আনসার বিদ্রোহ ১৯৯৪: যেভাবে দমন করা হয়েছিল বিদ্রোহীদের
যুগান্তর ডেস্ক
প্রকাশ: ২৯ আগস্ট ২০২৪, ১২:০২ পিএম
১৯৯৪ সালের পহেলা ডিসেম্বর। ঢাকার কাছেই শফিপুর আনসার একাডেমিতে প্যারেডের জন্য জড়ো হয়েছিলেন আনসার সদস্যরা। প্যারেড শুরু হবার আগেই একটি ঘটনা ঘটে। আনসারের এক সদস্য তার ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তারা সাথে কথা কাটাকাটিতে জড়িয়ে পড়েন।
অভিযোগ ওঠে, বিতণ্ডার এক পর্যায়ে সে কর্মকর্তা আনসার সদস্যকে আঘাত করে। এ সময় তার চিৎকারে অন্য আনসার সদস্যরা ছুটে আসেন। মুহূর্তেই বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন আনসার সদস্যরা। তাদের বিক্ষোভ পরিণত হয় বিদ্রোহে। দাবি ওঠে সাত দফার।
কেমন ছিল পরিস্থিতি?
সরকারি প্রেসনোটে বলা হয়েছিল, আনসার সদস্যদের দাবি নিয়ে আলোচনা করার জন্য বাহিনীটির মহাপরিচালক আনসার একাডেমিতে সকল আনসারকে দরবারে উপস্থিত হবার নির্দেশ দেন।
কিন্তু মহাপরিচালক উপস্থিত হবার আগেই কিছু উশৃঙ্খল আনসার সদস্য লাঠিসোঁটা নিয়ে উপ-মহাপরিচালকের উপর হামলা চালায়।
তৎকালীন বিভিন্ন খবরের কাগজের তথ্যমতে আনসার সদস্যরা রাস্তায় গাছ ফেলে যান চলাচলে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। ফলে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া আনসার একাডেমির ভেতরে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে আনসার সদস্যদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এসময় আনসার সদস্যরা ভেতরে বিভিন্ন ভবনে ভাঙচুর চালায়।
শফিপুরে আনসার একাডেমিতে বিদ্রোহের এই খবর আসে ঢাকার খিলগাঁও এলাকায় অবস্থিত আনসার সদরদপ্তরে। তখন সেখানেও বিক্ষোভ শুরু হয়। সদর দপ্তরে প্রায় ৬০০'র মতো আনসার সদস্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জিম্মি করে। ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় কর্মরত বিদ্রোহী আনসার সদস্যরা সশস্ত্র অবস্থায় খিলগাঁও আনসার সদরদপ্তরে এসে জড়ো হয়। এই ঘটনা শুরু হবার পর থেকে আনসার সদস্যদের সাথে আলোচনার জন্য বসা হলেও কোন লাভ হয়নি। শফিপুর আনসার একাডেমিতে তখন সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় চার হাজারের মতো।
ঢাকার বাইরে পার্বত্য চট্টগ্রাম, বরিশাল এবং খুলনায় আনসার সদস্যদের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। দাবির সমর্থনে তারা মিছিলও বের করে। চট্টগ্রামের মিরসরাইতে আনসার সদস্যদের সাথে সংঘর্ষে একজন কর্মকর্তা আহত হন।
বিদ্রোহের অবসান যেভাবে
তিনদিন টানা বিদ্রোহ চলার পর চতুর্থ দিনে সরকার বিদ্রোহ দমনের জন্য সচেষ্ট হয়।সেনাবাহিনী, বিডিআর (বর্তমান বিজিবি) এবং পুলিশের সমন্বয়ে যৌথ অভিযান চালানো হয়। এতে বিদ্রোহী দুইজন আনসার সদস্য নিহত এবং আরো ৮০ জন আহত হয়।
সে সময়ের সংবাদপত্র থেকে জানা যায় বিদ্রোহ দমনের অভিযানে তিনটি হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হয়। বিদ্রোহ দমনের জন্য ভোররাতে অভিযান শুরু হয়।অভিযানের সময় মর্টারশেল, রকেট লঞ্চার এবং লাইট মেশিনগান ব্যবহার করা হয়।
ঢাকার খিলগাঁও এলাকায় আনসারের সদরদপ্তরে বিদ্রোহী প্রায় ৭শ' জন আনসার সদস্যকে দমন করার জন্য তৎকালীন বিডিআর সদর দপ্তর থেকে বিডিআর সদস্যদের পাঠানো হয়। ভোর তিনটে নাগাদ বিডিআর সদস্যরা আনসার সদরদপ্তরের চারপাশে অবস্থান নেয়। এসময় বিডিআর-এর তরফ থেকে মাইকিং করে আনসার সদস্যদের আত্মমর্পণের আহবান জানানো হয়।
কিন্তু ভেতরে অবস্থানরত আনসার সদস্যরা পাল্টা জানিয়ে দেয় তাদের দাবি না মানলে আত্মসমর্পণ করবেন না। এরপর বিডিআর-এর তরফ থেকে মাইকিং করে আবারো আনসার সদস্যদের আত্মসমর্পণের আহবান জানানো হয়। কিন্তু আনসার সদস্যরা আবারো একই জবাব দেয়।
এরপরই বিডিআর সর্বাত্মক অভিযানের জন্য এগিয়ে যায়। অভিযানের সময় কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করা হয় এবং গুলির শব্দ শোনা যায়। বিডিআর যখন অভিযান শুরু করে তখন আনসার সদস্যদের তরফ থেকে তেমন কোন প্রতিরোধ আসেনি।
এসময় অপ্রত্যাশিত আরেক পরিস্থিতির তৈরি হয়। গুলির শব্দে এবং কাঁদানে গ্যাসের কারণে স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকেই ভীত এবং বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।
এক পর্যায়ে কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার এবং গুলি না করার জন্য কিছু এলাকাবাসী বিক্ষোভ মিছিল বের করে। তখন পুলিশের সাথে তাদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। পুলিশ এলাকাবাসীকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। বিডিআর সদস্যরা যখন আনসার সদর দপ্তরের প্রধান ফটক ভেঙে ভেতরে ঢোকার জন্য অগ্রসর হয় তখন ভেতর থেকে আনসার সদস্যরা আর্তনাদ শুরু করে।
শফিপুরে হেলিকপ্টার নিয়ে সেনাবাহিনী
এদিকে শফিপুরে আনসার একাডেমির নিয়ন্ত্রণ নেবার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায় সাভারে অবস্থিত সেনাবাহিনীর নবম পদাতিক ডিভিশন। সকাল নাগাদ সেনা সদস্যরা ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে আনসার সদস্যদের তৈরি ব্যারিকেডের কাছে চলে আসে।
এসময় মাইকিং করে আনসার সদস্যদের আত্মসমর্পণের জন্য আহ্বান জানানো হলেও তারা কর্ণপাত করেননি। তখন আত্মসমর্পণের জন্য সেনাবাহিনীর তরফ থেকে ৩০ মিনিট সময় বেঁধে দেয়া হয়।
নির্ধারিত সময় অতিক্রান্ত হবার পর সেনাবাহিনীর দুটি হেলিকপ্টার আনসার একাডেমির উপরে চলে আসে। একই সাথে সেনাসদস্যরা গুলিবর্ষণ করে অগ্রসর হতে থাকে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মাত্র ৪৫ মিনিটে শফিপুর আনসার একাডেমি সেনা সদস্যদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। একাডেমির ভেতর থেকে প্রায় ১২৬২ জন আনসার সদস্যকে আটক করে সেনাবাহিনী।
একইসাথে চট্টগ্রাম, খুলনা, যশোর এবং লালমনিরহাটে বিদ্রোহী আনসার সদস্যদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করা করা হয়। ঢাকার বাইরে বিডিআর মুখ্য ভূমিকা পালন করে।
সরকারের প্রেসনোটে বলা হয় আনসার সদস্যদের অনমনীয় মনোভাবে কারণে দফায়-দফায় আলোচনা ব্যর্থ হয়।
সে কারণে জনজীবনের নিরাপত্তা এবং ব্যাটালিয়ন আনসারদের মধ্যে শৃঙ্খলা আনার জন্য সফিপুরে সেনাবাহিনী এবং অন্য কয়েকটি স্থানে বিডিআর ও পুলিশ তলব করে।
সরকারি ভাষ্যে বলা হয়, বিপথগামী কিছু আনসার সদস্য বাধার সৃষ্টি করে এবং গুলি ছোঁড়ে। সরকারের তরফ থেকে বলা হয় অভিযানের সময় দুইজন আনসার সদস্য নিহত এবং সাতজন আহত হয়।
আনসার বিদ্রোহের কারণ
প্রথমে সাত দফা দাবি তুললেও পরবর্তীতে আনসার সদস্যরা এক দফা দাবি তোলেন। সেটি হচ্ছে চাকরি স্থায়ী করা। তারা হুঁশিয়ারি দেয় যে, ৫ই ডিসেম্বরের মধ্যে তাদের দাবি মানতে হবে, নইলে আন্দোলন কঠোর আকার ধারণ করবে। তারা যেসব দাবি জানায়:
. ব্যাটালিয়ন আনসারদের স্থায়ী করা হোক
. ব্যাটালিয়ন আনসারদের প্রশাসনিক ব্যবস্থা আলাদা করা
. আন্দোলনরত আনসারদের চাকরীচ্যুত করা যাবে না
. চাকরি শেষে পেনশন
. অন্যান্য বাহিনীর মতো ব্যাটালিয়ন আনসারদের সমমর্যাদা
আনসার সদস্যদের মধ্যে অসন্তোষ দীর্ঘদিন ধরেই পুঞ্জিভূত হচ্ছিল। বেতন-ভাতা এবং চাকরি স্থায়ী করার দাবি জানিয়ে আনসাররা আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল বলে জানা যায়।
এ বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হয়েছিল। এছাড়া আনসার বাহিনীর মধ্যে কিছু দুর্নীতি সাধারণ আনসার সদস্যদের ক্ষুব্ধ করে তোলে বলে জানা যায়।
এই বিদ্রোহের পর তৎকালীন আনসার বাহিনীর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল সৈয়দ বদরুজ্জামান এবং উপ-মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার ইমতিয়াজ আহমেদকে সরকার বাধ্যতামূলক অবসর দেয়।
আদালতের নির্দেশে চাকরি ফেরৎ
উনিশশো চুরানব্বই সালে আনসার বিদ্রোহের ঘটনায় শাস্তি হিসেবে প্রায় ২৫০০ আনসার সদস্যকে গ্রেপ্তার ও চাকরীচ্যুত করা হয়।
এদের মধ্যে অনেকে নিজেদের নির্দোষ দাবি করে পরবর্তীতে আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন।
আদালতের মাধ্যমে ২০১৮ সালে ওই বিদ্রোহের অভিযোগ থেকে খালাস পান ১ হাজার ৪৪৭ জন। তবে তাদের মধ্যে যাদের বয়স ও শারীরিক সক্ষমতা রয়েছে, তাদেরকে চাকরিতে পুনর্বহালের নির্দেশ দিয়েছে আদালত।
আর যাদের চাকরির বয়স শেষ, তারা চাকরিতে যতদিন ছিলেন তাদেরকে ততদিনের পেনশন সুবিধা দেয়ার জন্যও সরকারকে নির্দেশনা দেয়া হয়।