মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকী হত্যাকাণ্ডে আ.লীগ জড়িত থাকার ইঙ্গিত ছেলের
যুগান্তর ডেস্ক
প্রকাশ: ২৬ আগস্ট ২০২৪, ০৬:৪৬ পিএম
মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকী। ফাইল ছবি
২০১৪ সালে রাজধানীর রাজাবাজারের ভাড়া বাসায় ঢুকে বেশ কয়েকজন যুবক পরিবারের সদস্যদের জিম্মি করে বেসরকারি টেলিভিশনের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের উপস্থাপক মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকীকে হত্যা করে। ওই ঘটনায় হওয়া মামলা পুলিশের তিনটি ইউনিট তদন্ত করে।
হত্যাকাণ্ডের ১০ বছরে আটজন তদন্ত কর্মকর্তার হাত বদল হয়েছে। বর্তমান মামলাটির তদন্ত সংস্থা সিআইডি এখনো অভিযোগপত্র জমা দিতে পারেনি। মামলার তদন্ত প্রতিবেদনও জমা দেওয়া হয়নি।
মামলার তদন্ত নিয়ে বরাবরই হতাশা প্রকাশ করেছে নুরুল ইসলাম ফারুকীর পরিবার। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর নতুন করে এই আলেমের হত্যাকাণ্ড নিয়ে মুখ খুলেছেন তার পরিবারের সদস্যরা।
নুরুল ইসলাম ফারুকীর ছেলে মাওলানা ফুয়াদ আল ফারুকী রোববার সকালে নিজের ফেসবুক আইডিতে বাবার হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়ে দীর্ঘ একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। হত্যাকাণ্ডের দিন কী ঘটনা ঘটেছিল তা বিস্তারিত তুলে ধরেছেন তিনি। তার বাবার হত্যাকাণ্ডে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের জড়িত থাকার ইঙ্গিতও দিয়েছেন ফুয়াদ আল ফারুকী।
ফুয়াদ আল ফারুকীর স্ট্যাটাসটি পাঠকের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো-
“২৭ আগস্ট ২০১৪ বুধবার, ১৭৪ পূর্ব রাজাবাজার, গ্রিনরোড, ফার্মগেট। সন্ধ্যায় মাগরিবের নামাজ পড়ে আব্বা শহিদ শাইখ নুরুল ইসলাম ফারুকী (রাহ.) ড্রইং রুমে পড়তে বসেন অন্যান্য দিনের মতো। বাসায় তখন ছিলেন আমার আম্মা, নানি, একজন নারী মোহাম্মদপুর থেকে তার মেয়েকে নিয়ে এসেছিলেন মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে তাই দোয়া নিতে। তিনি অনেক আগে থেকেই আমাদের পরিচিত ছিলেন, আব্বুর অনুষ্ঠান দেখতেন টেলিভিশনে সেই সুবাদে আরকি। আর ছিল আমাদের বাসার একজন গৃহকর্মী নারী ও আমার আপন মামাতো ভাই মারুফ হাসান; তিনি সম্পূর্ণ ঘটনার একমাত্র পুরুষ প্রত্যক্ষ সাক্ষী।
হঠাৎ বাসায় বেল বেজে উঠলে দরজা খুলেন মারুফ হাসান। আমাদের বাসায় দুটো দরজা, একটি পশ্চিম দিকে, যা দিয়ে সরাসরি ডাইনিং ও সেখান থেকে সরাসরি আব্বুর মাস্টার বেডে যেখানে আব্বু ঘুমাতেন। অপর দরজাটি দক্ষিণ দিকে, যেটি সরাসরি ড্রইং রুমে, মেহমান আসলে সেই দরজা দিয়ে সাধারণত মেহমানদের বসতে দেওয়া হতো ও সেখানেই আব্বু পড়াশোনা করতেন।
মারুফ হাসান পশ্চিমের দরজা খুলে জিজ্ঞাসা করলেন ‘আপনারা কারা, কী জন্য এসেছেন’। জবাবে তারা বলেন যে, ‘আমরা হজে যেতে চাই হুজুরের এজেন্সিতে, উনার সঙ্গে কথা বলতাম’। লোকগুলো সবাই যুবক থেকে মধ্যম বয়স্ক ছিলেন। পরনে সবারই শার্ট, গেঞ্জি, প্যান্ট ছিল। তাদের এবার দক্ষিণের দরজা খুলে দিয়ে ড্রইং রুমে বসতে দেওয়া হয়। সেখানে এসি ছাড়া হয় মেহমানদের জন্য, সোফায় কিছু লোক বসে আর কিছু খাটে, দুজন মনে হয় দাঁড়িয়ে ছিলেন। সাত জনের মতো লোক।
এবার আব্বু বললেন, ‘ভাই এ বছর তো হজ শেষ, আপনারা এসেই যখন পড়েছেন চা খেয়ে যান, সামনের বছরের হজের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করুন’। তারা বলেন, ‘সামনের বছরই যাব, সেই নামগুলোই এন্ট্রি করাতে এসেছি। আমাদের সঙ্গে আরও কয়েকজন যাবেন তাদের কি ডেকে আনবো’? আব্বা বললেন, ‘জ্বি ডাকুন’। কল করে তারা ডেকে আনলেন আরও ৭-৮ জন। আব্বু থাকাকালে উনার সামনে সাধারণত নাম-পরিচয় জানতে মেহমানদের বেশি জিজ্ঞাসা করলে আব্বু রাগ করতেন, নিজেই পরিচিত হতে পছন্দ করতেন।
এবার ঘর ভরে গেল ১৪-১৫ জন মানুষে। আব্বু বললেন, ‘মারুফ ভেতর থেকে চেয়ার নিয়ে আসো, সবাইকে বসতে দাও’। ড্রইং রুম থেকে ডাইনিংয়ে আসতে যে দরজা ছিল, তা খুলে এক রুম থেকে অন্য রুমে গেলে অটো (স্বয়ংক্রিয়) বন্ধ হতো দরজা। এসি রুম থাকায় এ ব্যবস্থা ছিল, প্রতিটি দরজায় ফোম লাগানো এয়ার টাইট করা ছিল। মারুফ হাসান চেয়ার নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই শুকনো মাটিতে আছাড় খেলেন। যা দেখেন তা হলো- এই খনিকের মধ্যেই দুপাশে দুজন আব্বুকে মাথায় পিস্তল ও চাপাতি ধরে চুপ চুপ বলতে বলতে মারধর করছেন ও মুহূর্তেই কয়েকজন ঘরের পর্দা বিছানার চাদর কাটছে বাঁধার জন্য। কিছু বুঝে উঠতেই মারুফকে এক ধাক্কা দিয়ে বিছানায় আরেক মুহূর্তেই লাথি ও পিস্তলের বাট দিয়ে মাথায় প্রচণ্ড আঘাত করতে শুরু করে। এসব কাজগুলোই কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার ছিল মাত্র। মুহূর্তেই মারুফকে নিস্তেজ করে কয়েকজন, আর কয়েকজন আব্বুকে বেঁধে ফেলেন।
বাঁধার প্রক্রিয়া ছিল খুবই করুণ। বড় বলের মতো করে কাপড় মুখে পুরে দিয়ে হা করিয়ে দুই ঠোঁটের মাঝে একটি কষে বান, চোখ কষে বান, দুহাত ও দুপা পেছনে ফোল্ড করে পেছন দিকেই দুহাত ও পা একত্রে কষে বান। এবার মাস্টার বেডে যেখানে নারীরা ছিল সেখানে ৭-৮ জন ঢুকে যায়। হতভম্ব হয়ে আম্মু শুধু দুটি কথা বলার সুযোগ পায়- ‘তোমরা কারা এভাবে অভদ্রের মতো রুমে ঢুকে গেলে কেন’? হত্যাকারীরা যে কথাটি বলেন তা আব্বু চলে যাওয়ার প্রায় এই ১০ বছরে আমরা বলতে পারিনি। সাংবাদিকরা পর্যন্ত আমাদের নিষেধ করেছে যে, ‘এই কথাটা বললে আপনারা বিচার পাবেন না’।
কথাটি হলো- আম্মুর কথার জবাবে তারা বলেছিল- ‘আমরা আওয়ামী লীগ করি, বাইরে মিছিলে পুলিশ ধাওয়া করছে, তাই আশ্রয় নিতে আসছি’। পরবর্তীতে এনটিভি, একাত্তর টিভি, সময় টিভি, এরা নিষেধ করে এবং আম্মার দেওয়া বক্তব্য থেকে এই অংশ কেটে দেয়। দ্বিতীয়ত আম্মু বলেন, ‘তোমরা জানো, আমি একজন আলেম ও ইমাম সাহেবের স্ত্রী, আমার গায়ে যেন হাত না লাগে’। তারা এই দুটো কথার মাঝেই সেই রুমেরও পর্দা ও চাদর কেটে মুহূর্তেই একই কায়দায় সবাইকে বেঁধে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ফেলেন আর একটু পরপর কানের কাছে বলতে থাকেন যে- ‘সামান্য নড়াচড়া করলে শুধু টান দিমু’।
তারা কয়েক ভাগে কাজগুলো করেছে। কেউ কাপড় কেটে রশি বানানোর কাজ, কেউ বাঁধার কাজ। এরপর শুরু হয় সব লুটপাট। বাসার সব আসবাবপত্রের তালা ভেঙে নগদ অর্থ স্বর্ণালংকারসহ নারীদের পরনে থাকা সব কিছুই নিয়ে যায়। হঠাৎ এর মাঝে ময়মনসিংহ থেকে মধ্যম বয়স্ক থেকে মুরুব্বি তিনজন লোক বেল বাজালে বাসায় দক্ষিণের গেট খুলে ড্রইং রুমে থাকা হত্যাকারীরা তাদের এক ধাক্কা দেয় পশ্চিমের দরজা দিয়ে। তারা দক্ষিণের দরজা দিয়ে ড্রইং রুমে ঢুকে আব্বুকে করুণ অবস্থায় বাঁধা দেখতে পেয়ে কিছু বুঝে উঠার আগেই তাদেরও একই কায়দায় বন্দি হতে হয়। তারা এসেছিলেন আব্বুকে মাহফিলের দাওয়াত করতে মূলত।
এদিকে নারীরা বিশেষ করে আম্মু ভাবতেছিলেন তারা হয়তো ডাকাত, লুটপাট করেই চলে যাবে। দক্ষিণের ড্রইং রুমে মারুফকে এতটাই কষে বাঁধা হয়েছিল যে অসহ্য যন্ত্রণায় সামান্য নড়লেও তাকে লাথি ও পিস্তলের বাট দিয়ে প্রচণ্ড মারধর করা হচ্ছিল। মারুফ তখনো কানে শুনছেন। তারা ফিসফিস করে কথা বলছিলেন পরস্পরে উভয় রুমেই। এক রুমের মানুষ অন্য রুমে কী হচ্ছে জানছেন না।
আব্বুর জীবনের শেষ কথাগুলো যা বলছেন, ‘আমার অমুক অমুক জায়গায় চাবি আছে, তোমরা যা নেওয়ার নিয়ে যাও। তোমরা আমার হাতকে পেছনে বেঁধো না, আমার হাত পেছনে যায় না ভাঙা, সামনে বাঁধো’। মারুফকে অস্বাভাবিক মারধর করা দেখে তিনি বলেন, ‘তাকে তোমরা মেরো না, সে আমার ছেলে না, আমার ছেলেরা কেউ বাসায় নেই। তোমরা কেন এসেছো, কী চাও আমার কাছে’? তারা বলেন, ‘আমরা যা করতে এসেছি তা করেই চলে যাব, তুই জীবনের শেষ দোয়া কালাম পড়’। আব্বার তখন বোঝার বাকি রইলো না। শাহাদাতসহ বিভিন্ন দোয়া সেদিন আব্বু পড়েছিলেন।
আব্বুকে অনেক মারধর করেন তারা, অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন। একপর্যায়ে মারতে মারতে ড্রইং রুম থেকে মাঝখানে ডাইনিংয়ে এনে তারা আব্বুকে গলায় পাগড়ি পেঁচিয়ে দুপাশ থেকে টেনে ফাঁসের মতো করে ধরে, হয়তো মৃত্যুর কষ্টে বাবার খুব কষ্ট হচ্ছিল। তাই তিনি ছুটতে চাইলে তার বুকের ওপর ছুরি দিয়ে দুটি ঘা দেওয়া হয়, যাতে তিনি নিস্তেজ হয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন। পূর্ব-পশ্চিম করে তারা আব্বুকে গলার এপার থেকে ওপার ছুরি চালিয়ে দেন, ফিনকি দিয়ে রক্তে ভেসে যায় সঙ্গে সঙ্গে।
আব্বুর মুখে তখনো বড় কাপরের বল ও হাত সামনে বাঁধা ছিল। রক্তের স্রোত ঠেকাতে কয়েক পলট করে পাগড়ি গলাতেই পেঁচিয়ে রেখেছিলেন। আম্মু প্রথম সাড়াশব্দ না পেয়ে হাতের বাঁধন খুটে খুটে খুলতে সক্ষম হন। এরপর চোখ খুলে আব্বুর খোঁজে দৌড়ে মাঝের রুমে এসে দেখেন আব্বু মেঝেতে শুয়ে আছেন, সামনে হাত বাঁধা নিথর দেহ। রান্নাঘর থেকে একটা ছুরি এনে আগে হাতের বাঁধন কাটেন, পরে গলার বাঁধন সরাতেই তখনো তাজা রক্ত গলগলিয়ে বের হতে দেখে শুরু হয় আম্মুর বিলাপ। ঠিক তখনই প্রথম ঘরে প্রবেশ করে আমার সেজো ভাই ফয়সাল ফারুকী। তিনি ধানমন্ডি কোচিংয়ে ছিলেন, এসে তিনি দরজা খোলা দেখতে পান। আম্মুর বিলাপ দেখে পাশের বাসার মানুষসহ বাড়িওয়ালাও সবাইকে ডাক দিয়ে আনেন। আমি ছিলাম মোহাম্মদপুর হোস্টেলে। মেজো ভাই আহমাদ রেজা ফারুকী ছিলেন সৌদি আরবে। বড়ভাই মাসুদ বিন নুর ছিলেন চাকরিতে দেশের বাইরে। বোনেরাও বাইরে ছিলেন...।
তৎকালীন কুখ্যাত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সেদিন গ্রিন রোডেই মিটিংয়ে ছিলেন। আমাদের বাসা থেকে মাত্র ৩০০-৪০০ গজ দূরেই। তখন মূলত চাঞ্চল্যকর পরিস্থিতি ছিল। সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড নিয়ে সব সাংবাদিক ও সব মহল তোড়জোর কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তারা ২০১২ সালেই ফেব্রুয়ারিতে পশ্চিম রাজাবাজারে আমাদের বেশ কাছাকাছি থাকতেন, ছুরিকাঘাতে নিহত হন এই দম্পতি। সেই ফাঁকে আওয়ামীদের জামায়াত নেতাকর্মীদের ধরপাকড় তৎপরতাও অনেক জোরদার ছিল। ঘটনা পরবর্তীকালে প্রশাসনের অনেক লোক বলেছেন, ‘আমরা জানলেও বলতে পারব না, আমাদের হাত-পা বাঁধা’। তাদের মধ্যেও আব্বুর ভক্ত ছিলেন অনেকে। রক্তের দাগসহ আঙুলের ছাপ একটি জমা রশিদ বইয়ে ছিল, সেটিও তদন্তকারীদের কাছে দিয়েছিলাম। ১০ বছরেও তাদের এহেন বিচার প্রক্রিয়াতে আমাদের প্রবল ধারণা তখন থেকেই এটা ছিল যে, সেই হত্যাকাণ্ডের (সাগর-রুনি) ধামাচাপা দিতেই মূলত বলির পাঠা করা হয়েছিল আব্বাকে, নিঃস্ব করে ফেলা হয়েছিল আমাদের পরিবারকে। তা না হলে স্বৈরাচারীকে গালি দিলে পরদিন তাকে ভারত থেকে ধরে আনা সম্ভব হলে ১০ বছরেও বাবার বিচারটা কেন করতে পারছেন না? কারণ হত্যা দিয়ে হত্যা, ইস্যু দিয়ে ইস্যু ধামাচাপা দেওয়ার এমন ঘৃণ্য কূটকৌশল আওয়ামীদের অনেক পুরোনো নীতি।
আমাদের পরিবারের আকুল আবেদন ও দাবি অন্তর্বর্তীকালীন এই সরকারের কাছে- আব্বুর মামলাটি বিশেষ নির্দেশনায় পুনরায় তদন্তের মাধ্যমে বিচারিক প্রক্রিয়া চালু করতে আর্জি কামনা করছি”।