Logo
Logo
×

জাতীয়

দুর্নীতি দমনে চাই কঠোরতা 

Icon

হাসান আল বান্না

প্রকাশ: ১৯ আগস্ট ২০২৪, ০৫:১০ পিএম

দুর্নীতি দমনে চাই কঠোরতা 

বাংলাদেশের সব নাগরিক একটি উদার গণতান্ত্রিক দেশের সুবিধাভোগী হোক এটা সিনিয়র সিটিজেন ও নাগরিক সমাজসহ সবারই কাম্য। 

রাজনৈতিক মতাদর্শ ও মতপার্থক্য থাকবে এটাই বাস্তবতা; কিন্তু ভিন্নমতকে সহ্য করার উদারতা থাকতে হবে। তবে একটি ইস্যুতে নবাগত সরকারকে কঠোর ও শূন্যসহনশীল হতে হবে, সেটি হচ্ছে ‘দুর্নীতি দমন’। নতুন সরকারের কাছে অর্থনৈতিক মন্দা থেকে দেশকে উত্তরণ, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনাসহ নানা চ্যালেঞ্জ রয়েছে। 

কিন্তু সবার আগে গুরুত্ব দিতে হবে দুর্নীতি বন্ধে। কারণ দুর্নীতি আর স্বজনপ্রীতির কারণে দেশটার আজকের এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এখন কাজ হচ্ছে এতোদিন যারা দুর্নীতি করেছে তাদের বিচারের মুখোমুখি করা এবং একইসঙ্গে দুর্নীতির মাধ্যমে কামিয়ে নেওয়া অর্থ উদ্ধার করে সরকারি ভান্ডারে জমিয়ে রাখা। আর নতুন করে যেন কেউ দুর্নীতির মাধ্যমে কোনো সুবিধা নিতে বা দিতে না পারে সে বিষয়ে কঠোর ভূমিকায়ও থাকতে হবে। 

দুর্নীতির মাত্রা কোন দেশে কেমন, সে সম্পর্কে ধারণা দিতে প্রতিবছর প্রতিবেদন প্রকাশ করে জার্মানির বার্লিনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল। গত (২০২৩) সালের দুর্নীতির যে ধারণাসূচক প্রতিবেদন তারা প্রকাশ করেছে সেই প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দুর্নীতির মাত্রা বিশ্বের যেসব দেশে সবচেয়ে বেশি, তার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দশম। 

এর আগে ২০২২ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২তম। অর্থাৎ গত ২০২২ সাল থেকে ২০২৩ সালে দুর্নীতির মাত্র আরও বেড়েছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, যেসব দেশে গণতন্ত্র নেই এবং যেসব দেশে কর্তৃত্ববাদী শাসন রয়েছে, সেসব দেশের চেয়েও বাংলাদেশে দুর্নীতির মাত্রা বেশি।

দুর্নীতির ধারণাসূচকে টিআইর দুর্নীতির সংজ্ঞা হচ্ছে, ব্যক্তিগত সুবিধা বা লাভের জন্য ‘সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার’। আর ধারণাসূচক অনুযায়ী, গত ১৬ বছরের মধ্যে বাংলাদেশে দুর্নীতির মাত্রা সবচেয়ে বেশি ছিল ২০২৩ সালে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের সূচকে দুর্নীতির ধারণার মাত্রাকে ০ থেকে ১০০-এর স্কেলে নির্ধারণ করা হয়। ‘০’ স্কোরকে দুর্নীতির কারণে সর্বোচ্চ ক্ষতিগ্রস্ত এবং ‘১০০’ স্কোরকে দুর্নীতির কারণে সবচেয়ে কম ক্ষতিগ্রস্ত বা সর্বাধিক সুশাসিত বলে ধারণা করা হয়। 

টিআই বলেছে, ১০০ স্কোরের মধ্যে বাংলাদেশ পেয়েছে ২৪, যা গতবারের চেয়ে ১ পয়েন্ট কম। গত ২০২২ সালে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ২৫। টিআইয়ের প্রতিবেদন অনুসারে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ শুধু আফগানিস্তানের চেয়ে ভালো অবস্থানে আছে। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকাসহ অন্য দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে দুর্নীতির হার বেশি। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভুটানের স্কোর ৬৮, ভারত ও মালদ্বীপের ৩৯, নেপালের ৩৫, শ্রীলংকার ৩৪, পাকিস্তানের ২৯ ও আফগানিস্তানের ২০।

সূচকে ১০০ স্কোরের মধ্যে ৯০ পেয়ে সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে তালিকার শীর্ষে আছে ডেনমার্ক। ৮৭ পেয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে ফিনল্যান্ড। তৃতীয় স্থানে নিউজিল্যান্ড, চতুর্থ স্থানে নরওয়ে। যেসব দেশে দুর্নীতি কম সেই তালিকার পঞ্চম স্থানে সিঙ্গাপুর। ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে যৌথভাবে সুইডেন ও সুইজারল্যান্ড।

অন্যদিকে দুর্নীতির মাত্রা সবচেয়ে বেশি সোমালিয়ায়। তাদের স্কোর মাত্র ১১। দ্বিতীয় স্থানে আছে সাউথ সুদান, সিরিয়া ও ভেনেজুয়েলা। টিআই বলেছে, তালিকায় ১০০ স্কোরের মধ্যে সর্বোচ্চ স্কোর প্রাপ্তির ক্রমানুসারে বাংলাদেশের অবস্থান ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৪৯তম। আগের বছর ১৪৭তম অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ।

গত ১৬ বছর ধরে দেশপ্রেমিক নাগরিকরা এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বললে ওই সময়কার সরকারের পক্ষ থেকে বলা হতো এরা সরকার হটানোর ষড়যন্ত্র করছে। অর্থ্যাৎ দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো ষড়যন্ত্র দেখতো তৎকালীন সরকার। ফলে দুর্নীতিবাজরা উৎসাহীত হতো। 

সরকারের শীর্ষ মহল থেকে শুরু করে একজন পিয়ন ও সরকারি কর্মকর্তার গাড়ি চালকও দুর্নীতি করে শক কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার আগে শেখ হাসিনা প্রকাশ্যে সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছেন তার বাসার কাজের লোক ৪শ কোটি টাকার মালিক হয়েছেন, চলা ফেরা করেন হেলিকপ্টারে। এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল দেশে।

দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের অনেক নেতা ও সরকারি আমলারা দুর্নীতির মাধ্যমে কামানো টাকা বিদেশে পাচার করেছেন, সেখানে তারা নানা স্থাপনা গড়ে তুলেছেন। ফলে দেশের অর্থনীতির চাকা ভেঙে পড়েছে।  

অর্থনীতির এ ভঙ্গুর অবস্থা থেকে উত্তরণ এবং টেকসই বিনিয়োগ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য দরকার ‘স্বচ্ছ প্রশাসন’। আর সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা ও সমৃদ্ধির সব সুযোগ এবং সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হবে তখনই যখন জবাবদিহিতামূলক সরকার রাষ্ট্র পরিচালনা করবে। অনেকেই মনে করেন, দুর্নীতি দমনে প্রয়োজন সরকার ও জনগণের সমন্বিত পদক্ষেপ।

দুর্নীতি দমন কমিশনকে কর্মপরিবেশ দিতে হবে, সেখানেও যদি কোনো দুর্নীতিবাজ থাকে তাকে বের কওে সৎ লোককে পদায়ন করতে হবে ও দক্ষতার দিক থেকে যুগোপযোগী ও আধুনিকায়ন করা হবে দুর্নীতি দমন কমিশনকে। এছাড়াও দুর্নীতি প্রতিরোধে মানুষকে নৈতিক জীবন-যাপনে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। সততা দ্বারা প্রভাবিত আচরণগত উৎকর্ষ যেন সে অনুসরণ করে চলে। তার যেন সমাজের কালোত্তীর্ণ মানদণ্ড, নীতি ও প্রথার প্রতি আনুগত্য থাকে।

দুর্নীতি প্রতিরোধে ব্যক্তি-পর্যায়ে কর্তব্যনিষ্ঠা ও সততা, তথা চরিত্রনিষ্ঠা খুব দরকার। এজন্য বিদ্যমান আইনকানুন, নিয়মনীতির সঙ্গে দুর্নীতি দমনকে একটি আন্দোলন হিসেবে গড়ে তোলার অঙ্গীকার করতে হবে। সেই অঙ্গীকারকে কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরকারের সদিচ্ছার সঙ্গে সঙ্গে জনগণের প্রচেষ্টা গুরুত্ববহ। অর্থাৎ দুর্নীতি লাগাম টানতে হলে দরকার সরকার ও জনগণের যৌথ প্রচেষ্টা। 

লেখক: হাসান আল বান্না, সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম