Logo
Logo
×

জাতীয়

আদালতে দীপু মনি-জয়কে কিল-ঘুষি, আইনজীবী না পাওয়া ও মামলার ধরন নিয়ে যত প্রশ্ন

Icon

যুগান্তর ডেস্ক

প্রকাশ: ২৩ আগস্ট ২০২৪, ০১:১৯ পিএম

আদালতে দীপু মনি-জয়কে কিল-ঘুষি, আইনজীবী না পাওয়া ও মামলার ধরন নিয়ে যত প্রশ্ন

তীব্র জনরোষে হাসিনা সরকারের পতনের পর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সব নেতারা আত্মগোপনে চলে যান। পালাতে শুরু করে সেই সরকারের প্রভাবশালী এমপি-মন্ত্রী ও সরকারের সুবিধাভোগী প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। কেউ কেউ আবার পালাতে গিয়ে আটক হয়েছেন। আবার কেউ দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমাতে সক্ষমও হয়েছেন।

তবে এরই মধ্যে আটক হয়েছেন আওয়ামী লীগ সরকারের একজন উপদেষ্টা, শীর্ষ সাবেক তিন মন্ত্রী, দুইজন প্রতিমন্ত্রী, সংসদের ডেপুটি স্পিকার, একজন উপমন্ত্রী, দুইজন এমপিসহ দলের বেশ কয়েকজন নেতা। এদের মধ্যে কেউ কেউ রিমান্ডে আছেন, কোনো কোনো নেতাকে পাঠানো হয়েছে কারাগারে।

পুলিশ এদের মধ্যে কয়েকজনকে ‘গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গ্রেফতারের’কথা বললেও তাদের আগেই বিমানবন্দরে আটক করার কথা জানা যায়। ফলে, তাদের আটকের স্থান ও সময় নিয়ে তৈরি হয়েছে নানা রকম আলোচনার।

কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতা ও মৃত্যুর ঘটনায় শেখ হাসিনাসহ তার সরকারের মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের এমপিদের বিরুদ্ধে সারাদেশে বহু মামলা হয়েছে। এখন পর্যন্ত যারা আটক হয়েছেন তাদেরকে বিভিন্ন মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে তোলে পুলিশ।

সরকার পতনের পর আওয়ামী লীগের প্রতি মানুষের যে তীব্র ক্ষোভ দেখা দিয়েছিল সেটির বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে আদালত প্রাঙ্গণে দলটির আটক নেতাদের ওপর।

মঙ্গলবার সাবেক মন্ত্রী দীপু মনি ও উপমন্ত্রী আরিফ খান জয়কে পুলিশ প্রহরার মধ্যেই কিল-ঘুষি দেওয়ার ঘটনা ঘটে। দীপু মনিকে চারদিনের রিমান্ড দেওয়া হয়।

তবে ওইদিনই আইনি অধিকার নিয়ে কাজ করা সংস্থা বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন মামলায় বিশেষ করে নারীদের গ্রেফতার ও রিমান্ড দেওয়ার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি দেয়। এক্ষেত্রে, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা বাস্তবায়নের দাবিও জানায় তারা।

অন্যদিকে, যেসব ফৌজদারি মামলায় সাবেক মন্ত্রী-এমপিদের গ্রেফতার ও রিমান্ডে নেওয়া হচ্ছে, সেগুলোতে তাদের বিচার করে শাস্তির আওতায় আনা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়তে পারে বলে জানান আইনজীবীরা।

এর কারণ হিসেবে তারা বলছেন, সেখানে সুনির্দিষ্টভাবে এই আসামিদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। একইসঙ্গে এসব হত্যা মামলায় আসামি অজ্ঞাতনামা দেখানো হয়েছে। তাদের পক্ষে আদালতে কোনো আইনজীবী না উপস্থিত না থাকার বিষয়টিও আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

বিগত আওয়ামী লীগ শাসনামলেও আদালত প্রাঙ্গণে হামলা এবং মামলার ক্ষেত্রে একই ধরনের অসঙ্গতির প্রবণতা দেখা গিয়েছিল বলে মন্তব্য করছেন কেউ কেউ। এখনই নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে এসব বিচার নিয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ থেকে যাবে বলে ধারণা তাদের।

আদালত প্রাঙ্গণে মব জাস্টিস কেন?

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং ক্ষমতাচ্যুত সরকারের সমাজকল্যাণমন্ত্রী দীপু মনিকে মোহাম্মদপুর থানার একটি হত্যা মামলায় আদালতে হাজির করা হয়েছিল।

একই মামলায় সাবেক ক্রীড়া উপমন্ত্রী আরিফ খান জয়কেও আসামি হিসেবে হাজির করে তাদের রিমান্ড চায় পুলিশ। আদালত দীপু মনির চার ও জয়ের পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। তবে তাদের আনা নেওয়ার সময় আদালতে প্রাঙ্গণে আইনজীবীসহ উপস্থিত লোকজনের ক্ষোভের মুখে পড়েন তারা।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবি ও ভিডিওতে দেখা যায়, পুলিশের বেষ্টনীর মধ্যেই তাদের গায়ে কিল-ঘুষি দিচ্ছেন বিক্ষুব্ধরা। দীপু মনির শাড়ির আঁচল টেনে ধরার ঘটনাও ঘটে।
এই ঘটনাকে 'মব জাস্টিস' হিসেবে উল্লেখ করে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, জাস্টিস নিশ্চিত করা এবং মব জাস্টিস এক নয়। দুটি জিনিসকে আলাদা করতে হবে।

তিনি বলেন, আদালত প্রাঙ্গণে মব জাস্টিস কেন? নিরাপত্তা দিতে না পারলে অন্য ব্যবস্থা নিয়ে তাদেরকে কোর্টে হাজির করেন।

সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ নুরুল হুদা বলছেন, এভাবে আসামিকে নিয়ে যাওয়া ঠিক হচ্ছে কি না ওপেন কোর্টে, নিরাপত্তার দিকটাও চিন্তা করার বিষয় আছে। এখানে দুর্ঘটনাও তো ঘটে যেতে পারে।

এসব ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার বন্দোবস্ত থাকা দরকার বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলছেন, শারীরিক আক্রমণের সঙ্গে জড়িত আইনজীবীদের বিরুদ্ধে 'প্রোফেশনালি' ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

নিরাপত্তা বাহিনীর বিষয়টি খতিয়ে দেখা উচিত বলে মনে করেন অ্যাটর্নি জেনারেল আসাদুজ্জামানও। তিনি বলেন, ক্ষোভ থাকতে পারে তাই বলে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ এমন পর্যায়ে যাওয়া উচিত না যেটা ন্যায় বিচারকে ব্যাহত করে।

একাধিক আইনজীবী নাম প্রকাশ না করা শর্তে বলেন, বিক্ষুব্ধ পরিস্থিতিতে সেদিন আদালতে তাদের পক্ষে কারো দাঁড়ানোর মতো অবস্থা ছিল না। আদালতে উপস্থিত ছিলেন না রাষ্ট্রপক্ষ বা আওয়ামী লীগপন্থী কোনো আইনজীবীও। দীপু মনির পক্ষে একজন আইনজীবী কথা বলার চেষ্টা করলেও অন্য আইনজীবীদের তোপের মুখে তিনি কথা এগিয়ে নিতে পারেননি।

জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলছেন, আইনজীবীর সহায়তা পাওয়া একটি সাংবিধানিক অধিকার। এতে বাধা দেওয়া অনৈতিক।

তিনি বলেন, ব্যক্তিগতভাবে কেউ কারো মামলা নাই নিতে পারেন। কিন্তু সম্মিলিতভাবে আইনি সহায়তা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

এ বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, যদি কেউ আইনজীবী নিয়োগে বাধা দেয় তা বেআইনি। এটাকে আমি বাধা দেবো। যদি অভিযুক্তদের পক্ষে একান্তই কোনো আইনজীবী না পাওয়া যায়, তাহলে সরকারের পক্ষ থেকে আইনি সহায়তা দেয়ার বিধান রয়েছে। সেক্ষেত্রে, হত্যা মামলার আসামির হয়ে লড়বেন রাষ্ট্রপক্ষের কোনো আইনজীবী।

আসাদুজ্জামান আরও বলেন, আইনজীবী নিয়োগ দেওয়ার স্টেজ এখনো আসেনি। চার্জশিট দেওয়ার পর ট্রায়াল শুরু হলে সরকার যদি দেখে কোনো মামলায় মৃত্যুদণ্ডের সাজা আছে, তাহলে স্টেট ডিফেন্স (রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী) দেওয়া হবে।

আটক ও মামলার ধরন

আওয়ামী লীগ নেতাদের আটকের পর যেসব মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয় সেগুলোর এজাহার থেকে জানা যাচ্ছে, এসব মামলায় সুনির্দিষ্টভাবে তাদের নাম নেই। বরং অজ্ঞাতনামা আসামির কথা বলা আছে।

পরে, আদালতে যেসব মামলা করা হয় সেখানে শেখ হাসিনাসহ তার সরকারের মন্ত্রী, এমপি এবং সাবেক পুলিশ কর্মকর্তাদের নামও আছে।

সাবেক আইজিপি মোহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, যদি মামলার ক্ষেত্রে কোনো অসঙ্গতি থাকে সেটা অভিযুক্তকেই সুযোগ করে দেবে। এটি বাদী পক্ষের মামলাকে দুর্বল করে দেবে, তাহলে মামলা প্রমাণ করা মুশকিল হয়ে যেতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শিশির মনির বলেন, তদন্তকারী কর্মকর্তারা তদন্তের সময় যদি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনতে পারেন তবেই এ মামলাগুলো সঠিকভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হবে। অন্যথায় অভিযোগের সত্যতা নিয়ে নানান ধরনের সন্দেহ থেকে যেতেই পারে।

এ বিষয়ে আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলছেন, এখনই কোনো সিদ্ধান্তে না পৌঁছে অপেক্ষা করতে আগ্রহী তিনি। বিগত সরকারের সময়ে এমন ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে।
এ আইনজীবী আরও বলেন, পরিস্থিতি এখন যেদিকে যাচ্ছে সেটাকে যদি তদন্ত পর্যায়ের আগেই নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, ট্রায়াল নিয়ে পরবর্তীতে প্রশ্ন তোলার সুযোগ থেকে যাবে।

তথ্যসূত্র : বিবিসি বাংলা

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম