ফেনী, নোয়াখালী ও কুমিল্লাসহ বন্যাদুর্গত জেলাগুলোর প্রত্যন্ত অঞ্চলে ত্রাণের জন্য হাহাকার দেখা দিয়েছে। ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থান থেকে এসব এলাকায় বিপুল পরিমাণ ত্রাণ যাচ্ছে। কিন্তু সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় এবং পর্যাপ্ত নৌযানের অভাবে দূর-দূরান্তে আটকেপড়া বানভাসিদের কাছে খাবার পৌঁছানো যাচ্ছে না। অনেকেই মূল সড়কের পাশে ত্রাণ বিতরণ করে ছবি তুলে চলে যাচ্ছেন।
সমন্বয়হীনতার কারণে শহরের আশপাশের কেউ কেউ কয়েক দফা ত্রাণ পেলেও অনেকে কিছুই পাচ্ছেন না। লাখো মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে পারেননি। তারা বাড়ির ছাদ বা উঁচু স্থানে খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করছেন। এর মধ্যেই তাদের খাবার ও বিশুদ্ধ পানি শেষ হয়ে গেছে। ত্রাণ না পেয়ে সীমাহীন কষ্টে দিন কাটছে তাদের।
এদিকে অনেক এলাকায় পানিবাহিত নানা রোগব্যাধিও ছড়িয়ে পড়েছে। ফেনী, চৌদ্দগ্রামসহ কয়েকটি স্থানে আশ্রয়কেন্দ্রে ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা গেছে। কিছু এলাকায় বন্যার পানি কমলেও যেসব এলাকা দিয়ে পানি নামছে ওইসব এলাকায় পানি বাড়ছে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, বন্যায় অনেকের বাড়িঘর ভেঙে গেছে, ঘরের আসবাবপত্র ভেসে গেছে, ভিজে নষ্ট হয়েছে অনেক সরঞ্জাম। এ কারণে খাবার, বিশুদ্ধ পানি, শুকনা কাপড়, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেটের পাশাপাশি বাড়িঘর মেরামতে তাদের নগদ অর্থও প্রয়োজন।
শনিবার সচিবালয়ে চলমান বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ সচিব মো. কামরুল ইসলাম বলেছেন, দেশে চলমান বন্যায় ১১ জেলায় এ পর্যন্ত ৪৯ লাখের বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এতে এখন পর্যন্ত ১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। তবে বন্যা পরিস্থিতির ক্রমেই উন্নতি হচ্ছে।
ব্যুরো ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর
ফেনী ও সোনাগাজী: ফুলগাজী, পরশুরাম, নতুন রানীর হাটের দক্ষিণে অবস্থিত সোনাপুর, দক্ষিণ আবুপুর, এলাহিগঞ্জ, কুমিরাসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে ত্রাণের দেখা নেই। জেলার বাইরে থাকা স্বজনরা বা ব্যক্তিগত উদ্যোগে এসব এলাকায় সামান্য কিছু খাবার-পানি পৌঁছেছে। তবে অনেকে ত্রাণ নিয়ে এলেও সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় এবং নৌযানের অভাবে দুর্গম এলাকায় যেতে পারছেন না। তাছাড়া ত্রাণ বিতরণে সমন্বয়হীতাও দেখা গেছে।
স্থানীয়রা বলছেন, ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থান থেকে যারা ত্রাণ নিয়ে আসেন তাদের প্রশাসনের সহযোগিতা প্রয়োজন। কারণ তারা হঠাৎ করে এসে জেলার কোন এলাকায় যাবেন এ নিয়ে দ্বিধায় থাকেন। তাছাড়া প্রত্যন্ত এলাকায় যাওয়ার জন্য নৌযান প্রয়োজন। কিন্তু এক্ষেত্রে প্রশাসনের কোনো সহযোগিতা তারা পাচ্ছেন না। ফলে শহরের আশপাশের এলাকায় ত্রাণ দিয়ে চলে যাচ্ছেন অনেকে। সমন্বয়হীনতার কারণে দুর্গতদের কেউ কেউ কয়েক দফা ত্রাণ পেলেও অনেকে কিছুই পাচ্ছেন না।
ফেনী জয়কালী মন্দির, সরকারি মডেল প্রাইমারি স্কুল, নাহার গার্ডেন সিটি, ফেনী মডেল হাইস্কুল ও সেন্ট্রাল হাইস্কুলসহ বিভিন্ন ভবনে হাজারো বানভাসি আশ্রয় নিয়েছেন। এদের মধ্যে অনেকে জানিয়েছেন তারা কোনো ত্রাণ পাচ্ছেন না।
এদিকে জেলায় নৌযান দিয়ে মানুষকে উদ্ধার করে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন কিছু নামধারী স্বেচ্ছাসেবী। শুক্রবার প্রবাসী সালাউদ্দিন ও তার দশ বছরের ছেলে ইকবালকে ৩০ টাকা রিকশা ভাড়ার দূরত্ব থেকে শহরে পৌঁছে দিয়ে ১০ হাজার টাকা আদায় করে তারা।
কুমিল্লা, বুড়িচং, ব্রাহ্মণপাড়া ও তিতাস: বুড়িচং উপজেলার ৮টি ইউনিয়ন ও এর আশপাশের প্রায় ১৭০টি গ্রাম বন্যাকবলিত। দুর্গতদের ত্রাণসামগ্রী দেওয়ার জন্য ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে শত শত মানুষ ছুটে আসছে। কিন্তু এসব ত্রাণ থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষরা বঞ্চিত হচ্ছে। প্রয়োজনীয় নৌকা ও স্পিডবোটের অভাবে ত্রাণসামগ্রী নিয়ে যেতে পারছে না বিভিন্ন দাতা সংগঠনের লোকজন।
সরেজমিন দেখা গেছে, উপজেলার ভরাসার বাজার, ইছাপুরা, মহিষমারা ও বুড়বুড়িয়া এলাকায় শত শত ত্রাণবাহী ট্রাক পিকআপ। এতে পাঁচ থেকে সাতটি গ্রামের মানুষ পর্যাপ্ত পরিমাণে ত্রাণ সহায়তা ও খাদ্যসামগ্রী পাচ্ছে। এসব এলাকার কয়েকটি আশ্রয়কেন্দ্রে বিপুল পরিমাণ খাদ্যসামগ্রী জমা পড়ে আছে। কিন্তু দুর্গত এলাকার প্রায় ১৫০টি গ্রামে কোনোভাবেই যাচ্ছে না ত্রাণ।
দুর্গত এলাকার লোকজনের অভিযোগ স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখনো তাদের বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। উপজেলার কালিকাপুর এলাকার বাসিন্দা আব্দুল মান্নান বলেন, আমরা এখনো ত্রাণসামগ্রী পাইনি। সবাই রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করে চলে যায়।
তিতাস উপজেলার কলাকান্দি ইউনিয়নে কলাকান্দি থেকে কদমতুলি সড়কে নির্মিত ১৮ ফুট দৈর্ঘ্যরে কালভার্টটি বন্যার পানির তীব্র স্রোতে ভেঙে গেছে। সেই সঙ্গে পানির তোড়ে বিলীন হয়েছে সড়কের কিছু অংশ। এতে বিপাকে পড়েছেন ওই এলাকার শত শত মানুষ। ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার অনেক গ্রাম নতুন করে প্লাবিত হয়েছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া: বন্যার কারণে আড়িয়ল ও খলাপাড়া এলাকায় হাওড়া নদীর দুটি বাঁধসহ অন্তত ৮টি স্থানে সড়ক ধসে পড়েছে। এতে এসব সড়ক দিয়ে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় এখনো বন্ধ রয়েছে আখাউড়া স্থলবন্দরের বাণিজ্যিক কার্যক্রম। পাশাপাশি আখাউড়া আন্তর্জাতিক ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট দিয়েও যাত্রী পারাপারও বন্ধ রয়েছে।
এদিকে আখাউড়ার আনন্দপুর, সাতপাড়া, কেন্দয়াই, খলাপাড়াসহ বিভিন্ন প্রত্যন্ত এলাকায় ত্রাণ যাচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা। আবদুলাহপুর আশ্রয়কেন্দ্রে হনুফা বেগম নামে এক নারী বলেন, আমাদের অনেকের ঘরবাড়ি ভেঙে গেছে। এখন আমাদের ত্রাণের পাশাপাশি নগদ টাকাও দরকার।
আখাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা গাজালা পারভীন রুহি বলেন, আখাউড়ার বন্যা পরিস্থিতির ক্রমেই উন্নতি হচ্ছে। বাসাবাড়ি থেকে পানি সরে যাচ্ছে। এদিকে কসবায় সীমান্তবর্তী বায়েক ও গোপিনাথপুর ইউনিয়নের প্রায় ৩২টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ঘরবাড়ি থেকে বেরোতে পারছে না তারা। খাবারের অভাবে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।
কসবা উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মোহাম্মদ শাহরিয়ার মুক্তার জানান, ইতোমধ্যে ১০ মেট্রিক টন চাল ও ৪০০ প্যাকেট শুকনো খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
খাগড়াছড়ি ও রামগড়: জেলা সদরের বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্র থেকে মানুষ বাড়ি ফিরতে শুরু করেছে। তবে দীঘিনালার মেরুং ইউনিয়নের বেশির ভাগ এখনো পানিবন্দি। অন্তত ২০টির বেশি গ্রাম পানির নিচে। মেরুং হেডকোয়ার্টার এলাকায় সড়ক থেকে পানি না নামায় খাগড়াছড়ির সঙ্গে লংগদুর সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে।
শনিবার বিকালে কাবুল্যা কার্বারীপাড়ায় রুষা চাকমা নামে এক কিশোরী পানিতে ডুবে মারা গেছে। এদিকে রামগড়ে অনেক দুর্গত বাসিন্দা ঘরের চালে, বড় বড় গাছ ও উঁচু টিলায় আশ্রয় নিয়েছে। খাবার ও বিশুদ্ধ পানির অভাবে তারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
চট্টগ্রাম ও মীরসরাই: জেলার ১১ উপজেলায় ২ লাখ ৬২ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখনো পানিবন্দি রয়েছে কয়েক হাজার মানুষ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে ফটিকছড়ি, মীরসরাই ও হাটহাজারী উপজেলায়। এই তিন উপজেলায় ২ লাখ ৭ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য ১ হাজার ৩ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দিয়েছে জেলা প্রশাসন। ইতোমধ্যে ৪৫৫ মেট্রিক টনের বেশি চাল বিতরণ করা হয়েছে।
মীরসরাই উপজেলায় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিয়েছে ১১ হাজার ৬৩ জন মানুষ। এছাড়া ব্যক্তিগত উদ্যোগে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান আশ্রয় দিয়েছে আরও প্রায় ৫ হাজার মানুষ। এসব মানুষ পর্যাপ্ত খাবার ও পানির অভাবে মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন।
কমলনগর ও রামগতি (লক্ষ্মীপুর): কমলনগর উপজেলার চরকাদিরা, তোরাবগঞ্জ, চরলরেন্স এবং রামগতি উপজেলার চরপোড়াগাছা, চরবাদাম, চররমিজ ও বড়খেরী এই সাতটি ইউনিয়নের প্রায় ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। এসব এলাকার বহু বসতঘর, গ্রামীণ সড়ক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পানিতে তলিয়ে গেছে।
ডুবে গেছে আমন ধানের বীজতলা, শাকসবজির মাঠ। কমলনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইউএনও সুচিত্র রঞ্জন দাস জানান, পানিবন্দি পরিবারের মাঝে শুকনো খাবার বিতরণ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।
নোয়াখালী: জেলার ৮২ ইউনিয়ন ও ৭টি পৌরসভা বন্যাকবলিত। অন্তত ৩৬ হাজার মানুষ বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও ধনী ব্যক্তিদের বাড়িঘরে আশ্রয় নিয়েছে। সরকারি তালিকাভুক্ত আশ্রয়ণকেন্দ্র রয়েছে ৫০২টি। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। শনিবার বিকাল পর্যন্ত ২০০টিতে প্রয়োজনীয় খাদ্য পৌঁছেনি বলে জানা গেছে।
কমলগঞ্জ ও কুলাউড়া (মৌলভীবাজার): শত কষ্টের মধ্যেও শনিবার কমলগঞ্জে মানুষের মুখে হাসি ফুটেছে। কারণ রোদ উঠেছে এবং বন্যা পরিস্থিতিরও উন্নতি হচ্ছে। প্লাবিত এলাকা থেকে নামতে শুরু করেছে পানি। তবে পানি যত কমছে, ততই স্পষ্ট হয়ে উঠছে ক্ষয়ক্ষতির চিত্র। বন্যাদুর্গত মাছুম মিয়া বলেন, বন্যায় সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। ঢলের স্রোতে এবং ঢেউয়ে ঘরবাড়ি নষ্ট হয়েছে। এখন এগুলো কীভাবে মেরামত করব, সেই চিন্তায় আছি। আমাদের নগদ অর্থের প্রয়োজন। সাজিনা বেগম বলেন, বন্যায় আমাদের ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমরা সরকারের কাছে দাবি জানাই, যেন আমাদের ঘরে থাকার উপযোগী করতে সহায়তা করে।
হবিগঞ্জ ও চুনারুঘাট : জেলায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। সব নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার নিচে নেমেছে। চুনারুঘাটে এক হাজার ৮৮০ হেক্টর বোনা আউশের জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যার পানি পুরোপুরি না নামায় এসব জমির ধানগাছ পুরোপুরিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।