফিরে আসতে না পারে।
ড. বদিউল আলম বলেন, আমরা যদি সবকিছু পরিবর্তন করতে চাই, নতুন করে শুরু করতে চাই, যেমন প্রফেসর আলী রিয়াজ বলেছেন, সংবিধান নতুন করে লিখতে হবে। এ রকম হলে বিষয়টা হবে দীর্ঘমেয়াদি, জটিল এবং সহজ হবে না। এ ক্ষেত্রে আমাদের সংবিধানের খসড়া প্রস্তুতকারী কমিটি লাগবে। এর পর নির্বাচন হতে হবে। নির্বাচনের পর সাংবিধানিক অধিবেশন বসাতে হবে, সেখানে খসড়া উত্থাপন হবে এবং তা নিয়ে আলোচনা হবে। আলোচনার পর নতুন সংবিধান পাশ হবে। অনেক আইন রয়েছে সেগুলো বদলাতে হবে, প্রতিষ্ঠান সংস্কার করতে হবে এবং সেগুলো থেকে অনেককে সরিয়ে দিতে হবে। নির্বাচন কমিশন পুর্নগঠন করতে হবে, বিচার বিভাগের সংস্কার করতে হবে। অনেক বিচারক পদত্যাগ করেছেন, তবে যারা রয়েছেন তাদের মধ্যে যাদের মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে তাদের ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে হবে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, আমরা সবাই দেখেছি— জুলাই ও আগস্টে ছাত্রদের নেতৃত্বে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে কীভাবে ৫ আগস্ট সরকারের পতন হয়েছে। এই পালাবদলে ছাত্র এবং জনতার বৈষম্যহীন সমাজের আকাঙ্ক্ষা পূরণে প্রায় সব বিষয় নিয়েই কাজ করতে হচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে। বিগত ১৫ বছরে প্রাতিষ্ঠানিকতা ভেঙ্গে পরায় এই কাজটি খুব চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়িয়েছে।
উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, সামনের দিনগুলোতে পররাষ্ট্রনীতির বিষয়টি এই অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। তাদেরকে আইনশৃঙ্খলা, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, সংস্কারসহ অন্যান্য বিষয়গুলো এ সরকারের জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে আমি মনে করি। আমি এটা বলছি না যে পররাষ্ট্রনীতি এ সরকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়, আমি ভারতের সঙ্গে দেশটির সম্পর্ক নিয়ে কথা বলব। ক্ষমতাচ্যুত হবার পর শেখ হাসিনা চার সপ্তাহের বেশি সময় ধরে ভারতে রয়েছেন। মিয়ানমার পরিস্থিতিও গুরুত্বপূর্ণ, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে সেখানে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হতে দেখেছি। দেশটির যুদ্ধের প্রভাব বাংলাদেশের ওপর পড়ছে। এগুলোকে জরুরি ভিত্তিতে গুরুত্ব দিতে হবে। বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয়ে কীভাবে সাড়া দিবে এটা গুরুত্বপূর্ণ।
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক প্রসঙ্গে কুগেলম্যান বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে কথা বলা দরকার। এটা বাংলাদেশের এখন সবচাইতে জটিল সম্পর্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটাই একমাত্র ঘনিষ্ট দেশ এবং বন্ধু যেটি না পারছে নতুন সরকারকে আলিঙ্গন করতে, না পারছে স্বাগতম জানাতে। যদিও ড. ইউনূস এবং মোদির মধ্যে সংক্ষিপ্ত কথা হয়েছে তবুও সেটা বিশদ বলা যায় না। বাংলাদেশ ভারতের সরকারকে একটা বিষয়ে নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারে যে, তারা নতুন করে যাত্রা শুরু করতে চায়। ভারত তাদের পররাষ্ট্রনীতি, অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং শাসন ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। আমি মনে করি বাংলাদেশের উচিত নয় ভারতের সঙ্গে দরকষাকষিতে ব্যর্থ হওয়া। তাদের এই অংশীদারিত্বের প্রয়োজন রয়েছে। বাণিজ্য, সীমান্ত এবং ভূ-রাজনৈতিক কারণে এই সম্পর্ক প্রয়োজন। ভারতের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ট সম্পর্কের চাইতে বাংলাদেশের কার্যকর একটা সম্পর্ক দরকার।
শেখ হাসিনা ভারত ছেড়ে কোথাও যাচ্ছেন না। তার এই অবস্থান দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সম্পর্কে কী প্রভাব ফেলবে-এমন প্রশ্নের জবাবে কুগেলম্যান বলেন, আমার মনে হয় হাসিনা শাসনামল পরবর্তী এই সময়ে হাসিনা যত দীর্ঘ সময় ভারতে থাকবেন বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক স্বাভাবিকের বিষয়টি ততই কঠিন হয়ে পড়বে। ভারত হাসিনাকে কত সময় আশ্রয় দিবে সেটা বলা মুশকিল তবে ভারতের বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারত তাদের বন্ধুকে ফিরিয়ে দেবে না এবং যত সময় প্রয়োজন তত সময় আশ্রয় দিবে। আমি মনে করি ভারত সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক কার্যকর রাখার বিষয়টিতে বাস্তববাদী হবে যদিও বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে ভারতে উদ্বেগ রয়েছে। আর এ কারণেই ভারত সরকার চাইবে হাসিনাকে আশ্রয় দিবে এমন কোনো দেশ খোঁজে নিতে। এতে কত সময় লাগবে তা জানি না। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বন্দি বিনিময় চুক্তি রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার হাসিনাকে ফেরত চাইবে কিনা তা জানি না। তাকে দেশে পাঠালে অবশ্যই গ্রেফতার করা হবে। এটা ভারতের জন্য খুব কঠিন একটা বিষয়।